thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ১০ মে 24, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১,  ২ জিলকদ  1445

তিনটি ইচ্ছা পূরণ হয়নি সুচিত্রার

২০১৪ জানুয়ারি ২০ ১১:৩২:৫৩
তিনটি ইচ্ছা পূরণ হয়নি সুচিত্রার

সোহেল রহমান, দ্য রিপোর্ট : তিনটি ইচ্ছা ছিল সুচিত্রা সেনের। এর একটি হচ্ছে- শরৎচন্দ্রের ‘চরিত্রহীন’-এর ‘কিরণময়ী’ চরিত্রটি করার প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল তার। দ্বিতীয়টি হলো- ‘মা সারদাময়ী’র ভূমিকায় অভিনয় করা এবং তৃতীয় ইচ্ছাটি ছিল- এক দিনের জন্য হলেও যাত্রায় অভিনয় করা। সুচিত্রার এক দূরসম্পর্কের বোন যাত্রায় অভিনয় করতেন। তাকে দেখেই এ ইচ্ছা জেগেছিল। এ তিনটি ইচ্ছার একটিও পূরণ হয়নি তার। ইচ্ছা পূরণের এই অতৃপ্ততা নিয়েই চলে গেলেন সুচিত্রা।

প্রায় ১২ বছর আগে নিজের জন্মদিনে একান্ত ঘরোয়া আলাপে সুচিত্রার কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত সাংবাদিক গোপালকৃষ্ণ রায়কে এ ইচ্ছা তিনটির কথা জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু স্বেচ্ছায় পর্দার অন্তরালের যে নির্বাসিত জীবন তিনি বেছে নিয়েছিলেন, এতে তার এই ইচ্ছা পূরণের কোনো সুযোগ ছিল না।

কিন্তু কেন তিনি এই স্বেচ্ছা নির্বাসন বেছে নিয়েছিলেন- এ নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলছেন। অনেক লেখালেখিও হয়েছে, কিন্তু প্রকৃত কারণ এখনও অজানাই রয়ে গেছে। যদি সুচিত্রা নিজে কখনও কাউকে এ বিষয়ে কিছু বলে গিয়ে থাকেন কিংবা তার পরিবারের সদস্যরা (মুনমুন সেন কিংবা তার দুই নাতনি) যদি কখনও এ বিষয়ে মুখ খুলেন, তখন হয়ত প্রকৃত সত্য জানা যাবে।

অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায় সুচিত্রাকে নিয়ে তার এক লেখায় লিখেছেন, ‘কার একটা লেখায় যেন পড়েছিলাম, উনি নাকি চান, তার যে চেহারাটা লোকের মনে গেঁথে আছে, সেটাই চিরদিনের মতো থেকে যাক। সে জন্যই নাকি উনি বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন না। আমি অন্তত এ কথাটা বিশ্বাস করি না। আরও-আরও কোনো গোপন কারণ আছে হয়ত, যেটা কেউ জানে না।’ এর পেছনে সুচিত্রা সেনের কোনো কষ্ট বা অভিমানও থাকতে পারে বলে ওই লেখায় ইঙ্গিত দেন মাধবী।

তবে নেপথ্য কারণ যাই হোক, তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা, খ্যাতি ও অর্থের মোহ ত্যাগ করে নির্বাসিত জীবনযাপনের যে কঠিন অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত সুচিত্রা নিয়েছিলেন, তার ওই সিদ্ধান্তই সকল দর্শক ও ভক্তকূলের কাছে তাকে চির আবেদনময়ী করে রেখেছে।

তবে রূপালী জগতকে বিদায় জানানোর পর গোড়ার দিকে তিনি অতটা রক্ষণশীল ছিলেন না। মাঝে মধ্যে সান্ধ্যভ্রমণে বের হতেন, টুকটাক জিনিস কিনতে যেতেন এখানে সেখানে। রাসেল স্ট্রিটের এক বিউটি পার্লারে যেতেন, কখনও আবার বেলুর মঠেও ঘুরতে যেতেন। কিন্তু ক্রমশই তিনি হয়ে উঠেন কট্টর পর্দানসিন নারী। শুধু তাই নয়, বাড়িতে ফোন ধরতে বা ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলতেও অনীহা প্রকাশ করতেন তিনি। অনেকেই সুচিত্রা সেনকে সামনা-সামনি না দেখতে পারার জন্য আফসোস করে থাকেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, খোদ টালিগঞ্জের বহু অভিনেতা-অভিনেত্রীই তাকে স্বচক্ষে দেখেননি।

সুচিত্রা সেন অভিনেত্রী হিসেবে ছিলেন অসাধারণ ও মেধাবী। পর্দায় তার ব্যক্তিত্বময়ী সাবলীল উপস্থিতি আধুনিক বাঙালি নারীর ‘আইকন’ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তাকে।

কিন্তু পর্দার বাইরে ব্যক্তি হিসেবে তিনি কেমন ছিলেন?

