জাহিদ বিপ্লব: আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে না বিএনপি। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দলের একাধিক শীর্ষ নেতা দ্য রিপোর্টকে এ তথ্য জানান।

সবদলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক মহলের একধরণের চাপ রয়েছে। সেটা আমলে নিয়েই বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সে জন্য সরকার বিরোধী সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ইতোমধ্যে সংলাপে বসেছে দলটি। তাতে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক শীর্ষনেতা নেতা বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের টোপে পড়লে আবারও ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। আন্তর্জাতিক মহলও বিএনপির এই অবস্থানের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের উদারহণ টেনে ওই শীর্ষ নেতা বলেন আমরা বলেছি দলীয় সরকারের অধীনে বাংলাদেশে কখনই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।

এ কথারই প্রতিধ্বনি পাওয়া গেছে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের কণ্ঠে। মঙ্গলবার (৩১ মে) জাতীয় প্রেসক্লাবের একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্র দেখতে চায় বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশে নবনিযুক্ত এই মার্কিন কূটনীতিক।

পিটার হাস বলেন, অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন বাস্তবায়নের দায়িত্ব পুরোটাই বাংলাদেশের। বাংলাদেশের জনগণ যাতে অবাধে তাদের নেতা নির্বাচন করতে পারেন সে বিষয়ে সরকার পদক্ষেপ নেবে বলেও আশাব্যক্ত করেন এই রাষ্ট্রদূত।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অবস্থানের সমর্থক মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এই বক্তব্য। বিশ্লেষকদের মতে বেশ আগে থেকেই ভারতের চোখ দিয়ে বাংলাদেশকে দেখতে চাইছে না যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ভারতের ভূমিকায় মার্কিন যুক্তরাষ্টের অসন্তুষ্টির প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশের রাজনীতিতেও। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকেই ক্ষমতায় দেখতে চাওয়া ভারতীয় নীতির সাথে এবার আর সুর নাও মেলাতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।

এবিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ দ্য রিপোর্টকে বলেন, বিএনপি অংশ না নিলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। বহিঃবিশ্ব থেকেও দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। তার মতে অতীতের অভিজ্ঞতায় বলা যায়, সবদলের অংশগ্রহণে নির্বাচন না হলে দেশে অস্থিরতা বিরাজ করবে। সকলের সমঝোতায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে গণতন্ত্র নির্বাসিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলেও মত এই রাজনৈতিক বিশ্লেষকের।

২০১৯ সালের ১৬ জানুয়ারি এ সরকারের অধীনে কোন নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দেয় বিএনপি। এরপর থেকে স্থানীয় নির্বাচনসহ আর কোন নির্বাচনে অংশ নেয়নি দলটি। পরে বিএনপির সিনিয়র নেতারা খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করেন। দলীয় সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার বিষয়ে দলটির চেয়ারপারসন মত দেন বলে নেতারা জানান। এ সিদ্ধান্তের প্রতিফলন দেখা গেছে পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে।

সব রাজনৈতিক দলগুলোকে আগামী দুই এক মাসের মধ্যে সংলাপে ডাকা হবে বলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল যে কথা বলেছেন তাতে গুরুত্ব দিচ্ছে না বিএনপি। তাই এ সংলাপে যাবে না দলটি। বিএনপির প্রধান দাবি- নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। এছাড়া কোনো নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নেবে না তারা।

বিএনপির শীর্ষনেতাদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, আন্দোলনকেই প্রাধান্য দিচ্ছে তারা। নেতাদের মতে রাজপথ ছাড়া বিকল্প নেই। শাসকগোষ্ঠী জনগণের এ দাবি মানবে না।তবে মানতে বাধ্য করা হবে।

নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচন হয়ে যাবে কী না - এমন প্রশ্নের জবাবে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক অধ্যাপক বদিউল আলম মজুমদার দ্য রিপোর্টকে বলেন, দেশে গণতন্ত্র এমনিতেই প্রশ্নবিদ্ধ। বিএনপি যদি আগামী নির্বাচনে অংশ না নেয় তাহলে গণতন্ত্র থাকবে না। আবার একতরফা নির্বাচন হলে দেশ অস্থিতিশীল হবার আশংকা রয়েছে। আর এর দায়ভার সরকারকেই নিতে হবে। দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে সরকারের উচিত হবে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

এবিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ দ্য রিপোর্টকে বুধবার বলেন, আওয়ামী লীগ বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে না। নির্বাচনের অনেক দেরি আছে। হানিফের আশা নির্বাচনে সবদলই অংশ নেবে। রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই। শেষ পর্যন্ত বিএনপিও নির্বাচনে অংশ নেবে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী দ্য রিপোর্টকে বলেন, নির্বাচন ও রাজনীতি একটি চ্যালেঞ্জের বিষয়। বঙ্গবন্ধু হত্যা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিলো। আওয়ামী লীগ সবসময় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পছন্দ করে। সব চ্যালেঞ্জই তারা উত্তীর্ণ হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন দেশের জনগণ আওয়ামী লীগের সাথে রয়েছে।

বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা আছে কী-না জানতে চাইলে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন দ্য রিপোর্টকে বলেন ,এমন হওয়ার সম্ভবনা নেই । এই বাম নেতার বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে। তবে, বিএনপি যদি সহিংসতার পথ বেছে নেয় তাহলে রাজপথে প্রতিহত করা হবে বলে মন্তব্য করেন ১৪ দলীয় জোট নেতা রাশেদ খান মেনন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় মঙ্গলবার দ্য রিপোর্টকে বলেন, প্রথম এবং শেষ কথা এই সরকারের অধীনে কোন নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না। তার মতে এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়া আর নিজের পায়ে কুড়াল মারা এক কথা।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বুধবার দ্য রিপোর্টকে বলেন, বর্তমান অবস্থায় নির্বাচনে গিয়ে দলের তৃণমূল নেতাদের মামলা, হয়রানি, জেল-জুলুম, সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করার কোনো অর্থ নেই। ইতোমধ্যে ভোটারদের সমস্ত আস্থা-বিশ্বাস সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে সরকার ও নির্বাচন কমিশন । তাই তাদের অধীনে আগামীতে কোন নির্বাচনেই অংশ নেবে না বিএনপি।

(দ্য রিপোর্ট / টিআইএম/১ জুন ২০২২)