দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: বার বার উদ্যোগ নেওয়ার পরও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে শেয়ার বাজারে আনা যাচ্ছে না। সর্বশেষ রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংককে শেয়ার বাজারে আনার জন্য ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে তা বাস্তবায়ন হবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ পোষণ করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এর আগেও কয়েকবার এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কিন্তু তা আলোর মুখ দেখেনি।

এর আগে সুনির্দিষ্টভাবে ২৫টি সরকারি কোম্পানিকে শেয়ার বাজারে আনার জন্য সময় বেঁধে দিলেও সে সময় ২৫টি কোম্পানির মধ্যে শুধু শেয়ার বাজারের তালিকাভুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল। এছাড়া রিপিট আইপিও’র মাধ্যমে শেয়ার আপলোড করেছে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)। বাকি কোম্পানিগুলোর শেয়ার কবে নাগাদ বাজারে আসবে তা পরিষ্কার করে বলছে না কেউই।

এই প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, শেয়ার বাজারে এলে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এবং প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহি বাড়বে। ফলে তাদের সুযোগ-সুবিধা কমে যেতে পারে। এ কারণে হয়তো প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা এর বিরোধিতা করছেন।

তবে বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, এক্ষেত্রে মনিটরিং ও নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বাধা কাটিয়ে এসব কোম্পানিকে শেয়ার বাজারে আনা উচিত। এতে বিনিয়োগকারীরা লাভবান হবেন, শেয়ার বাজারের ব্যাপ্তি বাড়বে।

এদিকে সব বাধা কাটিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে শেয়ার বাজারে আনতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সংশ্লিষ্টদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছেন রবিবার (৯ ফেব্রুয়ারি)। ওই বৈঠকে অর্থ সচিব রউফ তালুকদার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব আসাদুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, এসইসির চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী এবং চেয়ারম্যানরা উপস্থিত ছিলেন।

আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বাজারে থাকা রূপালী ব্যাংকের শেয়ারের পরিমাণ বাড়িয়ে ২৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্র নিধারণ করা হয়েছে বৈঠকে। এছাড়াও রাষ্ট্রায়ত্ত অপর চারটি ব্যাংক বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল), অগ্রণী, জনতা এবং সোনালী ব্যাংককে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেয়ার বাজারে নিয়ে আসার যাবতীয় কর্মকাণ্ড কো-অর্ডিনেট করতে আইসিবির (ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ) নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। কমিটিতে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করার কথাও বলা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০১০ সালে সরকারি ২৫টি কোম্পানির শেয়ার বাজারে ছাড়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ২০১০ সালের ১৩ জানুয়ারি সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে সরকারি কোম্পানির ৫১ শতাংশ শেয়ার সরকারের হাতে রেখে বাকি শেয়ার পাবলিকের মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই সময়ে কোম্পানিগুলোকে ২০১০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেয়ার ছাড়তে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়।

কোম্পানিগুলোর মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগের ৪টি, শিল্প মন্ত্রণালয়ের ৫টি, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ৯টি, পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ৩টি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ৪টি কোম্পানি রয়েছে। কোম্পানিগুলোর মধ্যে নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, বাখরাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড, জালালাবাদ গ্যাস সিস্টেম লিমিটেড, বাংলাদেশ টেলি কমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড বা বিটিসিএল, সোনারগাঁও হোটেল, ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, লিকুফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস লিমিটেড বা এলপিজিএল, সিলেট গ্যাস ফিল্ড, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড লিমিটেড, রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড উল্লেখযোগ্য।

এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ২০১৮ সালের ৩০ জুনের মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে শেয়ার ছাড়ার সর্বশেষ সময় বেঁধে দেওয়া হলেও কাজ হয়নি। কমিটিকে এক বছর প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকাণ্ড নিবিড়ভাবে তদারক করার কথাও বলা হয়। এজন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব মুসলিম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেন- পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি, জ্বালানি মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগ ও বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন বা আইসিবির প্রতিনিধি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন, ‘নানা কারণেই এটি হয়নি, এর মানে এই নয় যে- হবে না। কাজ চলছে। হয়ে যাবে।’

তিনি আরও জানান, এই মূহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একমাত্র শেয়ারবাজার ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রের অবস্থা ভালো। আমরা এটির অবস্থাও ভালো করতে চাই।

সূত্র জানান, সরকারি কোম্পানি তিতাস গ্যাসের ২৫ শতাংশ শেয়ার ছাড়া রয়েছে। আরও ১০ শতাংশ ছাড়ার কথা ছিল, কিন্তু তা এখনও হয়নি। শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ, চিটাগং ডকইয়ার্ড, কর্ণফুলী পেপার মিলস লিমিটেড, বাংলাদেশ ইন্স্যুলেটর অ্যান্ড স্যানিটারি ওয়্যার ফ্যাক্টরি লিমিটেডেরও একই অবস্থা। এছাড়া পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির ২০ শতাংশ শেয়ার ছাড়া হলেও আরও ১৫ শতাংশ ছাড়ার বিষয়ে কোনও অগ্রগতি নাই। বিদ্যুৎ খাতের অন্য তিনটি কোম্পানি আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড ও ইলেক্ট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের শেয়ার ছাড়ার কার্যক্রমেও কোনও অগ্রগতি নাই।

এদিকে বেসামরিক বিমান মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ১০ শতাংশ শেয়ার ছাড়ার প্রক্রিয়া থমকে আছে। সোনারগাঁও হোটেলেরও শেয়ার ছাড়ার বিষয়টিরও কোনও অগ্রগতি নাই। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে টেলিটক, বাংলাদেশ কেবল শিল্প লিমিটেড ও টেলিফোন শিল্প সংস্থার শেয়ার ছাড়া কার্যক্রমেও কোনও অগ্রগতি নাই।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শেয়ার বাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ জানিয়েছেন, ‘সরকারের আন্তরিকতার অভাবেই সরকারি কোম্পানিগুলো শেয়ার বাজারে আসছে না। এক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতা ও মনিটরিংও বাড়াতে হবে।’

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/ফেব্রুয়ারি ১৩,২০২০)