thereport24.com
ঢাকা, বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১,  ১৮ জমাদিউল আউয়াল 1446

চিরসবুজ উত্তম-সুচিত্রা

২০১৪ জানুয়ারি ১৭ ১৬:৫৫:৫১
চিরসবুজ উত্তম-সুচিত্রা

আদিত্য রুপু, দ্য রিপোর্ট : ১৯৭৮ সালে ‘প্রণয় পাশা’ ছবিতে অভিনয়ের পর সুচিত্রা সেন লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান- কিন্তু কী অভিমানে তিনি সবার অন্তরালে চলে গেলেন- সেই রহস্য তার জীবদ্দশায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

এই বিষয়ে নানাজনের মত কিছুটা রূপকথার মতোই শোনায়। তবে কেউ কেউ মনে করেন, এই ‌’আড়ালজীবন’ উত্তম কুমার ছাড়া অন্য কারও জন্য নয়। কেননা ১৯৮০ সালে মহানায়ক উত্তম কুমারের জীবনাবসানের পর থেকেই মুলত নিভৃত জীবনযাপন করতেন সুচিত্রা। বাংলা চলচ্চিত্রের চিরসবুজ জুটি উত্তম-সুচিত্রা এখনও বাঙালির হৃদয় এবং মস্তিস্কের পুরোটা জুড়ে স্থায়ী আসন পেতে বসে আছেন। যে আসন আর কারও নয়।

সুচিত্রার হাত ধরেই বদলে যায় বাংলা চলচ্চিত্রের নায়িকার সংজ্ঞা। সুচিত্রার চাহনি, কটাক্ষ, হাসি; অভিনয় প্রতিভায় মগ্ন হয়েছিলেন আবালবৃদ্ধবণিতা। এই সময় তৈরি হয় অবিস্মরণীয় উত্তম-সুচিত্রা জুটি। মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে জুটি বেঁধে সুচিত্রা সেন বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগে উপহার দেন একের পর এক সুপারহিট ছবি। বস্তুত সুচিত্রার জীবনের প্রথম হিট ছবি “‌সাড়ে চুয়াত্তরে”ই প্রথম দেখা মেলে বাংলা চলচ্চিত্রের চির রোমান্টিক চিরসবুজ এই জুটির।

বাংলা চলচ্চিত্রে জুটিপ্রথার প্রচলন ছিল শুরু থেকেই। আছে এখনও। দর্শক ভালবাসে, গ্রহণ করে, আগ্রহ দেখায় এমন অভিনেতা-অভিনেত্রীই পরবর্তী সময়ে জুটি হয়ে যায়, যাদেরকে একসঙ্গে পর্দায় দেখলে উল্লসিত হয়। বিশ্ব চলচ্চিত্রের মতো আমাদেরও আছে তেমন কিছু স্বর্ণজ্জ্বোল জুটি। তবে উত্তম-সুচিত্রা জুটির সম্মান ও স্থান সর্বাগ্রে, সবার ওপরে।

বাঙালি জানেন, উত্তম কুমারের সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয়ের জন্যই মূলত সুচিত্রা সেন আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তায় পৌঁছান। উত্তম-সুচিত্রা জুটি আজও বাংলা চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ জুটি হিসেবে বিবেচিত। এ প্রসঙ্গে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ফরিদুর রেজা সাগর বলেন, ‌উত্তম-সুচিত্রার চর্চা থেকে দূরে বলেই আমাদের এ সময়ের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অভিনয়ে নিজেদের নামকে অনন্য উচ্চতায় ওঠাতে ব্যর্থ হচ্ছে।

উত্তম কুমারের সঙ্গে অভিনয়ের জন্য তিনি সারা বাংলায় শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক জুটি হিসেবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করেন এবং বাঙালির কাছে ‘স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’-র আসন লাভ করেন। দীর্ঘ ২৫ বছরের অভিনয় জীবনে সুচিত্রা সেন অভিনীত বাংলা ছবির সংখ্যা ৫৩ ও হিন্দি ছবির সংখ্যা ৭। এর মধ্যে ৩২টি ছবির নায়ক ছিলেন উত্তম কুমার।

