দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: বিতর্কের বিশ্বকাপ' খ্যাত বেলগ্রেড ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিজ ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপ (ডব্লিউইউডিসি) ২০২২–এর ওপেন ফাইনাল জিতে বাংলাদেশের জন্য সুনাম বয়ে এনেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ শিক্ষার্থী সৌরদীপ পাল ও সাজিদ আসবাত খন্দকার। প্রতিযোগিতায় 'ব্র্যাক এ' নামের দলটির প্রতিনিধিত্ব করেছেন তারা। ২ জনই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়ছেন।

গত ২৭ জুলাই সন্ধ্যায় প্রতিযোগিতার ফাইনাল পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে গত বছরের মতো এবারও পুরো প্রতিযোগিতা অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। 'ব্র্যাক এ' নামের দলটিই বাংলাদেশের প্রথম দল, যারা এই বর্ণাঢ্য প্রতিযোগিতায় প্রথমবারের মতো ফাইনালে উঠে।

যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড, যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির মতো বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি দল অংশ নেয়। তবে ব্র্যাক ছাড়া বাংলাদেশের কোনো দল প্রতিযোগিতার প্রথম পর্ব পেরোতে পারেনি।

এক নজরে 'বিতর্কের বিশ্বকাপ'

ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিজ ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়। একেক বছর একেক দেশ আয়োজন করে। প্রতিবারই বিশ্বের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে শুরু করে ছোট-বড় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মোট ৪০০টি দল অংশ নেয়। প্রতিটি দলে ২ জন করে বিতার্কিক থাকেন। বিতর্কের প্রতিটি পর্বে ৪টি দল নিজেদের মধ্যে লড়াই করে। একজন বিতার্কিক ৪ বার চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিতে পারেন।

প্রতিবার প্রতিযোগীরা সশরীরে চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেন। তবে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে গত বছরের মতো এবারও অনলাইনে চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হয়েছে।


সাজিদ বলেন, 'এর আগে আমরা ৩ বার সশরীরে বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিলাম। তখন আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে পড়তাম এবং প্রতিযোগিতার আন্ডারগ্রেডে ছিলাম। ২০১৮ সালে মেক্সিকোতে, ২০১৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায়, ২০২০ সালে থাইল্যান্ডে ও ২০২১ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তবে ২০২১ সালের চ্যাম্পিয়নশিপে আমরা অংশ নিইনি। এবারের হোস্ট ছিল সার্বিয়ার বেলগ্রেড ইউনিভার্সিটি। ২০২৩ সালে স্পেনের মাদ্রিদে সশরীরে চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হবে।'

চ্যাম্পিয়নশিপের ধরন

ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিজ ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপ হয় ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি ফরম্যাটে। অর্থাৎ চ্যাম্পিয়নশিপের ধরনটি ব্রিটিশ পার্লামেন্টারির (হাউস অব লর্ডস ও হাউস অব কমন্স) আদলে করা।

সৌরদীপ বলেন, 'সাধারণ বিতর্কে ২টি দল থাকে, যেমন- সরকারি ও বিরোধী পক্ষ। তবে ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি ফরম্যাটে ২টি সরকারি ও ২টি বিরোধী পক্ষ থাকে। যাদেরকে ওপেনিং গভর্মেন্ট ও ক্লোজিং গভর্নমেন্ট এবং ওপেনিং অপজিশন ও ক্লোজিং অপজিশন বলে। ওপেনিং গভর্নমেন্ট একটা কেস দিলে, ক্লোজিং গভর্নমেন্টও একই বিষয়কে ডিফেন্ড করে কেস দেবে, কিন্তু ওপেনিং গভর্নমেন্ট থেকে সেই কেসটা ভিন্ন হতে হবে। মানে নতুনত্ব আনতে হবে। এটাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি ফরম্যাট বিতর্কের সৌন্দর্য।'

চ্যাম্পিয়নশিপের পর্ব

ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিজ ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপে মোট ৫টি পর্বে লড়াই করেন বিতার্কিকরা। পর্বগুলো হলো- প্রিলিমিনারি, অক্টোফাইনাল, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল এবং সবশেষে ফাইনাল। একেকটি পর্ব জিতেই প্রতিযোগীদের এগিয়ে যেতে হয়।