সুচিত্রার যারা সহশিল্পী ছিলেন এদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশের সঙ্গেই তার সম্পর্ক ছিল নিছক পেশাদারিত্বের। কারও কারও মতে, সুচিত্রাকে নিয়ে খুব বেশি কিছু বলা যায় না। সহ-অভিনেত্রীদের সঙ্গে মিশলেও নিজেকে গুটিয়ে রাখতেন তিনি। পুরুষ কো-আর্টিস্ট বা অন্যদের তিনি সম্বোধন করতেন উমুকবাবু, তমুকবাবু বলে।

উত্তম-সুচিত্রা জুটির একাধিক হিট ছবির পরিচালক বিভূতি লাহা (অগ্রদূত) সুচিত্রার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে একবার বলেছেন, ‘প্রথমদিকে সুচিত্রা ছিল খোলামেলা, সহজ সরল। পরেরদিকে নিজেকে কেমন গুটিয়ে নিয়েছিল।’

সুচিত্রা ছিলেন ভীষণ মুডি। মুড ভালো থাকলে শুটিংয়ের ফাঁকে মাঝে মধ্যে মজা বা দুষ্টুমি করতেন এবং সহকর্মীদের সঙ্গে আন্তরিক ব্যবহার করতেন। আবার কখনও যেন কাছের লোকদেরও চেনেন না- এমন ভাব দেখাতেন।

‘স্টার’ হিসেবে এক ধরনের ইগোও ছিল তার মধ্যে। স্টুডিওতে সুচিত্রা সেন গাড়ি থেকে নামলে অনেক নামিদামি পরিচালক উঠে গিয়ে তার মাথায় ছাতা ধরতেন। যাতে তার গায়ে রোদ না লাগে। ফিল্মপাড়ায় তাকে ডাকা হতো ‘ম্যাডাম সেন’ বা ‘মিসেস সেন’ বলে। শুটিং স্পটে বাইরের কোনো লোক থাকলে শট দিতে চাইতেন না এবং অনুমতি ছাড়া কেউ তার ছবি তুললে ক্যামেরা থেকে সেই নেগেটিভ বের করিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। তবে দীর্ঘ অভিনয় জীবনে সুচিত্রা সেন কাউকে কখনও এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি এবং কখনও সংবাদ সম্মেলনও করেননি।

তবে সুচিত্রাকে নিয়ে আড়ালে-আবডালে যতই নেতিবাচক কথা বলা হোক, তার পরিমিতি বোধ ছিল অসাধারণ। তিনি জানতেন, কোথায় থামতে হবে। সেটা তার ব্যক্তি জীবনেই হোক, আর অভিনয় জীবনেই হোক।

পর্দায় সুচিত্রার আবেদন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে অভিনেত্রী চন্দ্রাবতী দেবী বলেছেন, ‘পুরুষদের চোখে সুচিত্রার আবেদন এই কারণেই অদ্বিতীয় যে, যে কোনো ছবিতে, কোথাও তার প্রবল দৈহিক আবেদনকে সে নগ্নভাবে কাজে লাগায়নি। এখানেই এ যুগের বোম্বে ছবির নায়িকাদের সঙ্গে তার পার্থক্য। সুচিত্রা বাঙালি পুরুষদের কল্পনাকে প্রবলভাবে নাড়া দিতে পেরেছে, তার কারণ সে নিজেকে ঢেকে রাখতে জানে। তার সৌন্দর্য স্বপ্নকে উসকে দেয়। বাসনাকে জাগিয়ে তোলে। কিন্তু সে জানে, কোন বিন্দুর পর অভিনেত্রী হিসেবে তার দায়িত্ব ফুরিয়ে যাচ্ছে।’

প্রসঙ্গ : উত্তম-সুচিত্রা

উত্তম কুমার কিংবা সুচিত্রা সেন- এ দুইজনের যে কারও আলোচনায় এ প্রসঙ্গটি অনিবার্য। এটি না হলে যেভাবেই লেখা হোক- সে লেখা যেন অসম্পূর্ণ। উত্তম-সুচিত্রা পরস্পরের সহশিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন প্রায় ২২ বছর। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই সম্পর্কটা ছিল খুব গভীর। এটা যেমন পর্দায়, তেমনি পর্দার বাইরেও। দুইজনের সম্বোধনটা ছিল তুই-তোকারির। সুচিত্রা উত্তমকে ডাকতেন ‘উতু’ এবং উত্তম তাকে ডাকতেন ‘রমা’ বলে। এহেন সম্পর্কের মধ্যেও মান-অভিমান, ঝগড়াঝাটি ও অন্যান্য কারণে দুইজন একসঙ্গে কাজ করেননি অনেক দিন। দুইজনের ভুল বোঝাবুঝির কারণে উত্তম কুমার প্রযোজিত ‘সপ্তপদী’ ছবির শুটিং দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল।

