দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: ১৯৮৯ সালে ১৫ই এপ্রিল ইংল্যান্ডের উত্তরের শেফিল্ড শহরের হিলসবারা স্টেডিয়ামে একটি ম্যাচ শুরুর আগেই ভিড়ের চাপে ৯৭ জনের মৃত্যু হয়। ইন্দোনেশিয়ায় একটি ফুটবল স্টেডিয়ামে রোববার পদদলিত হয়ে কমপক্ষে ১২৫ জন দর্শকের মৃত্যুর ঘটনায় বিশ্বজুড়ে বহু মানুষ স্তম্ভিত।
কিন্তু ফুটবলের মাঠে এর আগেও এমন অনেক বিপর্যয় ঘটেছে যেগুলোতে শত শত মানুষ মারা গেছে।

এগুলোর কোনো কোনোটি হয়েছে উচ্ছৃঙ্খল দর্শকের কারণে, কোনোটি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায়, কোনোটি শুরু হয়েছে নেহাতই একজন দর্শকের পা হড়কে পড়ার কারণে।

আবার কোনোটির কারণ পঠাৎ করে দেখা দেওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমনটি হয়েছিল ১৯৮৮ সালে নেপালে স্থানীয় একটি ক্লাবের সাথে বাংলাদেশি একটি ক্লাবের সাথে ম্যাচের সময়।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফুটবল মাঠে এমন সাতটি বড় ধরণের ট্রাজেডি কীভাবে ঘটেছিল তা নিয়ে বিবিসি বাংলার সংকলন:

পেরুর জাতীয় স্টেডিয়াম, ২৪শে মে, ১৯৬৪

প্রাণহানির বিবেচনায় ফুটবল মাঠে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হয়েছিল পেরুতে ১৯৬৪ সালে। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে সে বছর টোকিও অলিম্পিকে কোন কোন দেশ যাবে তা নির্ধারণে ২৪মে রাজধানী লিমার স্টেডিয়ামে খেলা হচ্ছিল স্বাগতিক পেরু এবং আর্জেন্টিনার মধ্যে একটি কোয়ালিফাইং ম্যাচ। ৫৩,০০০ লোকের ধারণ ক্ষমতার স্টেডিয়াম ছিল কানায় কানায় ভর্তি।

আর্জেন্টিনা এক গোল করার কিছুক্ষণ পর পেরু সেটি শোধ করলে উরুগুয়ের রেফারি সেই গোল নাকচ করে দেন। ক্রোধে ফেটে পড়ে স্বাগতিক দলের ফ্যানরা। এক পর্যায়ে দুজন সমর্থক মাঠে ঢুকে পড়লে পুলিশ যখন তাদের লাঠিপেটা শুরু করে, দর্শকদের ক্ষোভের সহিংস বহি:প্রকাশ আয়ত্তের বাইরে চলে যায়।

শত শত ক্রুদ্ধ দর্শক বেড়া টপকে মাঠের ভেতর ঢুকে পড়লে পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে পড়ে। স্টেডিয়াম থেকে পালাতে গিয়ে পায়ের নীচে পড়ে, ভিড়ের চাপে শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যায় ৩২০ জন। আহত হয় হাজারের বেশি মানুষ।

হিলসবরা স্টেডিয়াম, শেফিল্ড, ব্রিটেন ১৯৮৯
উনিশশো উননব্বই সালের ১৫ই এপ্রিল ইংল্যান্ডের উত্তরের শেফিল্ড শহরের হিলসবারা স্টেডিয়ামে একটি ম্যাচ শুরু আগেই ভিড়ের চাপে ৯৭ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় ৭৬৬ জন। পুলিশের ব্যর্থতাকেই, বিশেষ করে মাঠে সেদিন যে পুলিশ কর্মকর্তা নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন তার ভুল সিদ্ধান্তকে ঐ ট্রাজেডির জন্য দায়ী করা হয়।

এফএ কাপের সেমিফাইনালে ম্যাচ সেদিন খেলার কথা ছিল লিভারপুল এবং নটিংহ্যাম ফরেস্ট ক্লাবের। গ্যালারির যে দুটো স্ট্যান্ডে মানুষজন দাঁড়িয়ে খেলা দেখতে পারতো সেগুলো নির্ধারণ করা হয় লিভারপুলের ফ্যানদের জন্য। সেগুলো কানায় কানায় ভরে যায়। তারপরও কয়েক হাজার লিভারপুল ফ্যান মাঠের বাইরে ভিড় করেছিলেন।