সৌরদীপ বলেন, 'এটা অনেকটা ক্রিকেট বা ফুটবল বিশ্বকাপের মতোই। এখানেও গ্রুপ পর্ব, মানে নকআউট পর্ব থাকে। প্রথম পর্বটিকে বলা হয় প্রিলিমিনারি রাউন্ড। প্রিলিমিনারি রাউন্ড একটু জটিল, ৯টা রাউন্ডে বিতর্ক হয়। প্রতিটি বিতর্কে ৪টি দল থাকে। যারা জিতে তারা ৩ পয়েন্ট পায়, যারা তৃতীয় হয় তারা ২ পয়েন্ট, যারা দ্বিতীয় হয় তারা ১ পয়েন্ট এবং যারা চতুর্থ হয় তারা শূন্য পয়েন্ট পায়।'

`নকআউট থেকে ৪৮টি দল যায়। এই ৪৮টি দলের মধ্যে প্রথম ১৬টি দল অটোমেটিক্যালি অক্টোফাইনালে চলে যায়। আমরা যেহেতু পঞ্চম ছিলাম, আমরা অটোমেটিক্যালি অক্টোফাইনালে চলে গেছি। বাকি ৩২টি দল পারশিয়াল অক্টোফাইনাল পর্বে অংশ নেয়। সেই ৩২টি দল থেকে উত্তীর্ণ ১৬টি দল প্রথম ১৬টি দলের সঙ্গে বিতর্ক করে। অক্টোফাইনাল থেকে মোট ১৬টি দল যায় কোয়ার্টারে। কোয়ার্টার পর্ব থেকে ৮টি দল যায় সেমিফাইনালে। তারপর সেমিফাইনালের ৮টি দল থেকে ৪টি দল যায় ফাইনালে। এভাবেই চলতে থাকে', যোগ করেন তিনি।

যেভাবে বিশ্বজয়

গত ২০ জুলাই ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিজ ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্ব শুরু হয়। প্রথম ৫ দিন ছিল প্রিলিমিনারি রাউন্ড।

সৌরদীপ বলেন, 'প্রিলিমিনারির ৯ রাউন্ডে সর্বোচ্চ ২৭ পয়েন্ট তোলা সম্ভব। তবে বিতর্কের বিশ্বকাপের ইতিহাসে ২৭ পয়েন্ট কেউ কখনো পায়নি। এবারও শীর্ষে যারা ছিল তারা ২৩ পয়েন্ট পেয়েছিল। আর আমরা পেয়েছিলাম ২১ পয়েন্ট। নকআউট পর্বে আমরা পঞ্চম হয়ে উত্তীর্ণ হই।'

এখানে বিতর্কের বিষয়গুলো মাত্র ১৫ মিনিট আগে জানানো হয়। অর্থাৎ ১৫ মিনিট প্রস্তুতির সময়। প্রত্যেক বিতার্কিককে ৭ মিনিট করে বক্তব্য দেওয়ার সময় দেওয়া হয়। আর ১৫ সেকেন্ড অতিরিক্ত সময়। ফাইনালে টপিক ছিল`এই হাউস ডলারের ওপর বৈশ্বিক নির্ভরতা হ্রাসকে সমর্থন করে।' পুরো বিশ্বে যেমন সবাই ডলারের ওপর নির্ভর করে, সে জায়গা থেকে আমরা ধীরে ধীরে সরে আসব, মূলত এটাই ছিল টপিক। আর আমরা ছিলাম এর বিপক্ষে। আমরা ডিফেন্ড করেছি যে, আমরা চাই ডলার থাকুক,' যোগ করেন তিনি।

সৌরদীপ বলেন, 'পুরো প্রতিযোগিতায় আমরা অনেকবার ক্লোজিং গভর্নমেন্ট ও ক্লোজিং অপজিশন ছিলাম। তবে ফাইনালে আমরা ছিলাম ওপেনিং অপজিশন। ফলে এখানে পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েই আমরা বিশ্বজয় করতে সক্ষম হয়েছি।'

সাজিদ বলেন, 'এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের সব সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতিনিধিরা আসেন। প্রতিবারের মতো এবারও হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে দল এসেছিল। কোয়ার্টার ফাইনালে আমরা হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি ও ইউনিভার্সিটি অফ সিডনিকে হারিয়েছি। ফাইনালেও বিশ্বসেরা ৪টি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুর ও ফিলিপাইনের এতেনিও দে ম্যানিলা ইউনিভার্সিটিকে হারিয়ে আমরা জয়ী হয়েছি।'

