রেজাউর রহমান 

পৃথিবী নামক গ্রহে কবে থেকে হোমোসেপিয়েন্স প্রজাতির প্রাণির বসবাস তা নিয়ে আছে বিস্তর কথাবার্তা। আছে সুক্ষ্ম রাজনীতি। তবে লিখন পদ্ধতির ফলে মানুষ তার চলা, বলার ইতিহাসকে সামনে আনতে পেরেছে। প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করার কৌশল ও টিকে থাকার বাস্তবতার ধারণা থেকেই যে সামাজিক প্রক্রিয়া শুরু–তা পরিস্কার। কিন্তু এই সামাজিক ধারণা কীভাবে রাজনৈতিক ধারণায় রূপ নিল তা খুবই অন্তর্গতবিষয়।

 

কে যে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে এটার একটা কারণ-মানুষের ক্রিয়াকলাপ। জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানো আর বন ও কৃষির জন্য ভূমির রূপান্তর (“ Climate change can also be caused by human activities, such as the burning of fossil fuels and the conversion of land for forestry and agriculture..”) ।

ফলে আমরা পরিস্কার ধারণা পাই যে, প্রকৃতির পরিবর্তন মানুষের স্বভাবের পরিবর্তন করে ফেলে। মানুষ টিকে থাকতে ক্ষমতা, দম্ভ প্রদর্শন এবং প্রথমে প্রকৃতির সাথে ও তার সৃষ্টির সাথে রাজনৈতিক ভাষা আদান প্রদান শুরু করে।

বৃটিশ নাট্যকার সারাহ কেন (১৯৭১-১৯৯৯) “৪.৪৮ সাইকোসিস” নাটকে দেখিয়েছেন-"যা ব্যক্তিক, তাই রাজনৈতিক।" অর্থাৎ রাজনীতির ঊর্ধে আমরা কেউ নই। জন্মগতভাবে মানুষ রাজনৈতিক। একজন মানুষকে ওই ভূখণ্ডের, জাতিগোষ্ঠীর রাজনৈতিক দায় এমনকি পৃথিবীর রাজনৈতিক দায় তার উপর বর্তায়।এখন প্রশ্ন হলো আমি কি রাজনৈতিক? এটা একদমই উপলব্ধিগত মনন, সচেতনতা এবং তা ধারণ করার সদিচ্ছার বিষয়।

এমনই রাজনৈতিকমনন সচেতন শিল্পী দিলারা বেগম জলি যিনি "অ/দৃশ্য" শিরোনামে চিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে নানা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন প্রচলিত সমাজে, রাজনীতিতে। এই প্রশ্ন জলি বেশ কয়েক দশক ধরেই করে আসছেন, প্রচলিতভাবে শিল্পকলার যে ভাষা ব্যবহার করা হয় তা তিনি করেন না। জলির চলার পথ মসৃণ নয়, তিনি শিল্পকে জীবনে, মননের অনুগামী করে ফেলেছেন এটা পরিস্কার।চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটক (১৯২৫-১৯৭৬)একবার বলেছিলেন, " আমি প্রতি মুহূর্তে ধাক্কা দিয়ে বোঝাবো, আমি আপনাকে সস্তা আনন্দ দিতে আসিনি। " আমাদের শিল্পী জলিও সেরকম সস্তা আনন্দ দিচ্ছে না, প্রদর্শনীর প্রতিটি কোণায়, পরতে পরতে রাজনৈতিক সচেতনতার গন্ধ এবং তা দেশ, কাল, সীমানা পেরোনো। শুধু স্থানিক রাজনৈতির গল্প জলি যে করছেন না, তা পরিস্কার। " আর্ট মানে আমার কাছে যুদ্ধ।" জলির শিল্পকর্ম একটি যুদ্ধক্ষেত্র আর তিনি সেখানে সেনাপতির ভূমিকায়।

দিলারা বেগম জলি আর্টকে যুদ্ধে পরিণত করলেও কৌশলগতভাবে নিজের শারীরিক সত্তাকে দারুণভাবে উপস্থাপন করেছেন।প্রকৃতির পরিবর্তনের ফলে বিবর্তন ও মানুষের স্বভাবগত রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু যে জন্ম ও তার প্রক্রিয়ায় যে নারী শরীরের সেই স্থানকেই রাজনৈতিক করে ফেলা হয়েছে। শুরু থেকে এটি জলি নিজস্ব চেতনা ও চলার পথ থেকে বুঝতে পেরেছেন। বুঝতে পেরেছেন বিশ্বরাজনীতির ময়দানে বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে নারীজরায়ু।

কলাকেন্দ্রের প্রদর্শনীর প্রবেশের মুখে মওলানা জালাল উদ্দীন রুমির উক্তি ব্যবহার করে জলি জানান দিচ্ছেন, ক্ষতের মুখের প্রবেশদ্বার দিয়ে যে আলো তা দিয়ে তার শিল্প কথন আলোকিত, অন্যদেরও আলোকিত করতে চান।জলি আপাদমস্তক একজন রাজনৈতিক সচেতন বাঙালী শিল্পী ও নারী।নিজের ব্যবহৃত শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট ও অ/দৃশ্য কেই দৃশ্যমান করেছেন সুতা-সুঁই দিয়ে।

ভিডিওচিত্রে জলি নিজের সত্তার মেটামরফাসিস দেখিয়েছেন।প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে কুক্ষিগত করে রাখার ও ধর্মীয় রাজনৈতিক লিপ্সার শিকার তার পরম পাওয়া জরায়ু, তা জলির সুচের প্রতিটি ফোঁড় জানান দিচ্ছে। মানসিকভাবে হীন প্রচলিত সমাজে নারীর ব্যবহার্যসামগ্রী যেন লুক্কায়িত অংশ, যাকে বৃদ্ধাঙুল দিয়ে দেখিয়ে জলি স্যানিটারি ন্যাপকিন, ব্লাউজ, পেটিকোট ব্যবহার করেছেন।

মূলত দিলারা বেগম জলির কাজ দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং লিঙ্গ পরিচয়ের অন্বেষণ করে। তিনি লিঙ্গ, ট্রমা এবং মহিলা শরীরের থিমগুলিতে স্পর্শ করেন।