দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক উত্থান চলছে। বিনিয়োগবান্ধব পুঁজিবাজার নিশ্চিত করতে ‘ধারাবাহিকতা’ ধরে রাখাই ছিল মূল চ্যালেঞ্জ । এখন পর্যন্ত বাজার বিশ্লেষণে ‘ধারাবাহিক বাজারে’র প্রমাণ মিলছে হাতেনাতে। মঙ্গলবার (১২জানুয়ারি)  ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স  ৫৮০০ পয়েন্ট অতিক্রম করে সূচকটি অবস্থান করছে ৫৮৬১ পয়েন্টে। যা গত তিন  বছরে সর্বোচ্চ। একদিনের ব্যবধানেই সূচকটি বেড়েছে ১৪২ পয়েন্ট। এর আগে ২০১৮ সালের ৯ এপ্রিল ডিএসই প্রধান মূল্য সূচকের অবস্থান ছিল ৫ হাজার ৮৭৯.৪১ পয়েন্ট।  নতুন বছরে ধারাবাহিকভাবেই বাড়ছে সূচকটি। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে  স্বস্তিভাব দেখা যাচ্ছে । 

 

 

 

 

করোনার প্রভাবে সারা পৃথিবীর অর্থনীতিতে টালমাতাল অবস্থা বিরাজ করলেও বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। টানা মূল্যসুচকের উত্থান, রেকর্ড মুলধন, দৈনিক লেনদেনে বাড়বাড়ন্তের জন্য দেশের পুঁজিবাজারে সুবাতাস বইছে।গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসের লেনদেন শেষে ডিএসই’র বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে পুঁজিবাজারের ইতিহাসে সর্বোচ্চ চার লাখ ৭০ হাজার ২৭০ কোটি টাকা।এর মাধ্যমে টানা ছয় সপ্তাহে ডিএসই’র বাজার মূলধন বেড়েছে ৭৯ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা। ডিএসইতেগতসপ্তাহের প্রতি কার্যদিবসে গড়ে লেনদেন হয়েছে এক হাজার ৯৯০ কোটি ২৩ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয় এক হাজার ১৬০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।

পুঁজিবাজারের উত্থানে যে কয়টি ফ্যাক্টর কাজ করছে-

করোনার টিকা:পুঁজিবাজারের এই রমরমা অবস্থার পেছনে বেশ কিছু ফ্যাক্টর কাজ করছে। তবে ১২ জানুয়ারী পর্যন্ত বাজারে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে করোনা ভাইরাসের টিকার আমদানির বিষয়টি। দেশের প্রধান ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকোফার্মাসিউটিক্যালস করোনার টিকা আমদানির সব প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে ফেলেছে। সব ঠিক থাকলে বেক্সিমকো আগামী ২৫ জানুয়ারির মধ্যে দেশে আনছেভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার এই টিকা। এর প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে। বুধবার কোম্পানিটির শেয়ার সর্বোচ্চ২০৮ টাকায় লেনদেন হয়েছে।সূচক বৃদ্ধিতেকোম্পানিটিরভূমিকা১৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এর প্রভাবপড়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত অন্য‍ ঔষধপ্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানস্কয়ার ফার্মার শেয়ারেও।কোম্পানির শেয়ার দর বেড়ে সর্বশেষ২৩১ টাকায় লেনদেন হয়েছে। সূচক বৃদ্ধিতে ১৩ দশমিক ৯২ শতাংশ ভূমিকা রেখেছে কোম্পানিটি।

অলস টাকা পুঁজিবাজারে আনতে বিনিয়োগ নীতিমালা:শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বিভিন্ন কোম্পানিতে শেয়ারহোল্ডারদের অদাবিকৃত অলস পড়ে থাকা ২১ হাজার কোটি টাকা শেয়ারবাজারের উন্নয়নে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জে কমিশন (বিএসইসি)। এজন্য একটি বিনিয়োগ নীতিমালা প্রণয়ন করতে যাচ্ছে কমিশন।সূত্রমতে, নীতিমালার আওতায় ‘ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবলিস্টমেন্ট ফান্ড অব বিএসইসি’ নামে একটি ফান্ড গঠন করবে কমিশন। ফান্ডের প্রাথমিক মূলধন হবে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা ।ফান্ড পরিচালনায় ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি করা হবে। কমিটিতে বিএসইসি থেকে চার জন,ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) ,সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) ও সেন্ট্রাল কাউন্টারপার্টি বাংলাদেশ লিমিটেডে (সিসিবিএল) থেকে একজন করে প্রতিনিধি থাকবে । তবে কমিটি গঠনে প্রতিনিধি অন্তর্ভূক্তিতে সিদ্ধান্ত বদলও হতে পারে। কমিশনের এই বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত পুঁজিবাজারে প্রভাব ফেলেছে।

