thereport24.com
ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১,  ৮ জমাদিউস সানি 1446

কোল্ড ইনজুরিতে নষ্ট হচ্ছে বোরো ধানের বীজতলা

২০১৪ জানুয়ারি ২৬ ১৮:৩৯:৫২
কোল্ড ইনজুরিতে নষ্ট হচ্ছে বোরো ধানের বীজতলা

মতিনুজ্জামান মিটু, ঢাকা ও রিফাত রহমান, চুয়াডাঙ্গা : প্রচণ্ড ঠাণ্ডাজনিত সংক্রমণে (কোল্ড ইনজুরি) সারা দেশে নষ্ট হচ্ছে বোরো ধানের বীজতলা।

শৈত্যপ্রবাহ, প্রচণ্ড শীত ও কুয়াশার প্রকোপে চলতি রবি মৌসুমে হুমকির মুখে পড়েছে বোরো ধানসহ ৫১ দশমিক ৬০ লাখ হেক্টর জমির শীতকালীন ফসলের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা।

আবহাওয়া পাল্টে যাচ্ছে। তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে। প্রচণ্ড শিশির পড়ছে। কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ছে দেশ। অনেক জায়গায় সকাল ১০টায়ও সূর্যের দেখা মিলছে না। হুমকির মুখে রবি শস্যসহ দেশের জীববৈচিত্র্য। প্রকৃতির এই বিরূপ আচরণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে বোরো বীজতলার।

ই-এগ্রিকালচার বিশেষজ্ঞ ম. নজরুল ইসলাম এ ব্যাপারে দ্য রিপোর্টকে বলেন, প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় বা কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হলে বোরো ধানের বীজতলার চারা মরে যেতে পারে। এখন চারা যাতে না মরে যায়, তার জন্য প্রথম শর্ত হল, মশারি বা পলিথিন দিয়ে বীজতলাকে ঢেকে রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, সন্ধ্যা থেকে বীজতলা পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে। সকাল ১০-১১টায় কুয়াশা কেটে গেলে ওই পানি বের করে ইউরিয়া ছিটিয়ে দিতে হবে। এতে বীজতলার চারা স্বাভাবিকভাবে বাড়তে পারবে।

নজরুল ইসলাম বলেন, এই শীতে অন্য ফসলেরও ক্ষতি হবে। ফসলের বাড়-বাড়ন্ত ঠিকমত হবে না। অনেক ক্ষেত্রে গাছ হলুদ হয়ে যাবে। সূর্যের আলো না পেলে সালোক-সংশ্লেষণ হবে কী করে?

কম তাপমাত্রায় কুয়াশা ঢাকা ও আকাশ মেঘলা থাকলে পোকামাকড় ও রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। শংকরায়ণ ও পলিনেশন-শীষ গঠন ঠিকমত হয় না।

কৃষি বিশেষজ্ঞ ম. নজরুল ইসলাম বলেন, যেমন ঠাণ্ডা তেমন বেশি গরম। দুটোই ফসলের জন্য ক্ষতিকর। এতে সরিষা, মসুর, ছোলা, মুগ, মরিচ, সবজির পরাগায়ণ ব্যাহত হবে। ফলনও কমে যাবে।

তিনি বলেন, ঠাণ্ডায় পরাগায়ণ ঠিকমত না হতে পারায় গর্ভধারণে ব্যত্যয় ঘটে। এতে গমও আংশিক ও ক্ষেত্রবিশেষে চিটা হয়ে যায়। আলু ফসলে পাতা ধসা রোগ ও সরিষায় জাব পোকার আক্রমণ বেড়ে যায়।

শীতের প্রকোপ সম্পর্কে টেলিফোনে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, শীতের মেয়াদ বাড়লে বীজতলার চারা মারা যেতে পারে। হলদে হতে পারে। এখনও উল্লেখযোগ্য ক্ষতির কথা শোনা যায়নি।

ঢাকার খামার বাড়ির কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এবার ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে দেশে ৪৭ দশমিক ৮০ লাখ হেক্টর জমিতে রোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।

পাশাপাশি আলু ৪ দশমিক ৪০ লাখ হেক্টর, গম ৪ দশমিক ২০ লাখ হেক্টর, সরিষা ৫ দশমিক ২০ লাখ হেক্টর, পিঁয়াজ ১ দশমিক ৮৬ লাখ হেক্টর, রসুন দশমিক ৬৬ লাখ হেক্টর ও ভুট্টা ২ দশমিক ৭৫ লাখ হেক্টর জমিতে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়।

লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে আলু, গম ও সরিষা চাষ হয়েছে। ৪ দশমিক ৭৮ লাখ হেক্টর জমিতে আলু, ৪ দশমিক ৫১ লাখ হেক্টরে গম ও ৫ দশমিক ৩১ লাখ হেক্টরে সরিষা চাষ হয়েছে। বোরো ধান, পিঁয়াজ, রসুন ও ভুট্টা চাষ এখনও চলমান রয়েছে।

