আব্দুল্লাহ শুভ,দ্য রিপোর্ট: পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষার দোহাই দিয়ে গড়ে ওঠা  কিছু সংগঠনের বিরুদ্ধে পুঁজিবাজারকে অস্থির করে তোলার অভিযোগ উঠেছে। এসব অনিবন্ধিত  সংগঠন একদিকে নানান সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে পুঁজিবাজারকে উত্তপ্ত করছে, অন্যদিকে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে চাঁদা দাবিসহ নানা অন্যায্য কাজের সাথেও জড়িত হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।বিশ্লেষকরাবলছেন, পুঁজিবাজার সম্পর্কে ভালভাবে  না জানা লোকদের নিয়ে গঠিত এসব সংগঠন অহেতুক উত্তেজনা ছড়াচ্ছেন এবং বাজারে এর প্রভাব পড়ছে।

 

 

যেসব সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তাদের মধ্যে সবার আগে রয়েছে ’পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদে’র নাম। নানা সময় এই সংগঠনের বিরুদ্ধে অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে । সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে গেমলিং সবকিছু করছেন, যা বাজারকে অস্থির করে তুলছে।

জানা যায়, ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে ধ্বসের পরবর্তী সময়ে বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ‘বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ’ নামক একটি সংগঠন গঠিত হয়। সঙ্কট মোকাবেলায় একই ধরণের আরও কয়েকটি সংগঠন গড়ে উঠে সেসময়। বাজার পতনে পুঁজিহারা,দিশেহারা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আশার ভরসার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় এসব সংগঠন।একদিকে দরপতন অন্যদিকে মিছিল বিক্ষোভ আগুন।পুলিশের অভিযান। রাজধানীর মতিঝিল পাড়া কেঁপে উঠতো এসব সংগঠনের নেতা ও সমর্থকদের শ্লোগানে শ্লোগানে।কোনো ব্রোকারেজ হাউজ ফোর্সড সেল করলে সঙ্গে সঙ্গে সেসব হাউজে তা বন্ধের জন্য তৎপর হয়ে উঠতো সংগঠনটি। শেয়ারবাজারে সেই অস্থির সময়ে দিনের পর দিন মধুমিতা সিনেমা হল, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের কার্যালয় কিংবা দিলকুশার এসইসির কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়ে অবস্থান ধর্মঘট পালন করেছে সংগঠনগুলো। তৎকালীন এসইসির যেকোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে মতামত দিতো তারা। যা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের অনকূলে ভূমিকা রাখতো। এসব কারণে মামলারও শিকার হয়েছেন এই সংগঠনটির নেতারা।

কিন্তু বেশী দিন স্থায়ী হয়নি সংগঠনগুলোর ইতিবাচক কার্যক্রম। ধীরেধীরে নেতাদের মধ্যে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। বিভক্ত হয়ে পড়ে সংগঠনগুলো। বিনিয়োগকারীদেরকে ভুল পথে পরিচালিত করার পাশাপাশি বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে চাঁদাবাজি শুরু করেন এর শীর্ষ নেতারা। এদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ জমা হতে থাকে। পুঁজি হারানো বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার দাবিই একসময় সংগঠনগুলোর নিজ স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। এদের বিরুদ্ধে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে চাওয়া কোন কোম্পানির কাছে মোটা অংকের টাকা দাবি করার অভিযোগ বিস্তর। বিভিন্ন অডিট ফার্ম বা অডিটরের মাধ্যমে থেকে কোম্পানীর আর্থিক প্রতিবেদনের ছোটখাটো ত্রুটি খুঁজে বের করার এক অভিনব কৌশল বের করে সংগঠনের নেতারা। এরপর কোম্পানির কাছে মোটা অংকের টাকা দাবি করে। টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে সংগঠনটির নেতারা সে কোম্পানিকে বাজারে আসার পথ বন্ধ করে দিতে কমিশন বরাবর চিঠি দেওয়াসহ সকল চেষ্টাই অব্যাহত রাখে। এমনকি আদালতের মামলা করে দেওয়ার হুঁমকিও দিতে থাকেন। টাকা না দেওয়া পর্যন্ত এই চেষ্টা অব্যাহত থাকে। এছাড়া টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভা বা এজিএম পাস করে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে নেয় সংগঠনগুলোর নেতারা। শেয়ারবাজারে ধ্বসের পূর্বেও এসব সংগঠনের কোনো কোনো নেতা এ ধরণের অনৈতিক কাজে জড়িত ছিলেন বলেও জানা যায়।

