মাহি হাসান, দ্য রিপোর্ট: দেশের পুঁজিবাজারে আলোচিত এক নাম এসএমই বোর্ড। বিভিন্ন সময় এসএমই বোর্ড আলোচিত একাধারে সমালোচিত নানা কারনে। শেয়ার দরের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারনে বারবারই আলোচনার জন্ম দেয় এসএমই বোর্ডের কোম্পানিগুলো। নামমাত্র মুনাফা দেওয়ার পরেও কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম অতীতে কয়েকশত গুণ বাড়তেও দেখা গিয়েছে। ওটিসি থেকে তালিকাভুক্ত চার কোম্পানির সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে পর্যালোচনা করেছে দ্য রিপোর্ট।

ওটিসি খাত থেকে এসএমই বোর্ডে তালিকাভুক্ত হয়েছে চারটি কোম্পানি বেঙ্গল বিস্কুট, ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়েজ, অ্যাপেক্স ওয়েভিং, হিমদ্রি। দেখা আসা যাক বর্তমানে কোম্পানিগুলোর পারফরম্যান্সের সার –সংক্ষেপ।

বেঙ্গল বিস্কুট: বেঙ্গল বিস্কুটের নাম গত বছরজুড়েই আলোচনায় ছিলো। সর্বশেষ গতবছর সেপ্টেম্বর কোম্পানির বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠে। যার প্রেক্ষিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও কোম্পানির বেঙ্গল বিস্কুটের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে একটি চিঠি পাঠায়, যেখানে কোম্পানির বিক্রয় প্রতিবেদন,ব্যাংকের স্ট্যাটমেন্ট, মাসিক ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স, বেতন ভাতার সীট সহ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু দলালাদি কমিশনে জমা দিতে বলা হয়। তখন কোম্পানিটির নামে একাধিক অনিয়মের অভিযোগ কমিশনে কমিশনে জমা পড়ে। এর দুই মাস পরে ফের ডিসেম্বরে আলোচনায় আসে কোম্পানিটি। বেঙ্গল বিস্কুট ৩০ জুন ২০২২ সমাপ্ত অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করে যা বিএসইসি বাতিল ঘোষনা করে। বর্তমানে কোম্পানিটি লেনদেন হচ্ছে ৭৯ টাকা ২০ পয়সায়। গত এক বছরে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ৬৭ টাকা ১০ পয়সা থেকে ১৭৪ টাকা ৯০ পয়সায় পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে। বেঙ্গল বিস্কুট ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের এসএমই মার্কেটে ২০২১ সালে তালিকাভুক্ত হয়। বেঙ্গল বিস্কুটের অনুমোদিত মূলধন ৫০ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ৭ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। কোম্পানিটির এছাড়া কোম্পানিটির ৭৯ লাখ ৩৮ হাজার শেয়ারের মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে ৩০ দশমিক ৬০ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ৫৯ দশমিক ১৩ শতাংশ শেয়ার আছে।

ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়েস : ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়েসের শেয়ারের দাম গত এক বছরে উঠানামা করেছে অনেক। ২৩ টাকা ৪০ পয়সা থেকে প্রায় ৭০ টাকা পর্যন্ত উঠানামা করেছে। এসএমই বোর্ডের এই কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনে কোনো অনিয়ম-অসঙ্গতি আছে কি-না, তা খতিয়ে দেখতে গেল বছর তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলো নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বিএসইসির উপ-পরিচালক মোহাম্মদ রতন মিয়াকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করে বিএসইসি। ২৫ কোটি অনুমোদিত মূলধন ও ১০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূল্ধনের এই কোম্পানিটি ওটিসি মার্কেট থেকে এসএমই বোর্ডে লেনদেন শুরু করার সময় লেনদেন হতো ১৬ টাকা ২৬ পয়সা দরে। যা বর্তমানে লেনদেন হচ্ছে ২৯ টাকা দরে। যদিও ৭০ টাকা পার হয়েছিলো কোম্পানিটির শেয়ার দর। ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়েসের উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে রয়েছে ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ শেয়ার। প্রাতিষ্ঠানিক শেয়ার আছে ৭ দশমিক ৮৭ । এবং বিনিয়োগকারিদের হাতে রয়েছে ৬১ দশমিক ৬ শতাংশ শেয়ার। এই কোম্পানটিও সর্বশেষ বছরে কোন প্রকার লভ্যাংশ দিতে পারেনি।

হিমাদ্রি : ডিএসই সুত্রে পাওয়া খবরে বিবিধ খাতের এই কোম্পানিটির লেনদেন বন্ধ রয়েছে বলে জানা যায়। গত এক বছরে কোম্পানিটির শেয়ার ১৫ টাকা ১০ পয়সা থেকে শুরু করে ৫১ টাকা ৪০ পয়সা পর্যন্ত উঠানামা করেছে । প্রায় তিনগুণ পর্যন্ত দাম বেড়েছে কোম্পানিটির শেয়ারের। মাত্র ২ কোটি টাকা অনুমোদিত মূলধন ও ৭৫ লাখ টাকার পরিশোধিত মূলধনের এই কোম্পানিটি ২০২২ সালে ১০ % নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। হিমাদ্রির উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার রয়েছে ৯৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ। কোম্পানিটিতে সরকারি শেয়ার আছে ১ দশমিক ৪৮ শতাংশ ও সাধারন বিনিয়োগকারিদের মধ্যে রয়েছে মাত্র দশমিক শুন্য নয় শতাংশ শেয়ার । ওটিসি থেকে এসএমই বোর্ডে আসার সময় কোম্পনিটির শেয়ারের মূল্য ছিলো ৮ টাকা যা গত বছর ৬ গুনের বেশি প্রায় ৫০ টাকার উপরে উঠেছে। কোম্পানিটির প্রায় ৪ কোটি টাকা দীর্ঘমেয়াদী ঋণ ও প্রায় পৌণে দুই কোটি টাকার কাছাকাছি স্বল্পমেয়াদী ঋণ আছে।