এক পর্যায়ে ভিড়ের চাপ থেকে বাঁচতে মাঠ থেকে কিছু দর্শক যাতে বের হয়ে যেতে পারে সে জন্য পুলিশ একটি গেট খুলে দেয়, কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হয়। বাইরে অপেক্ষমাণ শত শত সমর্থক সেই গেট দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে ঢুকে পড়লে পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। পদদলিত হতে থাকেন লিভারপুল ক্লাবের বহু ফ্যান।

ব্রিটেনের খেলাধুলোর জগতের ঘটনা ছিল সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। বছরের পর বছর তদন্ত চলেছে। শেষ পর্যন্ত বছর তিনেক আগে আদালত রায় দেয় পুলিশের সিদ্ধান্ত ছিল ভুল।

কাঠমান্ডু দশরথ স্টেডিয়াম, ১২ই মার্চ, ১৯৮৮

উনিশশো অস্টাশি সালের ১২ই মার্চ নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে একটি ফুটবল ম্যাচ চলার সময় এক বিপর্যয়ে মারা গিয়েছিল ৯৩ জন। আহত হয় একশরও বেশি দর্শক।

ত্রিভুবন চ্যালেঞ্জ শিল্ড কাপের এক ম্যাচে সেদিন খেলা চলছিল স্থানীয় ক্লাব জনকপুর সিগারেট ফ্যাক্টরি এবং বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবের মধ্যে। খেলার মাঝে হঠাৎ করে শুরু হয় ভারি শিলাবৃষ্টি।

গ্যালারির ছাদ ছিলনা, ফলে আতঙ্কিত দর্শকরা স্টেডিয়াম থেকে বেরুনোর জন্য ছুটতে শুরু করে। কিন্তু স্টেডিয়ামের আটটি গেটের মধ্যে মাত্র একটি ছিল খোলা। ফলে, হুড়োহুড়িতে পায়ের চাপে পড়ে সেদিন মারা যায় কমপক্ষে ৯৩ জন।

রাশিয়া, ২০শে অক্টোবর, ১৯৮২

মস্কোর লুজনিকি স্টেডিয়ামে স্পাটার্ক মস্কো এবং নেদারল্যান্ডসের ক্লাব হার্লেমের মধ্যে ইউরোপীয় কাপের এক ম্যাচে সেদিন মাঠে কত মানুষ মারা গিয়েছিল তা নিয়ে বিতর্ক এখনও শেষ হয়নি। রুশ কর্তৃপক্ষের হিসাবে, ৬৬ জন মারা যায় যাদের ৪৫ জনই ছিল কিশোর তরুণ। এরা সবাই স্পার্টার্কের ফ্যান। কিন্তু রুশ দৈনিক সেভিয়েটস্কি লিখেছিল ৪০ জন সেদিন মারা য়ায়।

বিপর্যয়ের কারণ ছিল বেশ অদ্ভুত। অস্বাভাবিক ঠাণ্ডার কারণে মাঠে সেদিন ভিড় ছিলনা। কিন্তু খেলা শেষ হওয়ার ঠিক আহ মূহুর্তে অনেক দর্শক ট্রেনে ভিড় এড়াতে আগে বেরিয়ে যেতে শুরু করে। তখনই পায়ে চাপা পড়ার ঘটনা ঘটে।

মিশরের আল আহলির ফ্যানদের হামলা করছে আল মসির ক্লাবের সমর্থকরা। ২০১২ সালের ঐ ফুটবল দাঙ্গায় ৭৪ জনের মৃত্যু হয়

প্রত্যক্ষদর্শীরা পরে জানিয়েছিলেন, বেরুনোর সময় সিঁড়িতে একজন নারীর পা থেকে জুতো খুলে গেলে তিনি পা হড়কে পড়ে। তাকে ওঠাতে কিছু মানুষ সেখানে দাঁড়িয়ে যায়। ফলে পেছন থেকে আসা মানুষের চাপে সামনের দিকের অনেক মানুষ পায়ের নিচে পড়ে যায়।

মিশর, ১লা ফেব্রুয়ারি, ২০১২
মিশরের পোর্ট সাইদ স্টেডিয়ামর ট্রাজেডিতে সেদিন মারা গিয়েছিল ৭৪ জন ফুটবল ফ্যান। আহত হয় পাঁচশরও বেশি।