এসব সংগঠনের নেই কোনো গঠনতন্ত্র। বার্ষিক সাধারণ সভা বা নিয়মিত কমিটি গঠন হয় না। একই নেতা দীর্ঘ দিন ধরে পদ আটকে রয়েছেন। সদস্যদেরও কোন খোঁজ নেই। কোথাও কোনো নিবন্ধন হয়েছে বলে জানা যায়নি।

সম্প্রতি দীর্ঘদিন ধরে ফ্লোর প্রাইজের গন্ডিতে আটকে লেনদেনে অংশ নিতে না পারা কোম্পানিগুলোর মধ্যে ৬৬ টি কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার করে কমিশন। কমিশনের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে সংগঠনটি প্রতিবাদ করে। সংগঠনের একশীর্ষ নেতা শেয়ার বাজারের বড় স্টেকহোল্ডার, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বা বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোরগুলোর সংগঠন নিয়ে অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করে। যা সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করলে বিতর্ক তৈরি হয়। পরে দেখা যায়(১০ এপ্রিল) কমিশন কোম্পানিগুলোর বিষয়ে নতুন সিদ্ধান্ত নেয়। শনিবার বিএসইসি এই সংক্রান্ত একটি আদেশ জারি করে কমিশন।

নতুন অফিস আদেশে বলা হয়, আলোচিত ৬৬টি কোম্পানির শেয়ার এক দিনে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ কমতে পারবে। তবে নতুন আদেশে, দাম বাড়ার ক্ষেত্রে আগের মতোই ১০ শতাংশ সীমা বহাল রাখা হয়। কমিশনের এই সিদ্ধান্ত বদলের পেছনে সংগঠনটির প্রভাব রয়েছে বলে জানা যায়।

অভিযোগ আছে, ২০১৮ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত আমান কটন ফাইবার্সের কাছে আটলাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক।কোম্পানিটি তাদেরকে চাঁদা না দেওয়ায় একই বছরের ১৮ মার্চ কোম্পানির আইপিও বাতিল চেয়ে কমিশন বরাবর চিঠি দেয় সংগঠনটি।

পরবর্তীতে আরও একটি অনুমোদন পাওয়া কোম্পানির কাছে বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ টাকা দাবি করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে কোম্পানি চাঁদা না দিলে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক ওই কোম্পানির আইপিও বাতিলের জন্য কমিশন বরাবর চিঠি দেয়। যদিও আব্দুর রাজ্জাক চাঁদা চাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন –কাট অব প্রাইজ বেশিহওয়ায় কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছিলাম। পরে কমিশন তদন্ত করে কোম্পানিগুলোর কোন দোষ খুঁজে না পাওয়ায়তদন্ত সাপেক্ষে হেয়ারিংয়ের মাধ্যমে আবেদনটি বাতিল করে দেয়।

এ বিষয়ে ’পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক দ্য রিপোর্টকে বলেন, আমাদের সংগঠনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে সেগুলোর সবগুলোই মিথ্যা । আমরা এসব অভিযোগের বিরুদ্ধে নানা সময় সরব হয়েছি। যারা আমাদের বিরুদ্ধে এসব করেছে তারাই দুর্নীতিবাজ ।তারা চায়না বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এগিয়ে যাক । কিন্তু এই সংগঠনটির প্রতিই কেন নানান দিক থেকে বারবার অভিযোগ উঠছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- আমরা বেশি সোচ্চার (দুর্নীতির বিরুদ্ধে) তাই আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বেশি হচ্ছে। টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন কোম্পানির এজিএম পাশ করায় আপনার সংগঠন কি লিপ্ত – এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার সংগঠন এসব কাজে লিপ্ত নয়। এসব অভিয়োগ মিথ্যা’।