অ্যাপেক্স ওয়েভিং: বস্ত্র খাতের এই কোম্পানিটি এসএমই বোর্ডে আসে ১২ টাকা দর নিয়ে যা বর্তমানে লেনদেন হচ্ছে ১৬ টাকা ৪০ পয়সায়। এই কোম্পানিটির শেয়ারের মূল্য গত এক বছরে ১২ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৫৩ টাকা ৪০ পয়সা পর্যন্ত উঠেছে। এই কোম্পানিটি বছরের পর বছর ধরে লোকসানে ছিলো। ২০২১ সালে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা ও আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে কোম্পানিটিতে ৫ জন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেয় কমিশন। যদিও এতেও খুব একটা কাজ হয়নি। গত বছরে কোম্পানিটি সাধারণ বিনিয়োগকারীকে কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। মূলত লোকাসানের ধারা থেকে বের হতে পারেনি এখনো। কোম্পানিটির গত বছর শেয়ার প্রতি লোকসান (ইপিএস) হয়েছে ১ টাকা ৭৭ পয়সা। এপেক্স ওয়েভিং ও ফিনিশিং লিমিটেডের শেয়ারের মধ্যে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে ৩০ দশমিক ১২ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হতে ১৭ দশমিক ৩১ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে ০.০১ শতাংশ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৫২ দশমিক ০৬ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।

ওটিসি মার্কেট বাতিল করে দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল সর্বমোট ৭টি উৎপাদনে থাকায় ৭টি কোম্পানি এসএমই বোর্ডে লেনদেন শুরু করবে। কিন্তু পরবর্তীতে এই চার কোম্পানি ও নতুন তালিকাভুক্ত ১১ কোম্পানি নিয়ে চালু রয়েছে এস এমই বোর্ড। এই বোর্ড চালু হবার পরে শেয়ারের অযাচিত দাম বৃদ্ধি সহ নানা কারনে বারবারই হাজারো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিনিয়োগকারিদের মধ্যে এমনো গুঞ্জন শোনা গেছে এই বোর্ডে থাকা কোম্পানিগুলোর মূলধন কম থাকায় গ্যাম্বলারদের পছন্দের জায়গা এই মার্কেট। আবার এমনো শোনা গেছে কখনো কোম্পানির অফিসের কোন অস্তিত্ব নেই এমন কোম্পানিও লেনদেনের অনুমতি পেয়েছে। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এসএমই বোর্ডের প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিনিয়োগ শিক্ষা বেশি থাকায় তারা গুজবে ছোটেন না। কোম্পানির মৌলভিত্তির বিবেচনায় শেয়ার কেনেন। ওটিসি মার্কেট থেকে আসা কোম্পানি ও এসএমই বোর্ডের বাকি কোম্পানিগুলোর অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন থাকে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদের কাছে । তিনি বলেন, এসএমই মার্কেট ছোট । এখানে যেমন গ্যাম্বলিংয়ের সুযোগ বেশি তেমনি ভালো করার সুযোগ বেশি। কারন মার্কেট ছোট হওয়ায় আদর্শ বিনিয়োগকারিরা জেনে বুঝে লেনদেন করে। পাশাপাশি এখানে হাতে গোনা ১৫ টা কোম্পানি থাকায় গুজবের স্থান নেই।ফলে মার্কেটকে অস্থির বানানোর সুযোগ কম। তিনি আরো বলেন, ওটিসি মার্কেট থেকে আসা কোম্পানিগুলো আশানুরুপ ভালো করতে পারেনি। পাশাপাশি এসএমই মার্কেটে নতুন কোম্পানি অনুমোদন দেওয়ার সময় আরো সর্তকতার পাশাপাশি যাচাই বাছাই করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

প্রসঙ্গত, ২০২১ সালে র ১৬ সেপ্টেম্বর পুঁজিবাজারের ওভার দ্য কাউন্টারের (ওটিসি) কার্যক্রম বাতিল করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তখন বলা হয়েছিলো ওটিসিতে থাকা কোম্পানিগুলোর মধ্যে ২৩টি যাবে এসএমই বোর্ডে। এর মধ্যে ৭টি উৎপাদনে আছে, বন্ধ আছে ১৬টির উৎপাদন। অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ডে যাচ্ছে ১৮টি এবং ২৯টি কোম্পানি তালিকাচ্যূত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিলো। এর আগে ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু করেছিলো ওটিসি মার্কেট । উৎপাদনে না থাকা, নিয়মিত বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) না করা, কাগজের শেয়ার রাখা, নিয়ম অনুযায়ী বিএসইসিতে আর্থিক প্রতিবেদন জমা না দেয়া, লভ্যাংশ প্রদান ও সিকিউরিটিজ আইন পরিপালন না করা ৬৫টির বেশি কোম্পানিকে মূল মার্কেট থেকে সরিয়ে ওটিসি মার্কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তখন।

(দ্যরিপোর্ট/মাহা/৮এপ্রিল,২০২৩)