মাহি হাসান,দ্য রিপোর্ট:  শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সীমা গণনায় বাজার দামের পরিবর্তে কস্ট প্রাইসকে (ক্রয় মূল্য) বিবেচনায় নেওয়ার বিষয়ে সম্মতি দিয়েছিলো অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এ বিষয়ে এই মাসের (আগস্ট)  ৪ তারিখ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।  প্রায় ৩ সপ্তাহ হচ্ছে এই বিনিয়োগসীমা সংশোধনের। এই বিনিয়োগসীমা বাজারকে প্রভাবিত করতে পারে কতটুকু এ নিয়ে ছিলো বিস্তর আলোচনা। বাস্তবে বিনিয়োগসীমা প্রভাবিত করেছে কতটা তা জানার চেস্টা করেছে দ্য রিপোর্ট।

ব্যাংক কোম্পানি আইনে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগের পরিমাণ হিসাব করতে বাজারমূল্য ধরে ঊর্ধ্বসীমা গণনার বাধ্যবাধকতা ছিলো। এ ক্ষেত্রে দেখা যেতো ব্যাংক তার বিনিয়োগসীমার মধ্যে শেয়ার কিনলেও দাম বেড়ে সীমা অতিক্রম করলে তা বিক্রি করে দিতে হতো ফলে বাজারে সেল প্রেশার ( বিক্রয় চাপ) সৃষ্টি হতো। এটা ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার পথে এক ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করতো। যদিও এনিয়ে রয়েছে পাল্টাপাল্টি মতামত। তবে বাস্তবতা বলছে পুঁজিবাজার চাঙ্গা অবস্থা ফিরতে শুরু করেছে। বিগত এক মাসের বাজার পর্যালোচনা করে যায় ফ্লোর প্রাইস ঘোষণার পরে (৩১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছিলো) বাজার কিছুটা স্থির হয় পরবর্তী সময় সূচক আবার নিম্মমুখী অবস্থায় চলে গিয়েছিলো। ফ্লোর প্রাইস কার্যকর হওয়ার সপ্তাহে (৩১ জুলাই - ৪ আগস্ট) ডিএসইতে মূলধন বেড়েছিলো ২১ হাজার ৩৬৪ কোটি ৩২ লাখ ২০ হাজার টাকা। সেই সপ্তাহের শেষে ডিএসইতে বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছিলো ৫ লাখ ১৩ হাজার ৪৭৭ কোটি ৩৯ লাখ ৯৫ হাজার টাকা।

একই প্রেক্ষাপট ছিলো আরেক বাজার চট্টগ্রাম স্টক একচেঞ্জেও। সপ্তাহের শেষ দিন সিএসইতে বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছিলো। ৪ লাখ ৪৫ হাজার ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। সপ্তাহের ব্যবধানে সিএসইতে বাজার মূলধন বেড়েছে ১১ হাজার ১০৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। দুই স্টক এক্সচেঞ্জে বা পুরো শেয়ারবাজারে বাজার মূলধন বেড়েছে ৩২ হাজার ৪৬৮ কোটি ৩০ লাখ ২০ হাজার টাকা।

ডিএসইতে ফ্লোর প্রাইস কার্যকরের সপ্তাহের আগের সপ্তাহ থেকে লেনদেন বেড়েছিলো ১ হাজার ৮৮৯ কোটি ৪৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকা।সপ্তাহের ব্যবধানে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৩৩১ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছিলো ৬ হাজার ৩১২ পয়েন্টে।

পরবর্তী সপ্তাহ (৭ আগস্ট -১১ আগস্ট) ছিলো দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য কঠিন সপ্তাহ। ডলার সংকট, জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি,টাকার মান কমে যাওয়া সহ নানা মুখী সংকটের মুখোমুখি ছিলো রাষ্ট্র। যার প্রভাব পড়ে পুঁজিবাজারেও। দুই শেয়ার বাজারে বাজার মূলধন কমেছে ১৯ হাজার ৬৫৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) গেলো সপ্তাহের শেষে বাজার মূলধন দাঁড়িছিলো ৫ লাখ ৩ হাজার ২৬৬ কোটি ৪০ লাখ ৭২ হাজার টাকা। সপ্তাহের শুরুতে বাজার মূলধন ছিল ৫ লাখ ১৩ হাজার ৪৭৭ কোটি ৩৯ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। আলোচ্য সময়ে ডিএসইতে বাজার মূলধন কমেছে ১০ হাজার ২১০ কোটি ৯৯ লাখ ২২ হাজার টাকা। আরেক শেয়ার বাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) গত সপ্তাহের শেষ দিন বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। সপ্তাহের শুরুতে বাজার মূলধন ছিল ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৪৭ কোটি ২১ লাখ টাকা। আলোচ্য সময়ে বাজার মূলধন কমেছে ৯ হাজার ৪৪৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। দুই স্টক এক্সচেঞ্জে পুরো শেয়ারবাজারে বাজার মূলধন কমেছে ১৯ হাজার ৬৫৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। আলোচ্য সপ্তাহে সপ্তাহে ডিএসইতে ৩ হাজার ৫৮৪ কোটি ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। আগের সপ্তাহে লেনদেন হয়েছিল ৫ হাজার ৫৮ কোটি ৬৪ লাখ ২৮ হাজার টাকা। আলোচ্য সপ্তাহের ব্যবধানে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১৬৩ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছিলো ৬ হাজার ১৪৮ পয়েন্টে।