বিনিয়োগ সুরক্ষা তহবিল : বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় ‘ইনভেস্টর প্রটেকশন ফান্ড বা বিনিয়োগকারী সুরক্ষা তহবিল’ গঠন করার ঘোষণায় বাজারে চাঙ্গা প্রবণতা তৈরী হয়েছে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকাতালিকাভুক্ত কোম্পানির লভ্যাংশের টাকা কিংবা ওয়ারিশ দাবিহীন টাকার সমন্বয়ে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার সুরক্ষা তহবিল গঠিত হচ্ছে। এরই মধ্যে পুঁজিবাজারে যেসব তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারের নগদ লভ্যাংশ ও বোনাস দীর্ঘদিন ধরে বিতরণ হচ্ছেনা সেসব শেয়ারের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া প্রায় শেষ হয়েছে। এর প্রভাব পুঁজিবাজারে পড়েছে।

আইপিও অনুমোদনে গতি: ২০১৯ সালেমাত্র চার কোম্পানি আইপিও প্রক্রিয়ায় ২১৫ কোটি টাকার মূলধন সংগ্রহ করেছিল। নতুন কমিশন আসার পর মাত্র ছয় মাসে ১৩ কোম্পানি আইপিও অনুমোদন পেয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় কোম্পানিগুরো এক হাজার ৩০০ কোটি টাকারও বেশি মূলধন সংগ্রহ করেছে বা সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় আছে। দেশের নিবন্ধিত কোম্পানিগুলো পুঁজির প্রয়োজনে যাতে পুঁজিবাজারমুখী হয়, সেজন্য বিদ্যমান আইনে বড় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। নতুন আইনে আইপিও আবেদন করে অনুমোদন পেতে অপেক্ষা করতে হবে বড়জোর তিন মাস। এ বিষয়ে বিএসইসির চেয়ারম্যান বলেন, ‘এরই মধ্যে আমরা অনেকগুলো আইপিওর অনুমোদন দিয়েছি। এতে বাজারে কোন ধরণের নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি।

পুঁজিবাজারে ওয়ালটন, রবি: ওয়ালটন, রবি আজিয়াটার মতো কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসায় পুঁজিবাজার চাঙ্গা হয়েছে। ২০০৯ সালে গ্রামীণফোনের অভিষেকের দিনে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সে সময়কার প্রধান সূচকটি ৭৬৫ পয়েন্ট বেড়েছিল। গত ২৪ ডিসেম্বর ( বৃহস্পতিবার) রবি আজিয়াটার অভিষেকের দিনে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স বেড়েছে ৮৫ পয়েন্ট বা প্রায় পৌনে ২ শতাংশ। কোম্পানিটির শেয়ার সর্বশেষ (১২ জানুয়ারি)৬৩ টাকা ২০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে। এদিকে, ১২ জানুয়ারি ওয়ালটনের শেয়ারের দাম বেড়ে দাড়িয়েছে এক হাজার ৯৫ টাকায়।

ব্যাংকের সুদের হার কম: অন্যদিকে, বর্তমানে ব্যাংকের সুদের হার কম। বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ব্যাংকে টাকা রেখে জমাকারীরা আদতে কোন মুনাফা ঘরে আনতে পারছেন না। এজন্য বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকের চেয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছেন বেশি।

স্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা: বর্তমান স্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা শেয়ারবাজারে প্রভাব ফেলছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে পুঁজিবাজার অস্থির হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে বিধায় বিনিয়োগকারীরা ভরসা পাচ্ছেন।

এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘‘পুঁজিবাজার সঠিক ট্র‌্যাকে আছে। এর পেছনে নতুন কমিশন বড় ভূমিকা পালন করছে। তাছাড়া, বাজার সংশ্লিষ্ট যারা আছেন তারাও কাজ করছেন। বিনিয়োগকারীরা আগের চেয়ে সচেতন হয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন- তাদেরকে আরও জেনেবুঝে বিনিয়োগ করতে হবে। সেটা না হলে পুঁজিবাজার বিপরীত দিকে মোড় নিতে পারে” ।

সবচেয়ে আশার কথা হলো এই স্থিতিশীল বাজার সহসাই অস্থিতিশীল হওয়ার কোন কারণ দেখছেন না বাজার বিশ্লেষকরা। এর ফলে পুঁজিবাজারের উত্থানের গল্প লিখেই ব্যস্ত সময় পার করতে হতে পারে বাজার সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদেরকে।

দ্য রিপোর্ট/এএস/১২ জানুয়ারী,২০২১