দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কাজী সানাউল হকের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া, না দেওয়াকে কেন্দ্র করে বেশ অস্বস্তিতে পড়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তারপরেও এই নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে কমিশন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে চায় বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।

ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদের ৬ জন কাজী সানাউল হককে এমডি হিসাবে নিয়োগ দিতে চাইলেও ৪ জনের আপত্তি রয়েছে। এছাড়া সানাউল হকের এমডি হিসেবে নিয়োগে বিএসইসির অনুমোদন চাওয়ার পাশাপাশি আপত্তির বিষয়গুলোও সংযুক্তি করে পাঠানো হয়েছে। এই অবস্থায় সানাউল হককে এমডি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া, না দেওয়া নিয়ে দোটানায় পড়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।

গত বৃহস্পতিবার (০৯ জানুয়ারি) ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদের ৪ জনের আপত্তির মধ্য দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা বা ৬ জনের সম্মতির ভিত্তিতে কাজী সানাউল হককে এমডি হিসাবে নির্বাচন করা হয়। একইদিন বিকালে তার অনুমোদনের জন্য বিএসইসিতে চিঠিও দেওয়া হয়। এরপরে রবিবার (১২ জানুয়ারি) তাকে চূড়ান্ত নিয়োগে ডিএসইর পর্ষদের ৪ জনের আপত্তির বিষয়গুলো বিএসইসিতে চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। যা বিবেচনায় নেওয়ার পর যোগ্যতার ভিত্তিতে এমডি নিয়োগের প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য বিএসইসিকে অনুরোধ করা হয়েছে।

শেয়ারবাজারের মন্দাবস্থায় কাজী সানাউল হককে এমডি নিয়োগের অনুমোদন দেওয়ার পরে কি পরিস্থিতি তৈরী হতে পারে-তা কমিশনকে ভাবাচ্ছে। এই মন্দাবস্থায় তাকে নিয়োগে অনাস্থা বাড়বে কিনা, এমনটিও দুশ্চিন্তার কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, সানাউলের নিয়োগে দোটানা কাজ করলেও কমিশন দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবে। এক্ষেত্রে কমিশন কাজী সানাউল হকের নিয়োগে আইনের ব্যত্যয় হয় কিনা, সে বিষয়টি বিবেচনায় নেবে। তাকে নিয়োগে যদি আইনের ব্যত্যয় ঘটে, তাহলে কমিশন অনুমোদন দেবে না। অন্যথায় তাকে নিয়োগ দেবে।

সানাউলের নিয়োগ নিয়ে বিভিন্ন আপত্তির মধ্যে রয়েছে, এবারের নিয়োগে প্রথাগত প্রক্রিয়া অনুসরন করা হয়নি। অন্যান্যবার এমডি নিয়োগের আগে পর্ষদের সঙ্গে প্রার্থীদের সাক্ষাতকার করানো হলেও এবার তা হয়নি। এছাড়া প্রার্থীদের বিষয়ে পরিচালকদের আগে জানানো হয়নি এবং নোটিশ সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। যাতে সভার সীমিত সময়ের মধ্যে প্রার্থীদের বিচার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়। এক্ষেত্রে প্রার্থীদের বিষয়ে কমপক্ষে ৭২ ঘন্টা আগে পরিচালকদের বিষয়ে বিস্তারিত জানানো উচিত ছিল।

কাজী সানাউল হকের ক্যাপিটাল মার্কেটের ওপরে আন্তর্জাতিক দক্ষতা বা বিশেষ কোন প্রফেশনাল (সিএ/সিএমএ/সিপিএ) সার্টিফিকেট নেই। এই অবস্থায় তাকে সংক্ষিপ্ত তালিকায় নেওয়ার আগে এনআরসি কমিটির ডিএসইর বোর্ডের অনুমোদন নেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু সেটিও করা হয়নি বলে বিএসইসিকে জানানো হয়েছে।

ওইদিনের ডিএসইর পর্ষদ সভায় প্রার্থীদের বিষয়ে জীবনবৃত্তান্তসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিল করা হয়নি চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। যাতে কাজী সানাউল হক বর্তমানে কোন ব্যবসায় জড়িত আছে কিনা, তার বিও হিসাব আছে কিনা ইত্যাদি তথ্যের ঘাটতি দেখা দেয়।

কাজী সানাউল হক বিডিবিএলের বিনিয়োগ বিভাগের জিএম পদে থাকাকালীন দূর্বল সিভিও পেট্রোকেমিক্যাল রিফাইনারীর শেয়ার কেলেঙ্কারীর ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটি জড়ায় বলে চিঠিতে জানানো হয়েছে। এরফলে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে বিডিবিএলকে শাস্তি দিয়ে চিঠি দেয় বিএসইসি। যার দায় সানাউল এড়াতে পারেন না বলে বিএসইসিকে চিঠিতে জানানো হয়েছে।

