দিরিপোর্ট২৪ ডেস্ক : কোরবানি হলো- আরবি জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখে আল্লাহর নামে হালাল পশু জবাই করা। প্রাপ্তবয়স্ক যেকোনো মুসলমান নর-নারীর এ সময়ের মধ্যে ৫২ তোলা রুপার মূল্য পরিমাণ অতিরিক্ত যেকোনো ধরনের সম্পদ থাকলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হয় (বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬, রাদ্দুল মুহ্তার ৬/১৩২)। শুধু কোরবানি দিলেই চলে না, কোরবানির পশু নির্বাচনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উচিত।

গৃহপালিত হালাল পশু যেমন- গরু, ছাগল, ভেড়া (বা দুম্বা), মহিষ, উট ইত্যাদি পশু ইখলাসের সঙ্গে নিয়ত করে সহিভাবে জবাইয়ের মাধ্যমে এ ওয়াজিব আদায় করা যায়।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) চার ধরনের ত্রুটিপূর্ণ পশু কোরবানি দিতে নিষেধ করেছেন- দৃষ্টিহীন (বা এক চোখ অন্ধ), রুগ্ন, সম্পূর্ণভাবে খোঁড়া ও এতটাই শীর্ণকায় যে তার অস্থিতে অস্থিমজ্জা নেই। তখন সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আমরা তো দাঁত, কান, লেজে ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারাও কোরবানি দিতে অপছন্দ করি। জবাবে নবীজি বললেন, যা ইচ্ছা অপছন্দ করতে পারো; তবে তা অন্যের জন্য হারাম করো না (সহিহ্ ইবনে হিব্বান ৫৯১৯, আবু দাউদ ২/৩৮৭, তিরমিজি ১/২৭৫)।


অনেকে মনে করেন, পশুর শিং অল্প ভাঙা থাকলে বা শিং উঠেনি, এমন পশু দ্বারা কোরবানি সহিহ হবে না; এ ধারণা ঠিক নয়। মূলত যে পশুর শিং একবারেই গোড়া থেকে ভেঙে গেছে, যার কারণে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে, তা কোরবানি করা যাবে না। পক্ষান্তরে যে পশুর শিং আংশিক ভেঙে গেছে বা শিং উঠেনি, সে পশু দ্বারা কোরবানি করা যাবে (তিরমিজি ১/২৭৬, আবু দাউদ ৩৮৮, রাদ্দুল মুহতার ৬/৩২৪)।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, আমরা যেন কোরবানির পশুর চোখ ও কান ভালোভাবে লক্ষ করি এবং ওই পশু দ্বারা কোরবানি না করি যার কানের অগ্রভাগ ও পশ্চাৎভাগ কর্তিত (আবু দাউদ ২/২৩৮, তিরমিজি ১/২৭৫)।

বাংলাদেশে ঈদকে সামনে রেখে গরু মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়া চলে খুব তোড়জোড়ে। স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে গরু মোটাতাজাকরণ না করে অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী ও কৃষক ঈদের দু-তিন মাস আগে থেকে অতি সহজে তিন-চার গুণ ওজন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ডেক্সামেথাসন গ্রুপের ডেকাসন ট্যাবলেট খাওয়ায় এবং বিভিন্ন ভিটামিন ও হরমোনাল ইনজেকশন দেয়। এছাড়া ভারত থেকে চোরাপথে আসা নিষিদ্ধ পাম নামক স্টেরয়েড ট্যাবলেট মাত্রাতিরিক্ত হারে গরুকে খাওয়ায়। এসব ক্ষতিকর স্টেরয়েডের কারণে গরুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে যায়। অনেক ক্ষেত্রে অধিক মাত্রায় হরমোন প্রয়োগের কারণে গরুর ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগ হয়ে থাকে। এছাড়া এসব গরুর কিডনি অতি দ্রুত অকার্যকর হতে থাকে। ফলে শরীরে কোষের মধ্যে পানির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং দ্রুত কোষ বিভাজন হতে থাকে। এসব গরুর গোশতের গুণগত মান মারাত্মকভাবে কমে যায়।

