thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ মে 24, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১,  ৯ জিলকদ  1445

এই পথ যদি না শেষ হয়…

২০১৪ জানুয়ারি ১৭ ১৪:২২:২৭
এই পথ যদি না শেষ হয়…

হোসেন শহীদ মজনু, দ্য রিপোর্ট : ‘এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলতো…।’ সপ্তপদীর নায়িকা সুচিত্রা সেনের পথচলা নীরবে নিভৃতেই চলছিল। তার পরও সে পথের ‘ক্লান্তি’ দূর হলো! শেষ হলো পথচলা! মহাসিন্ধুর ওপারে যেন মহানায়ক উত্তমের ডাকেই সাড়া দিলেন তিনি! লোকচক্ষুর আড়ালে নির্মোহ-নির্লিপ্ত সাধারণ জীবনে শান্তিতে থাকতে চেয়েছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়িকা সুচিত্রা সেন। ডাক্তারের চিকিৎসায় সাড়া দিতে দিতে শান্তিতেই চলে গেলেন তিনি।

বাংলাদেশের পাবনার মেয়ে রমা দাশগুপ্ত! এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে ১৯২৯ সালের ৬ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত ও মা ইন্দিরা দাশগুপ্তের পঞ্চম সন্তান ও তৃতীয় কন্যা রমা। ১৯৪৭ সালে শিল্পপতি পরিবারের সন্তান দিবানাথ সেনকে বিয়ের সূত্রে কলকাতায় পাড়ি দেন রমা। এর পর ১৯৫২ সালে `শেষ কোথায়’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ে অভিষেক। প্রথমবারই নায়িকা! রূপালী পর্দায় রমার বদলে নাম হয় সুচিত্রা সেন। তার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বাকিটা ইতিহাস…।

চলচ্চিত্রের নায়িকা সুচিত্রা আর বাস্তবের রমায় যেন অনেক ফারাক! তাই খ্যাতি-যশ জলাঞ্জলি দিয়ে তিন দশক লোকচক্ষুর আড়ালে ‘রমা’র জীবনই যেন বেছে নিয়েছিলেন সুচিত্রা। সবার কাছ থেকে, এমনকি মিডিয়ার চোখ এড়িয়ে নিজেকে আড়াল করেছেন সযতনে। এতটা আড়াল, এতটা জনবিচ্ছিন্ন তবুও সবার কত কাছের তিনি! পর্দায় যে ইমেজ তৈরি করেছিলেন; তার দ্যুতিতেই চিরজাগরুক সুচিত্রা। তাই আড়ালও কোনো ছেদ ঘটাতে পারেনি এই কিংবদন্তির সংর্স্পশ থেকে পুরো বাঙালিকে। তরুণ-যুবা-বৃদ্ধ সবাই একবাক্যে সুচিত্রাভক্ত। তার প্রয়াণে দুই বাংলার চলচ্চিত্রাঙ্গনে শুধু নয়, সাধারণ মানুষের মনেও শোকের ছায়া।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী এই কিংবদন্তির বিদায়ে শোকজ্ঞাপন করেছেন। ওপার বাংলা কলকাতার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার শোকবার্তায় বলেছেন, মহানায়িকার (সুচিত্রা) চলে যাওয়া আমাদের কাছে খুব বড় দুঃসংবাদ। বড় মহীরুহের পতন। আজকের দিন দুঃখের, শোকের। এ খবর আমাদের হৃদয় ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। তিনি একজন বিস্ময়, গভীর আশ্চর্য। নিজেকে বহুদিন আড়াল করে রেখেছিলেন। কেউ কারও বিকল্প হয় না। তার আত্মার শান্তি কামনা করি।
কলকাতার সংস্কৃতি অঙ্গনের আরও অনেকে জানিয়েছেন তাদের শোক স্তুতি।

সুচিত্রা সেন আর রোমান্টিসিজমের অঙ্গাঙ্গি যে সংযোগ, তা কোনো দিনও ম্লান হবে না বাঙালির মন থেকে। এখানে তার পথ শেষ হবে না, তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের গগণে জ্বলজ্বলে তারা হয়ে থাকবেন।