ডিএসই লাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় মুনাফা বাড়ানো জরুরী। কিন্তু কাজী সানাউল হক আইসিবির এমডি হিসাবে দায়িত্ব পালনকালে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফায় ধস নামে। তিনি ২০১৭ সালের ১০ আগস্ট থেকে ২০১৯ সালের ২১ আগস্ট পর্যন্ত আইসিবির এমডির দায়িত্ব পালন করেন। তার দায়িত্ব গ্রহণের আগের অর্থবছরে (২০১৬-১৭) আইসিবির মুনাফা হয়েছিল ৪৬১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা বা শেয়ারপ্রতি ৭.২৯ টাকা। যা তার নেতৃত্বাধীন প্রথম অর্থবছরে (২০১৭-১৮) কমে আসে ৪১৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা বা শেয়ারপ্রতি ৬.২৭ টাকায়। আর ২য় অর্থবছরে (২০১৮-১৯) রীতিমতো ধস নামে। ওই অর্থবছরে আইসিবির মুনাফা হয় মাত্র ৬০ কোটি ১৩ লাখ টাকা বা শেয়ারপ্রতি ০.৮৬ টাকা। এমতাবস্থায় সানাউল হকের কাছ থেকে ডিএসইর বেশি কিছু আশা করা যায় না বলে জানানো হয়েছে।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, শেয়ারবাজারের উন্নয়নে এবং বর্তমান ক্রান্তিলগ্ন দূরীকরনে একজন স্বচ্ছ ব্যক্তিকে ডিএসইর এমডি হিসাবে নিয়োগ দেওয়া জরুরী। কিন্তু কাজী সানাউল হক ঋণ জটিলতায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তলবে একজন বিতর্কিত ব্যক্তি। যা নিয়ে গণমাধ্যমে ফলাও করে সংবাদ প্রকাশ করা হয়। তার দায়িত্বরত অবস্থায় ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। শেয়ার ব্যবসায় জড়িত যেসব লোক ঋণ পাওয়ার যোগ্য নন তাদের ঋণ দেয়া, যাকে ২৫ লাখ টাকা ঋণ দেয়ার কথা তাকে কয়েক কোটি টাকা করে ঋণ দেয়ার ঘটনা ঘটার অভিযোগ তোলা হয়। এসবের মাধ্যমে সরকারের ১৩৭ কোটি টাকা ক্ষতি হয় বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে। এই অবস্থায় সে দূর্ণীতি না করলেও সানাউলকে নিয়ে গত ১ বছরে গণমাধ্যমে বিভিন্ন লেখালেখিতে তিনি একজন বিতর্কিত ব্যক্তি হয়েছেন। বাজারের এই অবস্থায় বিতর্কের বাহিরে স্বচ্ছ ও সৎ ব্যাক্তি নিয়োগ দরকার। অন্যথায় বাজারে আস্থা নষ্ট হবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশনের মাধ্যমে স্টক এক্সচেঞ্জে স্বতন্ত্র পরিচালক আনা হলেও কার্যত তাদেরকে এখনো শেয়ারবাজারের জন্য ফলোদায়ক না। শেয়ারবাজারের জন্য কার্যকরি সব সিদ্ধান্ত নিতে হয় শেয়ারহোল্ডার পরিচালকদের। তারা শেয়ারবাজারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সর্ম্পৃক্ত থাকায় আদ্যোপান্ত সব জানেন। কিন্তু স্বতন্ত্র পরিচালকেরা সেদিক থেকে পিছিয়ে। আর সেই ৪ জন শেয়ারহোল্ডার পরিচালকের মধ্যে ৩ জনই কাজী সানাউল হকের নিয়োগে বিরুদ্ধে। তাই বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।

এছাড়া সানাউল হকের নিয়োগের বিষয়ে ৪ জনের আপত্তি ছাড়াও ২ জন স্বতন্ত্র পরিচালক ডিএসইর পর্ষদ সভায় অসন্তুষ্টি জানান। তারা ডিএসইর এমডি নিয়োগে পর্ষদের বিভক্তি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তবে তারা নমিনেশন অ্যান্ড রিমিউনারেশন কমিটির (এনআরসি) সিদ্ধান্তকে সম্মতি জানান। এ বিষয়টিও চিঠিতে বিএসইসিকে জানানো হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার ডিএসইর পর্ষদ সভায় একজন স্বতন্ত্র পরিচালক সানাউল হককে এমডি নিয়োগে পরিস্কার আপত্তি তুলেন। তিনি সভায় বলেন, সানাউল হক কয়েক মাস আগে শেয়ারবাজারের তালিকাভুক্ত আইসিবি থেকে অবসরে গেছেন। এই অবস্থায় তাকে শেয়ারবাজারের প্রাথমিক নিয়ন্ত্রক সংস্থায় নিয়োগ দেওয়াটা স্বার্থের সংঘাত (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) হবে। এমতাবস্থায় তাকে নিয়োগে আইনের কোন ব্যত্যয় হয় কিনা, তা যাছাই-বাছাই করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু তা যাছাই করা হয়নি বলে চিঠিতে জানানো হয়েছে।

