thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১,  ২১ জমাদিউল আউয়াল 1446

আবাসন খাতে ধস

রাজনৈতিক অস্থিরতাকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা

২০১৪ জানুয়ারি ২২ ১৬:৪৩:৫৪
রাজনৈতিক অস্থিরতাকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা

গত বছর বিরোধী দলের টানা অবরোধে আবাসন খাতে প্রায় ছয় শ’ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)। একই সঙ্গে ‘সহিংস’ রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে খাতটির সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট প্রায় দশ লাখ নির্মাণ শ্রমিক বেকার হতে চলেছে বলেও দাবি এই আবাসন কোম্পানি মালিক সমিতির।

আবাসন খাতে অস্থিরতার কারণ হিসেবে ‘সহিংস’ রাজনৈতিক পরিস্থিতির পাশাপাশি ব্যাংক ঋণের সহজলভ্যতা না থাকা, গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ না দেওয়াকেও দায়ী করেছেন তারা।

গত বছর নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে শুরু হওয়া বিরোধী জোটের ধারাবাহিক অবরোধে আবাসন নির্মাণ, নির্মাণ সামগ্রী পরিবহন, ফ্ল্যাট হস্তান্তর ও আর্থিক লেনদেন বন্ধ হয়ে যায় বলে জানায় রিহ্যাব। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজ বন্ধ থাকায় রিহ্যাবের শীতকালীন আবাসন মেলাও স্থগিত করে সংগঠনটি।

রাজধানীর বিজয়নগরে একটি বহুতল বাণিজ্যিক ও আবাসিক ইমারত নির্মাণের কাজ ২০১১ সালে শুরু করে ইনডেক্স ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড। একই সঙ্গে বারিধারার ৯ নম্বর রোডে আরেকটি অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণের কাজও শুরু করে কোম্পানিটি।

বিজয়নগরে প্রকল্পটির পাইলিং ও বেজমেন্টের কাজ শেষ পর্যায়ে থাকলেও হঠাৎ অবরোধের কারণে থমকে যায় নির্মাণ কাজ। সময় মতো ইমারত সামগ্রী প্রকল্প সাইটে সরবরাহ করতে না পারায় বাধ্য হয়ে নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান।

ইনডেক্স ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান ড. আব্দুর রহিম খান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘বিজয়নগর প্রকল্পের ৪০ ভাগ ফ্ল্যাট ও নিচের শপিং কমপ্লেক্সটির দোকান বুকিং হয়ে গেছে। ২০১৫ সালের মধ্যে প্রকল্পটির ফ্ল্যাট ও দোকান হস্তান্তর শুরু করার কথা। কিন্তু বেজমেন্টের কাজ শেষ করেই হঠাৎ অবরোধের কারণে এই সাইটের সকল কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে।’

রহিম খান বলেন, ‘অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বৃষ্টি না থাকায় আবাসন খাতে বেশি কাজ হয়। কিন্তু অবরোধের কারণে এই সময়টায় কাজ বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এতে করে প্রকল্পটির কাজ সময় মতো শেষ করা সম্ভব হবে না এবং হস্তান্তরেও দেরি হবে। ফলে অধিকাংশ গ্রাহক তাদের বুকিং বাতিল করতে পারে বলে আমাদের আশঙ্কা রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বিজয়নগর প্রকল্পের মতো আমাদের আরো তিনটি প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে। এ সব প্রকল্পে মাস্টার রোলে (দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে) প্রায় পাঁচ শ’ রাজমিস্ত্রি ও লেবার কাজ করে। বর্তমানে কাজ না থাকায় এই সংখ্যা এক শ’তে নামিয়ে আনতে হয়েছে। আবার কোম্পানির নিজস্ব প্রায় ৫০ জন সুপারভাইজার ও ফোরম্যানকে বসিয়ে রেখে বেতন দেওয়া হচ্ছে। এতে করে কাজ না হলেও কোম্পানিকে লোকসান গুনতে হচ্ছে।’

আবাসন খাতে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে রিহ্যাবের সাধারণ সম্পাদক মো. ওয়াহিদুজ্জামান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় রিহ্যাব সদস্যভুক্ত অধিকাংশ আবাসন কোম্পানি তাদের ফ্ল্যাট কনস্ট্রাকশন চালাতে পারছে না। ঢাকার মধ্যে আমরা যারা ফ্ল্যাট নির্মাণ করছি তাদের কনস্ট্রাকশন সাইটগুলোতে পর্যাপ্ত জায়গা নেই কনস্ট্রাকশন মেটেরিয়ালস স্টক রাখার জন্য। তাই প্রতি সপ্তাহে সাইটগুলোতে ইট, বালু, সিমেন্ট, রড খোয়ার মতো মেটেরিয়ালস সাপ্লাই করতে হয়। কিন্তু অবরোধের কারণে এ সব সাইটে সময় মতো মেটেরিয়ালস আমরা আনতে পারছি না। এতে নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে কোম্পানিগুলো।’

ওয়াহিদুজ্জামান আরও বলেন, সাম্প্রতিক অবরোধে রিহ্যাব একটি হিসাব করে দেখেছে- শুধুমাত্র ‘রিহ্যাব শীতকালীন মেলা-২০১৩’ আয়োজন করতে না পারায় প্রায় ছয় শ’ কোটি টাকার ক্ষতি হবে আবাসন খাতে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি হবে।’

এ দিকে সংগঠনটির হিসাব অনুযায়ী শুধুমাত্র রিহ্যাবের সদস্যভুক্ত আবাসন কোম্পানিতে দশ লাখ নির্মাণ শ্রমিক সরাসরি নিযুক্ত রয়েছে। এ ছাড়া প্রায় নির্মাণ কাজ ব্যবস্থাপনায় নিযুক্ত রয়েছে ২০ হাজার, ডিপ্লোমা প্রকৌশলী হিসেবে নিযুক্ত ১০ হাজার, স্নাতক প্রকৌশলী রয়েছেন তিন হাজার, স্থপতি রয়েছেন প্রায় পাঁচ শ’ জন।