এ পর্যন্ত বোরো ধান ৩ দশমিক ১০ লাখ হেক্টরে, পিঁয়াজ দশমিক ৮৫ লাখ হেক্টরে ও দশমিক ৬৩ লাখ হেক্টরে রসুন চাষ হয়েছে।

দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলাসহ বেশ কিছু এলাকার বোরো ধানের বীজতলা কোল্ড ইনজুরি আক্রান্ত হতে শুরু করেছে। শৈত্যপ্রবাহে বোরো ধানের বীজতলা কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে চুয়াডাঙ্গা থেকে।

চুয়াডাঙ্গায় প্রথম দফায় ১০ দিন ও দ্বিতীয় দফায় চলমান ১০ দিনসহ টানা শৈত্যপ্রবাহের কারণে হাড়কাঁপানো তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশার ফলে সর্বত্র বোরো ধানের পাতু (বীজতলার স্থানীয় নাম) কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়ে শুকিয়ে গেছে। এ কারণে এবার চাষীরা তাদের আবাদ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।

চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানান, জেলায় এবার ৩৬ হাজার ৭১৪ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ জন্য চাষীরা চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় ৪০০ হেক্টর, আলমডাঙ্গা উপজেলায় ৯০০ হেক্টর, দামুড়হুদা উপজেলায় ৫৩০ হেক্টর ও জীবননগর উপজেলায় ৪৪০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের বীজতলা তৈরি করেছেন। কিন্তু ২০ দিনব্যাপী তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে গোটা জেলার অধিকাংশ বীজতলা কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়ে শুকিয়ে গেছে।

জীবননগর উপজেলার উথলী গ্রামের বোরো ধান চাষী ছমির উদ্দীন জানান, এবার তিনি ১ একর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি আগাম প্রস্তুতি হিসেবে ৫ শতক জমিতে বীজতলা তৈরি করেছেন। কিন্তু শৈত্যপ্রবাহের ফলে তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে তার বীজতলার সমস্ত চারা শুকিয়ে গেছে। আপ্রাণ চেষ্টা করেও বীজতলা ভালো রাখতে পারেননি তিনি।

ধান চাষী আব্দুল মালেক এবার ৫ বিঘা জমিতে বোরো ধানের আবাদ করার জন্য ৭ শতক জমিতে বীজতলা তৈরি করেছিলেন। কিন্তু প্রচণ্ড শীতের কারণে তারও সমস্ত বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে। এ ধরনের চিত্র জেলার প্রায় সর্বত্র।

এ ব্যাপারে চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হরিবুলা সরকার বলেন, দু’দফায় প্রচণ্ড শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে কিছু বোরো বীজতলা কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তাতে বোরো ধান আবাদের ক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনো সমস্যা হবে না। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বীজতলা থেকে সমস্ত বীজ চাষীরা মাঠে নিয়ে যাবে। তিনি এ ব্যাপারে বোরো চাষীদের প্রতিদিন ভোরে বীজতলার পানি পরিবর্তন, ভোরবেলা বীজতলায় চারার আগা থেকে শিশির ফেলে দেওয়া, রাতে বীজতলা স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা ও বীজ তলায় ধানের চারার গোড়া পর্যন্ত ছাই দিয়ে ঢেকে দেওয়া এবং আক্রান্ত বীজতলায় থিয়োভিট জাতীয় ওষুধ স্প্রে করার পরামর্শ দিয়েছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক (মনিটরিং) ম. রফিকুল ইসলাম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ঘন কুয়াশা ও শৈতপ্রবাহের কারণে বোরো চাষে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এ বিষয়ে সচেতন করার জন্য দেশের কৃষকদের অধিদফতরের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। চাষের জন্য প্রয়োজনীয় সার ও অন্য উপকরণ কৃষকদের দোরগোড়ায় রয়েছে।

তিনি বলেন, শৈত্যপ্রবাহে বোরো ধানের চারা মারা যেতে পারে। ঠাণ্ডার প্রকোপে ধসে পড়া রোগের জন্য চারা মরে যায়। কুশি অবস্থায় বাড়-বাড়ন্ত কমে যায়। গাছ হলুদ হতে পারে ইত্যাদি সমস্যার কথা জানিয়ে কৃষকদের সতর্ক করা হচ্ছে।

তিনি এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, এ সময় সরিষা ও শিমে জাব পোকার প্রাদুর্ভাব এবং আলু ও টমেটো লেটব্লাইট রোগে আক্রান্ত হতে পারে। দু’এক জায়গায় সমস্যা হলেও হতে পারে। তবে এখনও পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো খবর দফতরে এসে পৌঁছেনি। কৃষি বিভাগের উচ্চ মহল থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত কৃষি কর্মকর্তারা সজাগ রয়েছেন। আশা করা যায়, যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা ও লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব হবে।

(দ্য রিপোর্ট/এম/এসবি/সা/জানুয়ারি ২৬, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

বিশেষ সংবাদ এর সর্বশেষ খবর

বিশেষ সংবাদ - এর সব খবর