এসব গরুর গোশত খাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা না গেলেও ধীরে ধীরে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগের সৃষ্টি হয়। এসব পশুর গোশতের মাধ্যমে গ্রহণকৃত অতিরিক্ত স্টেরয়েডের প্রভাবে কিডনি ও লিভার নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া অনেক সময় ছেলেমেয়েদের অল্প বয়সে বয়ঃসন্ধি (পিউবার্টি) চলে আসে, শিশুরা অল্প বয়সে মুটিয়ে যায় এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের চির বন্ধ্যাত্ব বরণ করতে হয়। গরুতে প্রয়োগ করা স্টেরয়েডের নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই এসব গরুর গোশত খেলে নানা ধরনের স্বাস্থ্যসমস্যা আরো মারাত্মক আকারে দেখা দিতে পারে।

এসব হরমোন এতটাই ক্ষতিকর যে গোশত রান্না করার পরও তা নষ্ট হয় না। এমনকি তাপে পরিবর্তিত হয়ে জটিল রাসায়নিক পদার্থে পরিণত হয়ে স্বাস্থ্যের জন্য আরো মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই গরু-ছাগল কেনার আগে যতটা সম্ভব যাচাই-বাছাই করে নিতে হবে।

অত্যধিক মোটাতাজা পশু, যার শরীরে আঙুল দিয়ে চাপ দিলে দেবে গিয়ে ছোট গর্তের মতো সৃষ্টি হয়ে খানিকটা স্থায়ী হয়, তেমন একটা নড়াচড়া করে না, জাবর কাটে না, চোখ অনুজ্জ্বল দেখায়- এমন পশুই ক্ষতিকারক ওষুধ ব্যবহার করে মোটাতাজা করা হয়েছে বুঝতে হবে। কোরবানির পশু ক্রয়ে যে বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে, তা হলো-

০১. পশু সর্বদাই লেজ নাড়িয়ে মশা-মাছি তাড়াতে ব্যস্ত থাকবে ও কিছুক্ষণ পর পর নড়াচড়া করবে।

০২. খাবার দিলে তা স্বাভাবিকভাবে খাবে ও অবসর সময়ে জাবর কাটবে।

০৩. চোখ বড় ও উজ্জ্বল দেখাবে।

০৪. নাকের নিচের কালো অংশ (মাজল) ভেজা ভেজা থাকবে, মনে হবে যেন ফোঁটা ফোঁটা শিশির জমেছে।

০৫. শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকবে, অস্বস্থিতে ছটফট করবে না।

০৬. গরু-মহিষের ক্ষেত্রে বয়স দুই বছরের বেশি এবং ছাগল-ভেড়ার ক্ষেত্রে এক বছরের বেশি হতে হবে।

০৭. সম্ভব হলে পশুর প্রস্রাব ও গোবর স্বাভাবিক কি না তা যাচাই করতে হবে।

০৮. গর্ভবতী স্ত্রী পশু কোরবানি না করাই উত্তম।

০৯. পশুর চোখ ও কান ভালোভাবে লক্ষ করা উচিত।


সুতরাং এ ক্ষেত্রে সর্বস্তরের মানুষের সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি। এভাবে মানুষের স্বাস্থ্যহানি ঘটানো বা মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া যে মারাত্মক পাপ, তা এসব অসৎ ও মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের বুঝতে হবে ও সতর্ক করতে হবে।

এসব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে প্রশাসনের নজরদারি জোরদার করা এবং যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা খুবই জরুরি।

মসজিদের সম্মানিত ইমাম-খতিবগণ জুমার নামাজের আগে বিশেষভাবে এ বিষয়ে আলোচনা করেও জনসচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা পালন করতে পারেন।

(দিরিপোর্ট২৪/ওএস/ডব্লিউএস/জেএম/অক্টোবর ১১, ২০১৩)