ডিএসইর এবারের বিজ্ঞপ্তিতে ২৪ জন আবেদন করলেও মাত্র ৬ জনকে সাক্ষাতকারে ডাকা নিয়েও চিঠিতে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। যেখানে কাজী সানাউল হকের চেয়ে অনেক যোগ্য ব্যাক্তিকে সাক্ষাতকারে ডাকা হয়নি। এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এনআরসি কমিটি লুকোচুরি করেছে। এই এনআরসি কমিটি সাক্ষাতকার শেষে ২ জনের সংক্ষিপ্ত তালিকা করলেও শুরুতে কাজী সানাউল হককে আজকে ডিএসইতে ডাকা হয়েছিল। তবে বিতর্কের মুখে পরবর্তীতে তাকে না আসার জন্য জানানো হয়।

প্রায় ৬ মাস ধরে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছাড়া চলছে ডিএসই। এর আগে দুই দফায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েও যোগ্য কাউকে পাওয়া যায়নি। দুই দফায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েও যোগ্য এমডি না পাওয়ায় ডিএসই সময় নিয়ে গত ১০ ডিসেম্বর তৃতীয় দফায় এমডির খোঁজে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এতে আগ্রহী প্রার্থীদেরকে গত ২৪ ডিসেম্বরের মধ্যে জীবনবৃত্তান্তসহ আবেদন পাঠাতে বলা হয়। এতে ২৪ জন আবেদন করেন। এরমধ্য থেকে ৬ জনকে সাক্ষাতকারে ডাকা হয়।

জানা গেছে, চলতি বছরের ১১ জুলাই ডিএসইর এমডি পদ শূন্য হয়। ওই পদ পূরণে নতুন এমডির খোঁজে গত ৭ আগস্ট বিজ্ঞপ্তি দেয় ডিএসই কর্তৃপক্ষ। এতে আগ্রহী প্রার্থীদেরকে ১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আবেদন করতে বলা হয়েছিল। যেখানে ১৬ জন আবেদন করেছিলেন। তবে ওই ১৬ জনের মধ্যে কাউকেই যোগ্য মনে করেনি ডিএসইর পর্ষদ এবং নমিনেশন অ্যান্ড রিমিউনারেশন কমিটি (এনআরসি)। এরপরে গত ৫ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দফায় এমডির খোজেঁ বিজ্ঞপ্তি দেয় ডিএসই। এক্ষেত্রে আবেদন করেছিল ৩ জন। অর্থাৎ দুই দফায় ১৯ জন ডিএসইর এমডি পদে নিয়োগের জন্য আবেদন করেছিল।

দুই দফায় আবেদনকারীদের মধ্য থেকে গত ২ অক্টোবর ৭ জন প্রার্থীকে সাক্ষাতকারের জন্য ডাকা হয়। পরবর্তীতে ৭ জনের মধ্যে ৩ জনকে নিয়ে শর্ট লিস্ট করা হয়। যাদেরকে গত ৬ অক্টোবর ডিএসইর পর্ষদ ডাকে। তবে ওই ৩ জনের মধ্যেও কাউকে চূড়ান্ত নিয়োগের জন্য যোগ্য মনে করেনি পর্ষদ। যাতে যোগ্য এমডির খোঁজে আবারও বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ৬ অক্টোবরের পর্ষদ সভায়। যা গত ১০ ডিসেম্বর প্রকাশ করা হয়।

উল্লেখ্য, ব্যবস্থাপনা থেকে মালিকানা পৃথকীকরণে ডি-মিউচ্যুয়ালাইজেশন স্কিমের পর দ্বিতীয় ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ২০১৬ সালের ২৯ জুন নিয়োগ পান কে এ এম মাজেদুর রহমান। যার মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ১১ জুলাই। তারপর থেকেই পদটি খালি রয়েছে। ডিএসইর প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) আবদুল মতিন পাটোয়ারী বর্তমানে স্টক এক্সচেঞ্জটির ভারপ্রাপ্ত এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/জানুয়ারি ১৪,২০২০)