টাঙ্গাইল সংবাদদাতা : একাত্তরের ১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল জেলা পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়। ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগানে মুখরিত হয় সমস্ত শহর। ঘরে ঘরে উত্তোলিত হয় দেশের মানচিত্র খচিত লাল সবুজ বিজয় পতাকা।

মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর যৌথ অভিযান, মিত্র বাহিনীর বিমান হামলা ও ছত্রীবাহিনীর জেলার বিভিন্ন স্থানে অবতরণের পর ৭ ডিসেম্বর থেকেই ভীত হানাদার বাহিনী ঢাকার দিকে পালাতে থাকে। ১০ ডিসেম্বর কিছু হানাদার ছাড়া পুরো বাহিনী ঢাকার পথে চলে যায়। পালিয়ে যায় আলবদর, রাজাকার ও শান্তি কমিটি নামধারী দুর্বৃত্তরা। ১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলে অবরুদ্ধ তিন শতাধিক পাক হানাদার কাদেরিয়া বাহিনী প্রধান কাদের সিদ্দিকীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে টাঙ্গাইল হানাদার মুক্ত হয়।

দেশের মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত টাঙ্গাইল জেলা মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ২৬ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত টাঙ্গাইল ছিল স্বাধীন। এ সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রশাসন পরিচালিত হয়। ২৬ মার্চ সকালে আদালত পাড়ার অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলামের বাসভবনে এক সভায় গঠিত হয় টাঙ্গাইল জেলা স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদ। তৎকালীন এমপিএ ও আওয়ামী লীগ নেতা বদিউজ্জামান খানকে চেয়ারম্যান ও আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এমপিএকে আহ্বায়ক ও সশস্ত্র গণবাহিনীর প্রধান এবং আরো ৮ জনকে সদস্য করে কমিটি গঠিত হয়।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ৩ এপ্রিল টাঙ্গাইল শহর দখল করে। টাঙ্গাইল আসার পথে মির্জাপুরের সাটিয়াচরায় হানাদার বাহিনীর সাথে বাঙালি ইপিআর সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী পিছু হটলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সেখানে গণহত্যা চালায়। তারা গ্রামে ঢুকে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগও করে। টাঙ্গাইল দখলের পর কালিহাতী ও মধুপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা এখানেও পিছু হটতে বাধ্য হয়।

সমগ্র জেলা দখল করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শান্তি কমিটি, আলবদর বাহিনী ও রাজাকার বাহিনী গঠন করে। এরপরই শুরু হয় গণহত্যা, আগুন দিয়ে গ্রামের পর গ্রামের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া ও ধর্ষণসহ নারী নির্যাতন।

এ সময় স্বাধীনতাকামী জনগণের মধ্যে যখন চরম হতাশা নেমে আসে তখন টাঙ্গাইলের পূর্বাঞ্চলে সখিপুরের অরন্যাঞ্চলকে কেন্দ্র করে তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও পাকিস্তানি বাহিনীর সাবেক সৈনিক কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে একটি বিশাল মুক্তিবাহিনী। পরবর্তীতে সে বাহিনী ‘কাদেরিয়া বাহিনী’ হিসেবে পরিচিতি পায়। কাদের সিদ্দিকীর বিচক্ষণতা, অপূর্ব সাংগঠনিক দক্ষতা, সততা ও দক্ষ রণকৌশলের কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই এই বাহিনী একটি দুর্ধর্ষ বাহিনীতে পরিণত হয়।

এই বাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ধলাপাড়া, মাকরাই, বাথুলী, কামুটিয়া, এলাসিন ও নাগরপুরে যুদ্ধসহ অনেক স্থানে সম্মুখ যুদ্ধ ও গেরিলা যুদ্ধ হয়।

৯ আগস্ট ঢাকা থেকে বিপুল অস্ত্র ভর্তি পাকিস্তানি বাহিনীর সাতটি জাহাজ যমুনা নদী দিয়ে উত্তর বাংলা যাওয়ার পথে ভূঞাপুরের সিরাজকান্দি ঘাটে নোঙর করে। এই জাহাজের বাঙালি কর্মীরা কৌশলে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে। তাদের সহায়তায় কাদেরিয়া বাহিনীর কোম্পানী কমান্ডার হাবিবুর রহমান হাবিবের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা জাহাজে হামলা চালায়। এই হামলায় কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত ও বাকিরা পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধা এবং স্থানীয় জনগণ জাহাজ থেকে বিপুল অস্ত্র ও গুলি নামিয়ে এনে জাহাজে আগুন ধরিয়ে দেয়। এখান থেকে বিপুল অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।

কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকবার ঝটিকা অভিযান চালিয়ে বাসাইল, ঘাটাইল, গোপালপুর ও ভূঞাপুর থানা দখল করে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে কাদেরিয়া বাহিনীর তৎপরতায় জেলার অধিকাংশ গ্রামাঞ্চলই ছিল মুক্তাঞ্চল।

নভেম্বর মাসে কাদেরিয়া বাহিনীর তৎপরতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও আল বদর রাজাকাররা টাঙ্গাইল শহরে অবরুদ্ধ হয়ে পরে। মুক্তিযোদ্ধারা শহরেও পাকিস্তানি বাহিনী, রাজাকার ও আলবদরদের ওপর হামলা শুরু করলে তাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

ডিসেম্বরের প্রথম দিকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর একত্র অভিযান শুরু হলে পাকিস্তানি হানাদাররা ভয়ে ঢাকার দিকে পালাতে শুরু করে।

১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল পাক হানাদার মুক্ত হয়। এরপর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে টাঙ্গাইলের মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকার দিকে অগ্রসর হয়।

দিবসটি পালন করতে টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।

(দ্য রিপোর্ট/এআরটি/এমএইচও/এসকে/ডিসেম্বর ১১, ২০১৩)