উত্তম কুমারের সঙ্গে অভিনয়ের কারণে সুচিত্রা সারা বাংলায় প্রচণ্ড জনপ্রিয় হন। উত্তম-সুচিত্রা জুটি আজও বাংলা চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ জুটি হিসেবে খ্যাত। সুচিত্রা অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে-সাড়ে চুয়াত্তর (১৯৫৩), ওরা থাকে ওধারে (১৯৫৪), অগ্নিপরীক্ষা (১৯৫৪), শাপমোচন (১৯৫৫), সবার উপরে (১৯৫৫), সাগরিকা (১৯৫৬), পথে হলো দেরি (১৯৫৭), হারানো সুর (১৯৫৭), ইন্দ্রাণী (১৯৫৮), রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত (১৯৫৮), সূর্য তোরণ (১৯৫৮), দীপ জ্বেলে যাই (১৯৫৯), সপ্তপদী (১৯৬১), বিপাশা (১৯৬২), চাওয়া-পাওয়া, সাত-পাকে বাঁধা (১৯৬৩), হসপিটাল, শিল্পী (১৯৬৫), উত্তর ফাল্গুনি (১৯৬৩), গৃহদাহ (১৯৬৭), দেবী চৌধুরানী (১৯৭৪), দত্তা (১৯৭৬), প্রণয় পাশা প্রিয় বান্ধবী

১৯৫৫ সালে দেবদাস চলচ্চিত্রের জন্য সুচিত্রা শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জেতেন, যা ছিল তার প্রথম হিন্দি ছবি। অভিনয়নিষ্ঠ সুচিত্রা তার স্বামী মারা যাওয়ার পরও অভিনয় চালিয়ে গেছেন। তার আরেক হিন্দি চলচ্চিত্র আন্ধি। এই চলচ্চিত্রে তিনি একজন নেত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। বলা হয় যে চরিত্রটির প্রেরণা নিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে।আন্ধির জন্য ফিল্ম ফেয়ার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে মনোনয়ন পান। এ চলচ্চিত্রে তার স্বামী চরিত্রে অভিনয় করা সঞ্জীব কুমার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পান।

১৯৬৩ সালে সাত পাকে বাঁধা চলচ্চিত্রের জন্য মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সুচিত্রা সেন শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পান।

১৯৭৮ সালে সুদীর্ঘ ২৫ বছরের অভিনয় জীবনের ইতি টানেন সুচিত্রা। এর পর লোকচক্ষুর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এক রকমের ‘আত্মগোপন’ জীবন বেছে নেন। ২০০৫ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন সুচিত্রা সেন। কিন্তু ভারতের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে সশরীরে পুরস্কার নিতে দিল্লি যাওয়ায় আপত্তি জানালে তাকে পুরস্কার দেওয়া হয়নি। খ্যাতির শীর্ষে ওঠা এই কিংবদন্তি চলচ্চিত্রাভিনয় ছাড়ার পর যশ-খ্যাতিকেও আমলে নেননি। রঙ্গীন পর্দার সুচিত্রা আর লোকচক্ষুর আড়ালের সুচিত্রা যেন ভিন্ন দুই মানুষ! একের সঙ্গে অন্যের তফাৎ বিস্তর! তবু তিনি আরাধ্য-বাংলা চলচ্চিত্রের আইকন।

সাফল্যের স্বর্ণশিখরে আরোহণকারী সুচিত্রা সেন এখন সকলের ধরাছোঁয়ার বাইরে। পৃথিবীর ‘এই পথ যদি না শেষ হয়/তবে কেমন হতো তুমি বলতো/যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয় তবে কেমন হতো…।’ তিনি এখন সত্যিই সেই স্বপ্নের দেশে…

(দ্য রিপোর্ট/এইচএসএম/শাহ/জানুয়ারি ১৭, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

জলসা ঘর এর সর্বশেষ খবর

জলসা ঘর - এর সব খবর