রিহ্যাব সূত্রে আরও জানা যায়, গত ২০১১-১২ অর্থবছরে আবাসন খাতে টার্নওভার হয়েছে দুই হাজার ৮০০ কোটি টাকা এবং এই খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে দুই শ’ কোটি টাকা। একই অর্থবছরে প্রায় দশ হাজার রেডি ফ্ল্যাট গ্রাহকের মাঝে হস্তান্তর করেছে আবাসন কোম্পানিগুলো। তবে চলতি অর্থবছরে আবাসন খাতে আশানুরূপ সফলতা আসবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ দিকে রিহ্যাবের দেওয়া তথ্যানুযায়ী টানা সাত বছর আবাসিক পর্যায়ে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া বন্ধ থাকায় প্রায় দুই লাখ রেডি ফ্ল্যাট গ্রাহকের মাঝে হস্তান্তর করতে পারেনি আবাসন কোম্পানিগুলো। চলতি বছর সরকারি সিদ্ধান্তে আবাসিক পর্যায়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ দেওয়া শুরু করায় এই স্থবিরতা কাটতে শুরু করেছে। সংগঠন থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে চলতি বছরের জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রতি মাসে প্রায় দেড় হাজার ফ্ল্যাট হস্তান্তর সম্ভব হয়েছে। কিন্তু নভেম্বর মাসে ধারাবাহিক হরতাল ও অবরোধের কারণে ফ্ল্যাট প্রস্তুত থাকলেও আর্থিক লেনদেন বন্ধ থাকায় হস্তান্তরের হার কমতে থাকে।

রিহ্যাব সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে কী পরিমাণ ফ্ল্যাট হস্তান্তর হয়েছে সে সম্পর্কে সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। তবে রিহ্যাব সদস্যভুক্ত কোম্পানিগুলোর দেওয়া তথ্যানুযায়ী ফ্ল্যাট প্রস্তুত থাকলেও অবরোধের কারণে অফিসিয়াল প্রসেসিং ও আর্থিক লেনদেন সম্ভব হচ্ছে না। এতে ফ্ল্যাট হস্তান্তরের হার বেশ কমে গেছে।’

এ ব্যাপারে রিহ্যাবের সহ-সভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া মিলন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘২০০৬ সাল থেকে আবাসন খাতে অস্থিরতা শুরু হয়। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত নতুন করে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ দেওয়া বন্ধ থাকায় এই অস্থিরতা শুরু হয়। এ ছাড়া আবাসন খাতে ব্যাংক ঋণের ওপর উচ্চ সুদ থাকায় এই সেক্টরে স্থবিরতা দেখা দেয়। কিন্তু চলতি বাজেটে আবাসন খাতের অনুকূলে ব্যাংক ঋণের সুবিধা ও সুদের হার কমানো হবে বলে আশা করেছিলাম। সে ক্ষেত্রে আমরা হতাশ হয়েছি। অনুৎপাদনশীল খাত বিবেচনা করে এই খাতে ঋণের প্রবাহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাও পাচ্ছি তার সুদের হার ২০ শতাংশের কাছাকাছি। এক দিকে যেমন ঋণ পাচ্ছি না, অন্য দিকে ক্রেতাদেরও ফ্ল্যাট ক্রয়ের জন্য ঋণ দেওয়া হচ্ছে না।’

তিনি বলেন, ‘এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও গত বছর নতুন করে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া শুরু করায় এই বছরের শীতকালীন মেলা নিয়ে আমাদের অনেক আশা ছিল। নভেম্বরের শুরুতেও আমাদের প্রস্তুতি ছিল বিগত বছরগুলোর তুলনায় সন্তোষজনক। কিন্তু নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে শুরু হওয়া অবরোধের কারণে আমাদের সকল আশা ও সম্ভাবনা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।’

লিয়াকত আলী বলেন, ‘ইতোমধ্যে রড ও সিমেন্টের দাম বাড়তে শুরু করেছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের ‘রিহ্যাব শীতকালীন মেলা-২০১৩’র জন্য যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তা বন্ধ করতে হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা শের-ই-বাংলা নগরে জানুয়ারিতে শুরু হওয়া বাণিজ্য মেলার সঙ্গে সমন্বয় রেখে বাণিজ্য মেলার পাশে বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে মেলার আয়োজন করি। প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে রিহ্যাবের শীতকালীন মেলাটি শুরু হয়। কিন্তু রিহ্যাব সদস্যভুক্ত কোম্পানিগুলো সময় মতো ফ্ল্যাট প্রস্তুত করতে না পারায় এ বারের মেলা আমরা পিছাতে বাধ্য হয়েছি। এ বারের মেলা আয়োজন করা সম্ভব হবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।’

রিহ্যাব সহ-সভাপতি আরও বলেন, ‘প্রতি বছর ঢাকা ও চট্টগ্রামে একযোগে দুটি এবং দেশের বাইরে একটি আবাসন মেলার মাধ্যমেই আমাদের ব্যবসাটি টিকে আছে। মেলার মাধ্যমেই ৬০ শতাংশ ক্রেতা ফ্ল্যাট ক্রয় ও বুকিং করেন।’

(দ্য রিপোর্ট/এইচআর/এইচএসএম/এএল/এনআই/জানুয়ারি ২২, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

বিশেষ সংবাদ এর সর্বশেষ খবর

বিশেষ সংবাদ - এর সব খবর