thereport24.com
ঢাকা, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১,  ২১ জমাদিউস সানি 1446

আশরাফ-মুঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে ১১ অভিযোগ

২০১৩ নভেম্বর ০৩ ০৮:৪৯:২১
আশরাফ-মুঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে ১১ অভিযোগ

একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা তৈরি ও তা বাস্তবায়নে মূল ভূমিকা রাখার অভিযোগে তখনকার আল-বদর বাহিনীর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে মামলার রায় হচ্ছে রবিবার। তবে তারা দুইজনই পলাতক রয়েছেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলিতে তারা দুজনেই জামায়াতে ইসলামীর তখনকার সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা ছিলেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে ‘সক্রিয় অবস্থান’ নেন।

স্বাধীনতার ঠিক আগে ১৯৭১ সালের ১১ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত’ আলবদর বাহিনীর ‘চিফ এক্সিকিউটর’ ছিলেন আশরাফুজ্জামান খান। আর চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ছিলেন সেই পরিকল্পনার ‘অপারেশন ইনচার্জ’।

একাত্তরে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ ও হত্যার ১১টি ঘটনায় গত ২৪ জুন বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে। পলাতক আশরাফুজ্জামান ও মুঈনুদ্দীনের অনুপস্থিতিতেই এ মামলার বিচার কাজ চলে। তাদের বিরুদ্ধে আনা ১১টি অভিযোগের প্রতিটিতেই আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ৩ (২) (এ) (জি) (এইচ) ধারা অনুযায়ী বুদ্ধিজীবী নির্মূলের পরিকল্পনা, অপহরণ ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে, যা মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ।

অভিযোগ-০১: ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর ভোর ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার মধ্যে আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের নির্দেশে ৭-৮ সশস্ত্র আলবদর সদস্য সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে চামেলীবাগে তার নিজ বাড়ি থেকে অপহরণ করে ইপিআরটিসির একটি মিনিবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়নি।

অভিযোগ-০২: ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর ভোর ৪টা-সাড়ে ৪টার দিকে এই দুইজনের উপস্থিতিতে আলবদর বাহিনীর ৮-১০ জন সশস্ত্র সদস্য পিপিআইর প্রধান প্রতিবেদক ও কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সার্ভিসের স্টাফ রিপোর্টার সৈয়দ নাজমুল হকের পুরানা পল্টনের বাসায় জোর করে প্রবেশ করে বন্দুকের মুখে তাকে ইপিআরটিসির একটি মিনিবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। তার মৃতদেহও পরবর্তীতে পাওয়া যায়নি।

অভিযোগ-০৩: ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর ভোর ৬টা থেকে সাড়ে ৬টার মধ্যে আশরাফ-মুঈনুদ্দীনের নির্দেশে পাঁচ-ছয়জন সশস্ত্র আলবদর সদস্য দৈনিক পূর্বদেশের প্রধান প্রতিবেদক এএনএম গোলাম মুস্তাফাকে তার গোপীবাগের বাসা থেকে দৈনিক পূর্বদেশের কার্যাশলয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ইপিআরটিসির একটি মিনিবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায় এবং হত্যা করে। তার মৃতদেহও পরবর্তীতে পাওয়া যায়নি।

অভিযোগ-০৪: ১২ ডিসেম্বর দুপুরে এই দুইজনের নির্দেশে সশস্ত্র আলবদর সদস্যরা পিপিআইর মহাব্যবস্থাপক ও বিবিসির প্রতিবেদক নাজিম উদ্দিন আহমেদের কলতাবাজারের বাসায় জোর করে প্রবেশ করে এবং তাকে আলবদরের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ইপিআরটিসির একটি মিনিবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে হত্যা করে। তার মৃতদেহও পাওয়া যায়নি।

অভিযোগ-০৫: ১৩ ডিসেম্বর দুপুরে এ দুই আসামির উপস্থিতিতে একদল সশস্ত্র আলবদর সদস্য দৈনিক শিলালিপির সম্পাদক সেলিনা পারভীনকে তার নিউ সার্কুলার রোডের বাসা থেকে বন্দুকের মুখে অপহরণ করে আলবদরের সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ইপিআরটিসির একটি মিনিবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে হত্যা করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৭ ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়।

অভিযোগ-০৬: ১৩ ডিসেম্বর সকাল ৮টা থেকে পৌনে ১০টার মধ্যে এই দুই আলবদর নেতার উপস্থিতিতে পাঁচ-ছয়জন সশস্ত্র সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ড. সিরাজুল হক খান, ড. মো. মর্তুজা, ড. আবুল খায়ের, ড. ফয়জুল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা ও ড. সন্তোষ ভট্টাচার্যের বাসায় ঢুকে তাদের বন্দুকের মুখে একটি মিনিবাসে তুলে মিরপুরের বধ্যভূমি এলাকায় নিয়ে যায় এবং হত্যা করে।

১৬ ডিসেম্বরের পরে মিরপুর বধ্যভূমি থেকে অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ড. মো. মর্তুজা, ড. আবুল খায়ের, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা ও ড. সন্তোষের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। বাকি দুজনের লাশ পাওয়া যায়নি।

অভিযুক্ত আশরাফুজ্জামানের নাখালপাড়ার বাসা থেকে উদ্ধার করা তার ব্যক্তিগত দিনপঞ্জিতে ‘বুদ্ধিজীবী হত্যা’র লক্ষ্য হিসেবে অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদের নাম পাওয়া যায়।

অভিযোগ-০৭: ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর দুপুর ১২-১টার দিকে আশরাফ-মুঈনুদ্দীনের উপস্থিতিতে ৭/৮ জন সশস্ত্র আলবদর সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর বাসায় জোর করে ঢুকে পড়ে। এ সময় অধ্যাপক মোফাজ্জলের ভাই তৎকালীন বাংলা বিভাগের ছাত্র চৌধুরী মাঈনুদ্দীনের মুখ ঢেকে রাখা কাপড় টেনে খুলে ফেললে তার পরিচয় প্রকাশ পেয়ে যায়। এরপর আলবদর সদস্যরা অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দারকে ইপিআরটিসির একটি মিনিবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে হত্যা করে। শহীদ এ বুদ্ধিজীবীর মৃতদেহ পরে আর পাওয়া যায়নি।

বাংলা বিভাগের ছাত্র আশরাফুজ্জামানের দিনপঞ্জিতেও অধ্যাপক মোফাজ্জলের নাম ছিল।

অভিযোগ-০৮: ১৪ ডিসেম্বর দুপুর ১টা-দেড়টার দিকে এই দুই ব্যক্তির নির্দেশে তিন-চারজন সশস্ত্র আলবদর সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর সেন্ট্রাল রোডের বাসায় ঢুকে বন্দুকের মুখে তাকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে হত্যা করে। শহীদ এ বুদ্ধিজীবীর মৃতদেহ পরে আর পাওয়া যায়নি।

অভিযোগ-০৯: ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় অভিযুক্ত দুই ব্যক্তির উপস্থিতিতে ৫/৬ জন সশস্ত্র আলবদর সদস্য দৈনিক সংবাদের যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সারকে তার কায়েতটুলীর বাসা থেকে বুন্দকের মুখে অপহরণ করে এবং ইপিআরটিসির মিনিবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে হত্যা করে। শহীদুল্লাহ কায়সারের মৃতদেহ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

অভিযোগ-০১০: ১৫ ডিসেম্বর দুপুর ২টা-৩টার দিকে এ দুই ব্যক্তির উপস্থিতিতে আলবদর সদস্যরা চিকিৎসক মো. ফজলে রাব্বিকে তার সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে বন্দুকের মুখে মোহাম্মদপুরে শারীরিক শিক্ষা কলেজে আলবদরের সদর দপ্তরে নিয়ে যায়। সেখান থেকে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে তাকে হত্যা করা হয়।

স্বাধীনতার পরে ১৮ ডিসেম্বর শহীদ এ চিকিৎসকের মৃতদেহ ওই বধ্যভূমি থেকে উদ্ধার করা হয়।

অভিযোগ-০১১: ১৫ ডিসেম্বর বিকাল সাড়ে ৩টা-৪টার দিকে সশস্ত্র আলবদর সদস্যরা দুই আসামির নির্দেশে চিকিৎসক আলিম চৌধুরীর পুরানা পল্টনের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। ওই বাড়ির নিচতলায় আলবদরের সংগঠক মাওলানা মান্নান থাকতেন। এরপরে তিনজন আলবদর সদস্য আলিম চৌধুরীকে বন্দুকের মুখে অপহরণ করে ইপিআরটিসির মিনিবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। স্বাধীনতার পরে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে চোখ বাঁধা অবস্থায় পাওয়া যায় আলিমের মৃতদেহ।

পরে তার স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী জানতে পারেন, আলবদরের নেতৃত্বে ছিলেন আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীন।

আসামির অনুপস্থিতিতে ট্রাইব্যুনালে বিচার শেষে রায়ের পর্যায়ে আসা দ্বিতীয় মামলা এটি। এর আগে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার হয় এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে তার ফাঁসির আদেশ দেন বিচারক। পলাতক থাকায় তার ক্ষেত্রে আপিল প্রযোজ্য হবে না।

আশরাফুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের বেজড়া ভাটরা (চিলেরপাড়) গ্রামে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তা মো. শাহজাহান কবীর।

আর চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের বাড়ি ফেনীর দাগনভুঞার চানপুরে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করেন মো. আতাউর রহমান।

আশরাফুজ্জামান বর্তমানে আছেন যুক্তরাষ্ট্রে এবং চৌধুরী মুঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে রয়েছেন।

(দিরিপোর্ট২৪/ওএস/জেএম/নভেম্বর ০৩, ২০১৩)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর

জেলার খবর - এর সব খবর