দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: আজ ১ জুলাই। শতবর্ষে পা দিল ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পূর্ববঙ্গে উচ্চশিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হলেও সময়ের ব্যবধানে শিক্ষার পাশাপাশি রাজনৈতিক আন্দোলনের সূতিকাগার হয়ে ওঠে এ বিদ্যাপীঠ। বাঙালির স্বাধীন জাতিসত্তার বিকাশ ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রাখে অনন্য অবদান।

বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী প্রতি বছর জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদযাপিত হয়। কিন্তু কভিড-১৯ মহামারীর কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আজ স্বল্পপরিসরে দিবসটি উদযাপিত হবে। এ উপলক্ষে সংক্ষিপ্ত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উপলক্ষে দেয়া শুভেচ্ছাবাণীতে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ৯৯ বছর শেষ করে শতবর্ষে পা দিল আমাদের এ চিরতরুণ প্রতিষ্ঠান। করোনাভাইরাসের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে লোকসমাবেশ এড়িয়ে স্বল্পপরিসরে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আয়োজনে নিঃসন্দেহে আনন্দ, প্রশান্তি ও স্বস্তির ঘাটতি আছে। তবে মুজিব বর্ষের এ অলোকসামান্য কালপর্বে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এবারের বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপক। বঙ্গবন্ধু ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের মাতৃভূমির দুই অন্তহীন প্রেরণার উৎস।

১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইন সভা ‘দ্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট (অ্যাক্ট নং-১৩) ১৯২০’ পাস করে। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই। সে সময় ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত রমনা এলাকায় প্রায় ৬০০ একর জমির ওপর পূর্ববঙ্গ এবং আসাম প্রদেশ সরকারের পরিত্যক্ত ভবন ও ঢাকা কলেজের (বর্তমান কার্জন হল) ভবনগুলোর সমন্বয়ে মনোরম পরিবেশে গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তিনটি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এর যাত্রা হয়। কলা, বিজ্ঞান ও আইন অনুষদের অন্তর্ভুক্ত বিভাগগুলো ছিল সংস্কৃত ও বাংলা, ইংরেজি, শিক্ষা, ইতিহাস, আরবি, ইসলামিক স্টাডিজ, ফারসি ও উর্দু, দর্শন, অর্থনীতি ও রাজনীতি, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিত এবং আইন।

প্রথম শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন বিভাগে মোট ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৮৭৭ এবং শিক্ষক সংখ্যা ছিল মাত্র ৬০। প্রতিষ্ঠালগ্নে শিক্ষক হিসেবে প্রথিতযশা শিক্ষাবিদদের পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পেয়েছে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এফসি টার্নার, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, জিএইচ ল্যাংলি, হরিদাস ভট্টাচার্য, ডব্লিউএ জেনকিন্স, রমেশচন্দ্র মজুমদার, স্যার এএফ রহমান, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত ও জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের মতো শিক্ষক।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অস্থিরতা ও দেশভাগের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রা কিছুটা ব্যাহত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত প্রদেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে আবার উজ্জীবিত হয় মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা । নতুন উদ্যমে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ড শুরু হয়। তত্কালীন পূর্ব বাংলার ৫৫টি কলেজ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ার সুযোগ লাভ করে। ১৯৪৭-৭১ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে পাঁচটি নতুন অনুষদ, ১৬টি নতুন বিভাগ ও চারটি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়।

এদিকে দীর্ঘ পথচলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিধি বেড়েছে বহুগুণ। তবে সে তুলনায় বাড়েনি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা। বিশেষ করে সংখ্যা ও মানের দিক থেকে শিক্ষার্থীদের আবাসন, শ্রেণীকক্ষ ও গ্রন্থাগার সুবিধা খুবই অপ্রতুল। শিক্ষক-শিক্ষার্থী হারও আন্তর্জাতিক মানের নয়। প্রশ্ন রয়েছে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া ও স্বচ্ছতা নিয়ে। সর্বোপরি উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির অর্জনও অনুজ্জ্বল।

বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩টি অনুষদ, ১৩টি ইনস্টিটিউট, ৮৪টি বিভাগ, ৬০টি ব্যুরো ও গবেষণা কেন্দ্র এবং ছাত্র-ছাত্রীদের ১৯টি আবাসিক হল, চারটি হোস্টেল ও ১৩৮টি উপাদানকল্প কলেজ ও ইনস্টিটিউট রয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৪৬ হাজার ১৫০। তাদের পাঠদান ও গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় ২ হাজার ৮ জন শিক্ষক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল এ প্রসঙ্গে বলেন, শতবর্ষের দোরগোড়ায় এসেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিক্ষার্থী সংখ্যা বহু গুণ বাড়লেও সে তুলনায় সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো সম্ভব হয়নি।

শিক্ষার্থীরা আবাসন, শ্রেণীকক্ষ ও গ্রন্থাগার নিয়ে সংকটে রয়েছে। একদিকে শিক্ষকদের মধ্যে যেমন গবেষণায় অনাগ্রহ রয়েছে; অন্যদিকে গবেষণা উপকরণ ও বরাদ্দেও ঘাটতি রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপনকে সামনে রেখে এ ধরনের বেশকিছু চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি, বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই ও বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থী—সবাইকে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে কাজ করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, বিশেষ করে শতবর্ষকে সামনে রেখে একটি বিষয়ে নজর দেয়া দরকার। সেটি হচ্ছে শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে এসেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখনো পূর্ণাঙ্গ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপ পায়নি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিকেল ও এগ্রিকালচার ফ্যাকাল্টি খোলা প্রয়োজন। পাশাপাশি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে এগিয়ে থাকতে ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টিকে আরো সম্প্রসারণ ও মানোন্নয়ন প্রয়োজন। সর্বোপরি মানসম্মত গ্র্যাজুয়েট তৈরি ও উন্নত গবেষণা এবং আন্তর্জাতিক মানের প্রকাশনার মাধ্যমে বৈশ্বিক মানদণ্ডে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করবে—এটাই শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে প্রত্যাশা।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/০১ জুলাই, ২০২০)