দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : ‘১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাত, ঘড়ির কাঁটায় আনুমানিক সময় ১২টা। হঠাৎ চারদিকে গোলাগুলি, ব্রাশ ফায়ার আর বোমার ভয়ঙ্কর শব্দ। শিববাড়ি এলাকার দোতলা বাসার বারান্দায় বাবার (মধুসূদন দে) সঙ্গে দাঁড়িয়ে দেখি জগন্নাথ হলের চতুর্দিক ঘিরে একটানা গুলি হচ্ছে।’

‘সকাল ৭টার দিকে পাকবাহিনীর ১৪-১৫ জনের একটি দল (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল মাঠের পাশে) শিববাড়ী এলাকায় ঢোকে। চোখের সামনেই মা যোগমায়া, সদ্যবিবাহিত বড় ভাই রণজিত ও ভাবী রীনা রাণীকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে মৃতদেহগুলো মেঝের ওপর রেখে যায়।’

‘হানাদারদের গুলিতে বোন রুনা লুটিয়ে পড়ে। ব্রাশ ফায়ারে বাবাও আহত হন। ঘরের মেঝে, দেয়াল যে দিকে তাকাই সবখানে শুধু ছোপ ছোপ রক্ত।’

২৫ মার্চ কালরাতে হানাদার বাহিনীর হাতে আপনজনদের হারানোর এমন করুণ দৃশ্য দ্য রিপোর্টকে বর্ণনা করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের প্রতিষ্ঠাতা মধুসূদন দে’র (মধু দা) ছেলে অরুণ কুমার দে। শিশু হওয়াতে সে দিন প্রাণে রক্ষা পান তিনি।

মধুর ক্যান্টিনে অরুণ দে

৪২ বছর আগে চোখের সামনে নৃশংসভাবে প্রিয় মানুষদের হারানোর কথা বলতে বলতে নিজের অজান্তে চোখ ছল ছল করে অরুণ কুমারের। ছল ছল চোখে তারপরও অকপটে বলে যান ইতিহাসের কথা, বর্ণনা করেন কালরাতের আরও কিছু করুণ কাহিনী।

অরুণ বলেন, ‘২৬ মার্চ সকাল ৮টার দিকে আহত বাবাকে নিয়ে যাওয়া হয় জগন্নাথ হলের মাঠে। একই সময়ে পাশের বাংলো থেকে দর্শন বিভাগের অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেবকেও (জিসি দেব) গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নিয়ে যায় হানাদাররা। এরপর ১৪-১৫ জনের লাইনে দাঁড় করানো হয় আমার বাবা ও স্যার জিসি দেবকে। ব্রাশ ফায়ারে নির্মমভাবে লাইনের সবাইকে হত্যা করা হয়। শহীদদের সবারই শেষ ঠাঁই মেলে জগন্নাথ হলের গণসমাধিতে।’

এদিকে ঘরে অন্য নিথর দেহগুলো সামনে নিয়ে পরদিন সকাল পর্যন্ত বসে থাকেন ১১ বছরের অরুণ। চোখে-মুখে তার কেবল অজানা আতঙ্ক। এভাবেই কেটে যায় ২৬ মার্চের দুপুর, বিকেল, রাত। এমনকি ২৭ মার্চ সকাল। তবে ২৭ মার্চের সকালটা ছিল একটু ভিন্ন। পশ্চিম পাকিস্তানি সরকার কারফিউ শিথিলের ঘোষণা দেয়।

এরই ফাঁকে আসেন মধুসূদনের এক বন্ধু। মা, ভাই, ভাবীর দেহগুলো ওভাবে রেখেই বেঁচে যাওয়া অরুণকে নিয়ে বের হন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে।

এক মাস পরের ঘটনা। গ্রামের বাড়িতে চিকিৎসা শেষে অরুণ ও তার ছোট ভাইবোনের আশ্রয় হয় ভারতের শরণার্থী ক্যাম্পে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা আবার ফিরে আসেন প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে।

(দ্য রিপোর্ট/এনসি/একে/এইচএসএম/সা/মার্চ ২৫, ২০১৪)