কারা সেই বিশ্বজয়ী

টাঙ্গাইলে জন্ম নেওয়া সাজিদ আসবাত খন্দকার বড় হয়েছেন ঢাকায়। পড়েছেন ধানমন্ডি টিউটোরিয়াল স্কুলে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে পড়ার পর এখন পড়ছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে।

তিনি বলেন, 'আমি যখন আইবিএতে পড়তাম, তখন থেকেই আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করি। আইবিএ থেকে আমরা এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপও জিতেছিলাম। তখন সৌরদীপ আমার টিমমেট ছিল না, অন্য একজন ছিল। এ ছাড়া, আমি এশিয়ান বেস্ট স্পিকারও হই। কয়েকবার আমরা অস্ট্রেলেশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপেও ভালো করি। তখন আমরা আইবিএ-র হয়ে বিশ্বকাপেও যাই। বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চ রেকর্ডও আমাদের ছিল। আমরা কোয়ার্টার ফাইনালেও উঠেছিলাম ২ বার।'

'পুরো টুর্নামেন্টে আমি সারাবিশ্বের বিতার্কিকদের মধ্যে ৯ নম্বর হয়েছি। ইংরেজিকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ব্যবহারকারী বিভাগে এবার আমি দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ বিতার্কিকও হয়েছি। বিশ্বকাপে জীবনে ৪ বার অংশ নেওয়া যায়। এরপর আমি যদি বিশ্বকাপে যাই, সে ক্ষেত্রে আমি হয়তো বিচারক হব। ফাইনালের বিচারক হলো বিশ্বের সেরা বিতার্কিকরা। তারা হয়তো কোনো এক সময় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ছিল', যোগ করেন তিনি।

সাজিদ বলেন, 'আমরা অনেক খুশি। যারা বিশ্বজয় করে, ছোটবেলা থেকেই তাদের মতো হতে চাইতাম। স্বপ্ন ছিল যে বিশ্বজয় করবো, কিন্তু কখনো ভাবিনি যে এটা আসলে করতে পারব। এটা শুধু বাংলাদেশ থেকে নয়, এশিয়া থেকে এবার বিশ্বজয় করেছে। এর আগে কখনোই কোনো এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় বিতর্কের বিশ্বকাপ জিততে পারেনি। এটা আগামী প্রজন্মের জন্য একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে।'

`আমরা এবার জিতেছি, কিন্তু এর আগের ৩ বার বাদ পড়েছি। প্রতিটি হার থেকেই আমাদের শিক্ষা নিতে হয়েছে। এই প্রতিযোগিতায় কোনো প্রাইজমানি থাকে না, স্বীকৃতিটাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ', বলেন তিনি।

আরেক বিশ্বজয়ী সৌরদীপ পালের জন্ম কক্সবাজারে। চট্টগ্রামে স্কুলজীবন শেষ করে পড়েছেন নটরডেম কলেজে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে পড়ার পর এখন পড়ছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সৌরদীপ বলেন, '২০১৭ সাল থেকে আমি আর সাজিদ বিতর্ক শুরু করি। ২০১৮ সালে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপ ছিল, সেখানে প্রথমবার আমরা যাই। বাংলাদেশ থেকে হয়তো এর আগেও গিয়েছে। সেবার দক্ষিণ এশিয়ার দলগুলোর মধ্যে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি বম্বের (আইআইটি বম্বে) কোয়ার্টার ফাইনালে যে রেকর্ড ছিল, ওই রেকর্ডটা আমরা প্রথমবারেই করি। তখন আমরা আইবিএতে ছিলাম। ২০১৯ সালে আমরা কোয়ার্টার ফাইনালে না যেতে পারলেও অক্টোফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছিলাম। ২০২০ সালে আবার আমরা কোয়ার্টার ফাইনালে গিয়ে হেরে যাই।'

`সাজিদ এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন। আমি অস্ট্রেলেশিয়ান চ্যাম্পিয়ন। সাজিদ আমি মিলে কেমব্রিজ ইন্টারভার্সিটি ২০২১- এর চ্যাম্পিয়নশিপের চ্যাম্পিয়ন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিতর্ক চ্যাম্পিয়নশিপের বিচারক হওয়ার জন্য আমরা ইতোমধ্যে সিঙ্গাপুর ও চীনেও গেছি', বলেন তিনি।