উত্তম কুমারের সঙ্গে সুচিত্রা অভিনীত চলচ্চিত্রের তালিকাটি এমন : সাড়ে চুয়াত্তর (১৯৫৩), সদানন্দের মেলা (১৯৫৪), ওরা থাকে ওধারে (১৯৫৪) অগ্নিপরীক্ষা (১৯৫৪), গৃহপ্রবেশ (১৯৫৪),মরণের পরে (১৯৫৪) অন্নপূর্ণার মন্দির (১৯৫৪), শাপমোচন (১৯৫৫), সবার উপরে (১৯৫৫), সাঁঝের প্রদীপ (১৯৫৫), সাগরিকা (১৯৫৬), শিল্পী (১৯৫৬), একটি রাত (১৯৫৬), শুভরাত্রি (১৯৫৬), ত্রিজামা (১৯৫৬), পথে হল দেরি (১৯৫৭), হারানো সুর (১৯৫৭), চন্দ্রনাথ (১৯৫৭), জীবন তৃষ্ণা (১৯৫৭), ইন্দ্রাণী (১৯৫৮), রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত (১৯৫৮), সূর্য্য তোরণ (১৯৫৮), দীপ জ্বেলে যাই (১৯৫৯), চাওয়া-পাওয়া (১৯৫৯), হসপিটাল (১৯৬০), স্মৃতিটুকু থাক (১৯৬০), সপ্তপদী (১৯৬১), বিপাশা (১৯৬২), আমার দেশ (১৯৬২), উত্তর ফাল্গুনি (১৯৬৩), গৃহদাহ (১৯৬৭), কমললতা (১৯৬৯), নবরাগ (১৯৭১), আলো আমার আলো (১৯৭২), হার মানা হার (১৯৭২) ও প্রিয় বান্ধবী (১৯৭৫ )

বাংলা চলচ্চিত্রের অবিসংবাদিত এই জুটিকে অবিস্মরণীয় করে রাখার মতো তেমন কোনো উদ্যোগ এখনও চোখে পড়ে নি। মানুষের ভালোবাসাই এখনও পর্যন্ত এই জুটির একমাত্র সম্বল। সম্প্রতি এই জুটিকে নিয়ে কিছু করার তাগিদ দিয়ে কলকাতার আনন্দ বাজার পত্রিকার সম্পাদকীয়তে একটি রচনা ছাপা হয়।

যার শিরোনাম ছিল ‍‘জুটির ষাট উত্তম-সুচিত্রা’। আনন্দবাজার সংক্ষিপ্ত এই রচনায় মূলত উত্তম-সুচিত্রা জুটিকে নিয়ে লেখক ও সংশ্লিশষ্টদেরকে বইপত্র করার কথা উল্লেখ করেন। পাঠকদের স্বার্থে ভাষারীতি ঠিক রেখে সেই লেখাটি হুবহু পত্রস্থ করা হল- “প্রায় আড়াই দশক ধরিয়া তিরিশটি চলচ্চিত্রে বক্স অফিস কাঁপাইয়া কিংবদন্তি হইয়া আছে যে উত্তম-সুচিত্রা জুটি তাহার হীরক জয়ন্তীর তারিখটি পার হইয়া গেল ২০ ফেব্রুয়ারি।

বচ্ছরভর উপলক্ষের সন্ধানে ফিরিয়া বেড়ায় যে বইপাড়া, অকিঞ্চিতকর লেখক কিংবা বিষয়েরও নানা জয়ন্তী উপলক্ষে গ্রন্থপ্রকাশে যাহার বিরাম নাই সেখানেও এই জুটির ষাট বতসরকে স্মরণীয় করিয়া রাখিবার কোনও উদ্যোগ দৃষ্টিগোচর হইতেছে না। ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ নির্মল দে পরিচালিত ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিটি মুক্তি পায়।