বিপর্যয় শুরু হয় যখন স্থানীয় ক্লাব আল মাসরির সমর্থকদের সাথে কায়রোর আল আহলি ক্লাবের সমর্থকদের মারামারি শুরু হয়। আল মাসরি ৩-১ গোলে জিতে গেলে তাদের হাজার হাজার সমর্থক মাঠের ভেতর ঢুকে পড়ে, এবং এক পর্যায়ে আল আহলি ক্লাবের জন্য নির্ধারিত স্ট্যান্ডে লাঠিসোটা, পাথর নিয়ে হামলা চালায়।

পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল পরিস্থিতি বুঝেও তারা স্টেডিয়ামের দরজা খোলেনি। ফলে মাঠের ভেতর বসে মার খেয়ে মরতে হয়েছে আল আহলির বহু ফ্যানকে। ঐ ঘটনার পর কায়রো সহ মিশরের বিভিন্ন শহরে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। স্টেডিয়ামে সহিংসতার জন্য ১১ জনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল। সরকার দু'বছরের জন্য মিশরের অভ্যন্তরীণ লীগ ফুটবল নিষিদ্ধ করেছিল।

বেলজিয়াম ২৯শে মে, ১৯৮৫
ইউরোপীয় কাপ ফাইনালে ইংল্যান্ডের লিভারপুল এবং ইটালির জুভেন্টাসের মধ্যে ম্যাচ শুরুর আগে বেলজিয়ামের হেইসের স্টেডিয়ামে সেদিনের বিপর্যয়ে মারা গিয়েছিল ৩৯ জন। আহত হয় ৬০০ জনের মত। সিংহভাগই জুভেন্টাসের ফ্যান।


গ্যালারিতে দুই ক্লাবের সমর্থকদের পৃথক রাখতে বেড়া দেওয়া ছিল, কিন্তু ম্যাচ শুরুর ঘন্টাখানেক আগে লিভারপুলের কিছু ফ্যান ঐ বেড়া ভেঙ্গে চড়াও হয় জুভেন্টাস ফ্যানদের ওপর। ভয়ে জুভেন্টাস ফ্যানরা কটি কংক্রিটের দেয়ালের দিকে দৌড় দেয়। আগে থেকেই দেয়াল সেঁটে অনেক দর্শক দাঁড়িয়ে ছিল। ফলে দৌড়ে যাওয়া লোকদের চাপে এক পর্যায়ে দেয়ালটি ভেঙ্গে তাদের ওপর পড়ে। অনেকে ভাঙ্গা দেয়াল দিয়ে বেরুতে গিয়ে মারাত্মকভাবে জখম হয়।

এই বিপর্যয়ের পরেও সেদিন খেলা হয়েছিল। জুভেন্টাস ১-০তে জিতছিল।

দক্ষিণ আফ্রিকা, ১১ই এপ্রিল, ২০০১
দক্ষিণ আফ্রিকায় খেলাধুলোর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ঘটেছিল ২০০১ সালের ১১ই এপ্রিল জোনাহানেসবার্গ শহরের এলিস পার্ক স্টেডিয়ামে। পায়ে চাপ পড়ে মারা গিয়েছিল ৪৩ জন দর্শক, আহত হয় আরও বহু লোক।

স্থানীয় এক টুর্নামেন্টে সেদিন খেলা ছিল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব কাইজার চিফস্‌ এবং অরলান্ডো পাইরেটসের মধ্যে। মাঠের ভেতর ৬০ হাজার আসনের সবগুলো ছিল ভর্তি। কিন্তু বাইর আরও ৩০ হাজার রোক ঢোকার চেষ্টা করছিল।
এক পর্যায়ে অরলান্ডো পাইরেটস দল তাদের গোল শোধ করার পর মাঠের ভেতর সমর্থদের চিৎকার শুনে বাইরে অপেক্ষমাণ তাদের কয়েক হাজার সমর্থক জোর করে ঢুকে পড়ার চেষ্টা শুরু করে। মানুষের চাপে এক পর্যায়ে পরিস্থিতি পুরোপুরি বেসামাল হয়ে পড়ে। ধাক্কাধাক্কিতে পদদলিত হয়ে এবং ভিড়ে শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যায় ৪৩ জন।

চৌত্রিশ মিনিট পর রেফারি খেলা বন্ধ করে দেন। অনেক খবরে বলা হয় কর্তৃপক্ষ সেদিন ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ অর্থাৎ ১২০,০০০ দর্শক মাঠে ঢুকিয়েছিল।