তবে, গেলো সপ্তাহে (১৪ আগস্ট-১৮ আগস্ট) যেনো পুঁজিবাজারে প্রাণ ফিরে আসে। বিশ্লেষকরা বলছেন পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগ সীমা গণনায় বাজার দরের পরিবর্তে ক্রয় মূল্যকে বিবেচনায় নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসা হচ্ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক তাতে সাড়া দিচ্ছিলো না। তবে আব্দুর রউফ তালুকদারকে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পর থেকেই সেই সমস্যা সমাধানে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আশা জাগে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার জারি করলে দীর্ঘদিনের চাহিদা বিনিয়োগ সীমার সমস্যাটি সমাধান হওয়ায় পুঁজিবাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। এ সিদ্ধান্তের ফল দীর্ঘমেয়াদে হবে বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি, বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম ও বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে বিনিয়োগ সীমার নতুন সংশোধনটিকে শেয়ার বাজারের জন্য খুবই ইতিবাচক বলে বলেছেন। বিনিয়োগসীমার ফল যে বাস্তবেই পড়েছে তা গেলো সপ্তাহের বাজার বিশ্লেষণ দেখলেই পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে। গেলো সপ্তাহে তিন কার্যদিবস পুঁজিবাজারে লেনদেন হয়েছে। জাতীয় শোক দিবস ও জন্মাষ্টমী কারণে ১৫ ও ১৮ আগস্ট পুঁজিবাজারে লেনদেন বন্ধ ছিল। সপ্তাহজুড়ে ডিএসইর বাজার মূলধন চার হাজার ৮৪৩ কোটি টাকা ফিরেছে। বিদায়ী সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস লেনদেন শুরুর আগে ডিএসইতে বাজার মূলধন ছিল পাঁচ লাখ তিন হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। আর সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস লেনদেন শেষে বাজার মূলধন দাঁড়ায় পাঁচ লাখ আট হাজার ১০৯ কোটি টাকায়। দেখা যাচ্ছে, সপ্তাহের ব্যবধানে বাজার মূলধন চার হাজার ৮৪৩ কোটি টাকা বেড়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৯২ দশমিক ৬৭ পয়েন্ট ৬২৪১দশমিক ৪৪ পয়েন্টে। অপর সূচকগুলোর মধ্যে ডিএসই শরিয়াহ সূচক ২০ দশমিক ৬৭ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১৩৬৬দশমিক ৩৮ পয়েন্টে এবং ২২২০দশমিক ০৫ পয়েন্টে।

যদিও ভিন্ন অবস্থা অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) বিদায়ী সপ্তাহে তিন কার্যদিবসে টাকার পরিমাণে লেনদেন হয়েছে ৫৮ কোটি ৬৩ লাখ ৩৫ হাজার ৫৮২ টাকার। আগের সপ্তাহে লেনদেন হয়েছিল ৭৪ কোটি ২২ লাখ ৮৭ হাজার ৬৯৯ টাকার। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে সিএসইতে লেনদেন ১৫ কোটি ৫৯ লাখ ৫২ হাজার ১১৭ টাকা কমেছে। কিন্তু, সপ্তাহটিতে সিএসইর সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ২৪২ দশমিক ২৪ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮৩৬৯ দশমিক ৯২ পয়েন্টে।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন বিনিয়োগসীমা নির্ধারণের ফলাফল এটি।কথা হয় বেশ কয়েকজন বিনিয়োগকারীর সাথে। আব্দুর রহমান নামে এক বিনিয়োগকারি বলেন, কস্ট প্রাইসকে বিনিয়োগ সীমা গণনা এটা বিনিয়োগকারীসহ সকলের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। এটি সমাধানের মাধ্যমে স্থিতিশীলতা ফিরবে একই সঙ্গে আগামীতে বাজার ইতিবাচক হবে বলে তিনি মনে করেন। সিকান্দার আলি নামে এক বিনিয়োগকারী বলেন বর্তমানে বাজার স্থিতিশীল মনে হচ্ছে। আশা করি এটি ধরে রাখতে যাবতীয় ব্যবস্থা কমিশন নিবে। ফ্লোর প্রাইস ও বিনিয়োগসীমা নির্ধারণ এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে তিনি মনে করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্রোকারেজ হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বিনিয়োগসীমা নির্ধারণ ছিলো এ যাবতকালের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এর ফলাফল পুঁজিবাজার দীর্ঘমেয়াদে পাবে বলে তিনি মনে করেন।

এ ব্যাপারে কথা হয় পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদের সাথে। তিনি বলেন বাজারের যে অবস্থা ছিলো বাজার টিকিয়ে রাখা ছিলো বড় চ্যালেঞ্জ।বাজার টিকে আছে ,নিম্নমুখী হচ্ছেনা এটিই এখন অনেক বড় ব্যাপার। ফ্লোর প্রাইস ও বিনিয়োগসীমার সিদ্ধান্ত শেয়ারমার্কেটকে টিকে থাকতে ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক এই শিক্ষক।

এদিকে, আজও সপ্তাহের প্রথমদিন উর্ধ্বমুখী মনোভাবে চলেছে পুঁজিবাজার। ডিএসইতে প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১৮ পয়েন্ট বেড়ে ৬ হাজার ২৫৯ পয়েন্টে অবস্থান করছে। এ ছাড়া ডিএসই শরীয়াহ সূচক ৬ পয়েন্ট বেড়ে ১ হাজার ৩৭২ পয়েন্টে, ডিএস৩০ সূচক ৬ পয়েন্ট বেড়ে ২ হাজার ২২৬ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। আজ ডিএসইতে মোট ৩৮১টি কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দর বেড়েছে ১৩৬টি কোম্পানির। এ ছাড়া দরপতন হয়েছে ১৪৩টি কোম্পানির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ১০২টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের।

আজ (রোববার) ডিএসইতে মোট ১ হাজার ৫৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। আগের দিন ডিএসইতে লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ১৫৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা।