তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু, দ্য রিপোর্ট : বাংলাদেশের পুঁজিবাজার যখন এক অস্থির সময় পার করছে তখন এ বাজার নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এক চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ চিঠিতে অন্তত ৯টি ভুল রয়েছে বলে বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এর ফলে আরো অস্থির হয়ে পড়েছে বাজার। বিনিয়োগকারীরা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছেন। 

গত ৩০ নভেম্বর বাংলদেশ ব্যাংক ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘বাংলাদেশে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন’ (বিএসইসি)- এর মধ্যে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকের আলোচ্য বিষয় নিয়ে ১ ডিসেম্বর বিভিন্ন গণমাধ্যমে চিঠি পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। বিতর্কের সূচনা ওই চিঠি থেকেই।

বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করেছেন, প্রথম ভুল হলো- দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকের বিষয় গণমাধ্যমে প্রকাশ করা। এটা সমীচীন হয়নি।

দ্বিতীয় ভুল হলো- ২০১২ সালের নভেম্বরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত নির্দেশনা অনুযায়ী, পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃপক্ষকে বিএসইসি’র সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। গণমাধ্যমে পাঠানো এ চিঠির বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিএসইসি’র সঙ্গে কোনো আলোচনা করেছে বলে জানা যায়নি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠির প্রথম প্যারার চতুর্থ লাইনে ‘ সৃষ্ট জটিলতা ‘ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। যা সমীচীন নয়। কেননা, ‘ইন্টারন্যাশনাল একাউন্টিং স্টান্ডার্ড’ (আইএএস)-এ এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ফ্রি রিজার্ভ থাকলে যে কোনো লভ্যাংশ দেওয়া যেতে পারে। সংশ্লিষ্ট বছরে লোকসান হওয়া সত্ত্বেও লভ্যাংশ দেওয়া যাবে। এটা ছিলো তৃতীয় ভুল।

চতুর্থ ভুলটি করা হয়েছে চিঠির দ্বিতীয় প্যারার চতুর্থ লাইনে। সেখানে উল্লেখিত ‘আইনসম্মত নয়’ বলে যা উল্লেখ করা হয়েছে, যেটি সঠিক নয়। কেননা, ১৯৬৯ সালের অর্ডিন্যান্স-এর ২(সি)(সি) ধারা অনুযায়ী. বিএসইসি পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট যে কোনো আইন প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করতে পারবে, সেটা অন্য কোনো আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও। সুতরাং ‘আইনসম্মত নয়’ বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের দাবি বা বক্তব্য সঠিক নয়।

বাংলাদেশে ব্যাংকের চিঠির তৃতীয় প্যারার তৃতীয় লাইনে বলা হয়েছে বিএসইসি-কে ‘স্পষ্টীকরণ’ করা হয়। একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি আরেকটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ ধরণের ভাষার প্রয়োগ সৌজন্যসূচক নয়; এটি বিএসইসি’র কর্মকর্তাদের অজ্ঞতাকেই ইঙ্গিত করে। বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এ ধরনের ভাষার ব্যবহারে বিএসইসি’র প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থার বিষয়ে ভুল বার্তা দিতে পারে। যা ছিল পঞ্চম ভুল।

৩০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে অংশ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিএসইসি-কে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বৈঠক শেষে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানানো যেতো।বৈঠক শেষেওইদিন সন্ধ্যায় বিএসইসি’র কমিশনার সামছুদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমের কাছে বলেছেন, ‘আলোচনা হয়েছে। আরো হবে। একটা সমাধান বেরিয়ে আসবে।’ এই বক্তব্যকে খন্ডন করতে গিয়েই কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই চিঠি দিয়েছে।এর ফলে বাজারে ভুল বার্তা গেছে। দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব সামনে এসেছে। ষষ্ট ভুল ছিলো এটি। এতে পুঁজিবাজার আরো অস্থির হয়ে উঠেছে।

দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপরেও ছিলো অর্থ মন্ত্রণালয়। কোনো কারণে মত-পার্থক্য দেখা দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসি অর্থ মন্ত্রণালয়ের শরণাপন্ন হতে পারতো। তাহলে স্পর্শকাতর পুঁজিবাজার ভুল বার্তা থেকে রক্ষা পেতে পারতো। পুঁজিবাজার সংক্রান্ত চিঠিটি সরাসরি গণমাধ্যমকে দেওয়া হয়েছে। যার কোনো অনুলিপি বা কপি বিএসইসি বা অর্থ মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হয়নি। এটি ছিলো চিঠি প্রদানের প্রক্রিয়াগত ত্রুটি। এটি ছিলো সপ্তম ভুল।

এছাড়া চিঠির ভাষায় অপেশাদারিত্ব ও শিষ্টাচারে ঘাটতি লক্ষ্যণীয়। চতুর্থ প্যারার শেষ লাইনে বিএসইসি’র বরাত দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে কথা বলা হয়েছে -তা সঠিক নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি আরেকটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার আস্থার ঘাটতি বা সমন্বয়হীনতা বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

‘বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এসোসিয়েশন’-এর সভাপতি ছায়েদুর রহমান দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টি ফোর ডটকমকে বলেন, বিএসইসি’র কমিশনার সামছুদ্দিন আহমেদ সেদিন (৩০ নভেম্বরের) মিটিং থেকে বেরিয়ে বলেছেন যে, আলোচনা হয়েছে। আরো হবে। একটা সমাধান বেরিয়ে আসবে। তাতে এ ধরনের চিঠি দেওয়ার কী হলো! এটা আমাদের হতাশ করেছে। এটা নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়। এটা এভাবে পাবলিক হওয়া ঠিক ছিল না। তিনি আরো বলেন, পরষ্পরের বিরুদ্ধে এভাবে প্রচারণা শ্র্রদ্ধাবোধের অভাবকে প্রকট করে তোলে। যে যার আইন অনুযায়ী কাজ করবে। এটি বাইরে বলে বেড়ানোর বিষয় নয়। বিনিয়োগকারীরা আস্থাহীন হয়ে পড়েন। এ ধরণের চিঠির ভুলের প্রভাব বাজারকে আরো অস্থির করে তোলে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ব্রোকারেজ এসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি শরীফ আনোয়ার হোসেন দ্য রিপোর্টকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিটা পড়েছি। তাতে ভাষার কোনো সৌন্দর্য ছিল না। পারস্পরিক সৌজন্যবোধের ব্যাপক ঘাটতি ছিলো।

পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগসীমা প্রতিষ্ঠানের ইকুইটির ২৫ শতাংশের যে নিয়ম রয়েছে তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দরকার। শেয়ার ক্রয়কালীন দর ধরে বিনিয়োগসীমা হবে, না-কী বাজারদর ধরে তা নির্ধারণ হবে -তা স্পষ্ট করা উচিত। এ বিষয় গ্লোবাল স্টান্ডার্ড রয়েছে। সেটা অনুসরণ করা যেতে পারে। এটা যদি পার্লামেন্টের আইন দ্বারা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে তবে সে আইন সংশোধন করতে হবে। আর যদি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়ে থাকে, তবে এটি পরিবর্তন বা এর ব্যাখা দিতে হবে। তিনি বলেন এ নিয়ে দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে টাগ অব ওয়ার দরকার কি? অর্থ মন্ত্রণালয় তো রয়েছে। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অবশ্য আগামী ৭ ডিসেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের বৈঠক হবে বলে খবর বেরিয়েছে। তাতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সঞ্চার হয়েছে এবং এ কারণে গত বৃহষ্পতিবারের বাজার ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে বলে মন্তব্য করেন আবু আহমেদ।

এ বিষয়ে বিএসইস‘র মতামত জানতে চাইলে সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম কোনো মন্তব্য করতে রাজী হন নি।

অন্যদিকে চিঠি প্রদানকারী বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র ও মহাব্যবস্থাপক আবুল কালাম আজাদ-কে ফোন করা হলে তিনি লাইন কেটে দেন। পরবর্তীতে এসএমএস পাাঠিয়ে এনিয়ে কথা বলার ইচ্ছা পোষণ করলেও তিনি আর যোগাযোগ করেন নি।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/ ০২ ডিসেম্বর, ২০২১)