ছবিটির জনপ্রিয়তা আজও অমলিন। সেই ছবিতেই প্রথম উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন জুটির অভিনয় দেখা যায়, যদিও এক বতসর পরে অগ্রদূতের ‘অগ্নিপরীক্ষা’য় ওই জুটির চূড়ান্ত সাফল্য। কিন্তু বঙ্গীয় বইপাড়ায় বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের ন্যায় এই হীরক জয়ন্তীও উপেক্ষিত থাকিয়া গেল। সমাজবিজ্ঞান কিংবা মিডিয়া স্টাডিজের দিক হইতে বাঙালি সমাজে এই জুটির অবস্থানটি গভীর ভাবে অদ্যাপি কেহ বিচার করেন নাই।

অত গম্ভীর কাজের কথা না হয় ছাড়িয়া দিলাম, হাত বাড়াইলেই যে রহিয়াছেন বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের সংগ্রাহকেরা। তাঁহাদের কেহ কেহ তিল তিল করিয়া সযত্নে সংগ্রহ করিয়াছেন উত্তমকুমার-অভিনীত সকল চলচ্চিত্রের পুস্তিকা ও বিবিধ স্মারক। সেই সংগ্রহকে কাজে লাগাইয়া সহজেই প্রকাশিত হইতে পারে দৃষ্টিনন্দন কফিটেবল গ্রন্থ। কেবল হাতের কাছের খবরগুলি রাখা দরকার, আর দরকার নড়িয়া বসা।’’

বৈবাহিক জীবন সুখের হলেও উত্তম-সুচিত্রা জুটির সম্পর্ক নিয়ে জল কম ঘোলা হয়নি। সুচিত্রার অন্যসব কর্মের মতোই এই বিষয়েও রয়েছে অপার রহস্য। এরইমধ্যে অবশ্য কালজয়ী জুটি উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন-এর সম্পর্ক এবং জুটিপ্রথা নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে। লেখিকা মৈত্রেয়ী বি চৌধুরীর লেখা এই বইটির নাম ‘উত্তম কুমার অ্যান্ড সুচিত্রা সেন : বেঙ্গলি সিনেমাস ফার্স্ট কাপল’।

বইটিতে উত্তম-সুচিত্রা সম্পর্কের বাইরে আরও জানা গেছে, বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন ‘‌মিস্টিক’ শিরোনামে সুচিত্রার একটি স্কেচ এঁকেছিলেন। উত্তম-সুচিত্রা সম্পর্কে বইটির লেখিকা মৈত্রেয়ী বলেন, ‘উত্তম ও সুচিত্রার মধ্যে একে অপরের প্রতি চমৎকার শ্রদ্ধাবোধ ছিল। সুচিত্রাকে সহশিল্পী ও ব্যক্তি হিসেবে অনেক সমীহ করতেন উত্তম। তিনি বলতেন, ‘সুচিত্রাকে আমি ভালোবাসি। তবে এই ভালোবাসা ভিন্নরকম।’

রমা দাশগুপ্ত ওরফে সুচিত্রা সেন আসলে শুধু একটা নাম নয়! তিনি বাঙালি হৃদয়ে একটা মিথ। এত বছর অন্তরালে থেকেও তার জাদুতে এখনও সবাই সমান মগ্ন। বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি তার আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তায়। বাঙালির কাছে নায়িকা শব্দটির সমার্থক শব্দ- সুচিত্রা সেন। তিনি চলে গেলেন। কিন্তু রেখে গেছেন যে কীর্তি তা ভোলার নয়।

(দ্য রিপোর্ট/এআর/এইচএসএম/আরকে/জানুয়ারি ১৭, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

জলসা ঘর এর সর্বশেষ খবর

জলসা ঘর - এর সব খবর