উত্তম কুমার তার আত্মজীবনীতে সুপ্রিয়া দেবী ও সাবিত্রী চট্টপাধ্যায়ের কথা সবিস্তারে বললেও সুচিত্রা সেনকে নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো মন্তব্য করেননি। এমন কী শুটিংয়ের সেটে সুচিত্রার ব্যবহার, মেজাজ ও ইগো নিয়েও কোনো অনুযোগ বা নেতিবাচক মন্তব্য করেননি।

কিন্তু আত্মজীবনীতে কিছু না বললেও কবিতা সিংহকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উত্তম স্বীকার করেন যে, ‘ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্ট হয়েছিল। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় আর সুচিত্রা সেনের সঙ্গে।’

তবে এ কথা বলার পরপরই উত্তম যোগ করেন যে, ‘কোনো মেয়ে আমার জন্য কোনো আত্মত্যাগ করেনি।’

এ ছাড়া একদিন বালিগঞ্জে সুচিত্রা সেনের বাড়িতে এক সন্ধ্যায় উত্তম অনেকটা আবেগের বশেই সুচিত্রাকে নাকি বলেছিলেন, ‘রমা, তোমার সঙ্গে যদি আমার বিয়ে হতো …।’

উত্তমের এ কথার পর অনেকক্ষণ কারও মুখে কোনো কথা ছিল না বলে কলকাতার একজন সাংবাদিক অনেক আগে একটি সিনে ম্যাগাজিনে লিখেছিলেন।

এদিকে সুচিত্রার সঙ্গে ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্টের কথা উত্তম স্বীকার করলেও তাদের মধ্যে প্রেমের কোনো সম্পর্ক ছিল না বলে সুচিত্রা সম্পর্কিত এক লেখায় দাবি করেছেন সাবিত্রী।

সাবিত্রী লিখেছেন, ‘আড্ডা মারার সময় অনেকেই আমার কাছে জানতে চান, সুচিত্রাদির সঙ্গে উত্তমদার প্রেম ছিল কিনা? তাদের বলি, ছিল না। উত্তমদার সঙ্গে সুচিত্রাদির প্রেম হতেই পারে না।’

সিনেমায় উত্তম-সুচিত্রার রোমান্টিক দৃশ্য প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘এটা সম্ভব হয়েছে দুইজনেই উঁচু মানের অভিনয়ে সক্ষম ছিলেন বলে।’

অন্যদিকে সুচিত্রা সেনের আচরণে এরকম প্রকাশ্য কিছু জানা যায় না। কখনও কখনও ফোন করে উত্তমকে বলেছেন, ‘আমাকে ছাড়া তুমি ফাইন থাকো কী করে?’ উত্তমের ছেলে গৌতমের বিয়ের অনুষ্ঠানে এসে দুই হাত বাড়িয়ে ছুটে গেছেন তার দিকে।

উত্তম কুমারের প্রথম হার্ট অ্যাটাকের পরপরই সুচিত্রা তাকে দেখতে গিয়েছিলেন। আর উত্তম যেদিন মারা যান সে দিন মধ্যরাতে মালা হাতে তাকে শেষ অর্ঘ্য দিতে এসেছিলেন তিনি।

উত্তম কুমার সম্পর্কে সুচিত্রার মূল্যায়ন ছিল- ‘গ্রেট, গ্রেট আর্টিস্ট। তবু মনে হয় তাকে ঠিকমতো এক্সপ্লয়েট করা হয়নি।’

উত্তম কুমার তখনও জীবিত। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে কলকাতায় সুচিত্রা সেনের বাড়িতে আকস্মিকভাবে যাওয়ার সুযোগ হয় ঢাকার তরুণ আইনজীবী মোজাফফর হোসেনের। উত্তমের সঙ্গে রোমান্টিক দৃশ্যে অভিনয় প্রসঙ্গে কাহিনীর ধারাবাহিকতা ও সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত আবেগ কতটা জড়িত এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুচিত্রা তাকে বলেন, ‘দেখুন, উত্তমের সঙ্গে আমার অভিনয় ছিল না, জীবন ঘনিষ্ঠ সম্পর্কই আমাদের চলচ্চিত্র জীবনে এক অভিনব জীবন-মন আকর্ষণেই তার সঙ্গে আমার স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। উত্তম আমার অভিনয়ের ভাব-ভাষা-ভঙ্গিমা ভালো করে বুঝত বলেই হয়ত আমাদের অভিনয় এত প্রাণবন্ত হয়ে উঠত। উত্তম তার অভিনয় জীবনে আমার জীবন রূপে পরিগণিত।’

(দ্য রিপোর্ট/এসআর/এমসি/শাহ/জানুয়ারি ২০, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

জলসা ঘর এর সর্বশেষ খবর

জলসা ঘর - এর সব খবর