এ বিষয়ে সংগঠনটির সভাপতি একেএম মিজান উর রশিদ দ্য রিপোর্টকে বলেন- করোনার এই সময় ৬৬ টি কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীদের সাথে প্রহসন ছাড়া আরকিছু নয়। এই সিদ্ধান্ত বাজারকে অস্থিতিশীল করেছে। তাই আমরা কমিশনের সাথে বসেছিলাম।কমিশনের নতুন অফিস আদেশে সংগঠনটি সন্তুষ্ট নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন –‘দিনে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ কমতে পারে’ এমন সিদ্ধান্ত মূলত শুভঙ্করের ফাঁকি । এমন ঘোষণা থাকলেও কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর একদিনে খুব সহজেই ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। সংগঠনটির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন –যারা এসব কথা বলে তারা চায়না পুঁজিবাজারে জবাবদিহিতা থাকুক। তারা চায়, সে কেউ পুঁজিবাজারে লুটপাট করুক, বিনিয়োগকারীদেরকে সর্বশান্ত করার চিন্তা থেকেই তারা এসব কথা বলে’।

অন্যদিকে, ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (ICB) কেন্দ্রিক এক নেতার বিরুদ্ধে নানা সময়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ‘পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী সম্মিলিত জাতীয় ঐক্য’নামক একটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তার এবং তার সংগঠনের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন সময়ে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে। পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের হুমকি দিয়ে বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদা উত্তোলনের অভিযোগ আছে।

এছাড়া, বাংলাদেশ শেয়ার ইনভেষ্টর্স এসোসিয়েশন, পুঁজিবাজার বিনিযোগকারী কল্যান পরিষদসহ আরও বেশ কয়েকটি সংগঠনও চাঁদাবাজির সাথে জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার নামে যে কয়েকটি সংগঠন গঠিত হয়েছে তার অধিকাংশই নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদেরকে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের নানান অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করতেই যেন তাদের উদ্ভব।

অথচ, ইউরোপ, আমেরিকা বা পাশের দেশে ভারতের দিকে তাকালেও দেখা যায়- বিনিয়োগবান্ধব নানা সংগঠন পুঁজিবাজারের বিকাশে ভূমিকা রাখছে। ভারতের ‘তামিলনাডু ইনভেস্টর্স এসোসিয়েশন’বা ’বোম্বে শেয়ারহোল্ডার্স এসোসিয়েশন’কিংবা গুজরাট ইনভেস্টর্স এন্ড এসোসিয়েশনের দিকে যদি তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনে তারা সুসংগঠিতভাবে কাজ করছে। বিনিয়োগকারীরা যেন ভরসার যায়গা খুঁজে পাচ্ছে। অন্যদিকে, কানাডা ভিত্তিক, ‘ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী সুরক্ষা সংঘ’ বা (Small Investor Protection Association) (SIPA), যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক `বিনিয়োগকারী সুরক্ষা ট্রাষ্ট (Investor Protection Trust) কিংবা ইংল্যান্ডভিত্তিক ’বিনিয়োগকারী ফোরাম (The Investor Forum ) সে দেশের বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দিতে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করে আসছে। এজন্য এসব দেশের পুঁজিবাজার এবং পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত কোম্পানিগুলোর উপর বিনিয়োগকারীদের নিয়ন্ত্রণ থাকে। কোম্পানিগুলোকে বিনিয়োগকারীদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকে।

এসব সংগঠনগুলোর পরিচালনার বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটি এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন(বিএসইসি)কোন দিক নির্দেশনা বা ব্যবস্থা নিয়েছে কিনা এ প্রশ্নের জবাবে এসইসি’র নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কোন মন্তব্য করতে পারবো না’।

দ্য রিপোর্ট/এএস/১৬ এপ্রিল,২০২১