thereport24.com
ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১,  ২২ জমাদিউস সানি 1446

রাজা রামমোহন রায় ও একেশ্বরবাদ

২০১৪ ফেব্রুয়ারি ০৭ ০০:৩৯:০৭
রাজা রামমোহন রায় ও একেশ্বরবাদ

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : ১৮ শতকের বাঙালী সংস্কারকদের অন্যতম রাজা রামমোহন রায়। তিনি হিন্দুধর্মের প্রচ্ছন্ন একশ্বেরবাদকে সমাজে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্মের মধ্যে যুক্তি বুদ্ধিকে প্রতিষ্ঠার ব্রত নেন। এছাড়া হিন্দু সমাজে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা কিছু প্রথার মূলে কুঠারাঘাত করেন। যেমন- সতীদাহ। তার সঙ্গে এগিয়ে এসেছেন আরও অনেকে। সেখানে হিন্দুধর্ম নতুন দার্শনিক, নৈতিক ও ব্যবহারিক মর্ম ধারণ করে। তাকে দেখা হয় ভারতীয় ধর্মীয়-সামাজিক পুনর্গঠন আন্দোলন ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা এবং বাঙালি দার্শনিক ও আধুনিক অগ্র দৃষ্টিমান চিন্তানায়ক ও বাংলার নবজাগরণের অগ্রদূত হিসেবে। বাংলা গদ্যে তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। তৎকালীন রাজনীতি, জনপ্রশাসন, ধর্মীয় ও শিক্ষাক্ষেত্রে তার উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিল।

রাজা রামমোহন রায় ১৭৭২ সালে হুগলি জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। রামাকান্ত রায় এবং তারিণী দেবীর সন্তান রামমোহন খুবই মেধাবী ছিলেন। তিনি সংস্কৃত, আরবী, উর্দু, ফারসী ও ইংরেজি ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন। এ ছাড়া হিব্রু, গ্রিক ও সিরীয় প্রভৃতি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। ইসলাম, খ্রিষ্ট ও বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান ছিল। ১৮৩০ সালে খেতাবসর্বস্ব মুঘল সম্রাট রামমোহন রায়কে ‘রাজা’ উপাধি দেয়। ১৮৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হয়ে ইংল্যান্ডের বিস্টলে মৃত্যুবরণ করেন। বিস্টল আরনস ভ্যাল সমাধিস্থলে তাকে সমাহিত করা হয়।

তিনি ১৮০৩ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর দেওয়ানরূপে রংপুরে কাজ করেন। ১৮১৫ সাল থেকে কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা হন, এখন থেকেই প্রকাশ্যে তার সংস্কার-প্রচেষ্টার শুরু। তার প্রথম প্রকাশিত বই ফারসী ভাষায় লেখা (ভূমিকা অংশ আরবীতে) ‘তুহফাতুল মুবাহ হিন্দীন’। বইটিতে একেশ্বরবাদের সমর্থন আছে। এরপর একেশ্বরবাদ (বা ব্রাহ্মবাদ) প্রতিষ্ঠা করার জন্য বেদান্ত-সূত্র ও তার সমর্থক উপনিষদগুলি বাংলার অনুবাদ করে প্রচার করতে থাকেন। ১৮১৫ থেকে ১৮১৯ সালের মধ্যে প্রকাশিত হয়- বেদান্তগ্রন্থ, বেদান্তসার, কেনোপনিষদ, ঈশোপনিষদ, কঠোপনিষদ, মাণ্ডূক্যোপনিষদ ও মুণ্ডকোপনিষদ। রক্ষণশীল ব্যক্তিরা তার লেখার প্রতিবাদ করতে থাকেন। রামমোহন কটুক্তি এবং বিদ্বেষপ্রবণ প্রতিবাদের উত্তর দেন যুক্তি ও ভদ্রভাষায়। 'বেদান্তগ্রন্থ' প্রকাশের সঙ্গে তিনি ব্রহ্মনিষ্ঠ একেশ্বর উপাসনার পথ দেখালেন আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা করে। এই আত্মীয় সভাকেই পরে তিনি ব্রাহ্মসমাজ নাম ও রূপ দেন।

সে সময় রামমোহন উদার মন নিয়ে সকল গুরুত্বপূর্ণ ধর্মগ্রন্থ পড়েন। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদ যেমন ছিল তেমনি ছিল আরবী ভাষায় কুরআন এবং হিব্রু ভাষা ও গ্রীক ভাষায় বাইবেল। এ পাঠ থেকে বুঝতে পারেন সকল ধর্মেরই উদ্দেশ্য অভিন্ন- মানব জাতির নৈতিক পুনর্জাগরণ। তিনি চেয়েছেন সে নৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে সময়ের নিরিখে ব্যাখ্যা করতে। ধর্মের এই সর্বজনীন মূল্য থেকে বুঝতে পারেন হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে অন্য কোন ধর্ম গ্রহণের পেছনে কোন যুক্তি নেই। বরং, ধর্মের গোড়ামীকে মুখ্য না করে তার সর্বজনীন নৈতিক উপদেশাবলীই গুরুত্বপূর্ণ। তাই তিনি প্রতিমা পূজা বর্জন করেন এবং বিশ্বাস করতেন এক সর্বজনীন ঈশ্বর পূজায়। ১৮২৮ সালের আগস্ট মাসে তিনি ব্রাহ্ম সভা প্রতিষ্ঠা করেন। ধাপে ধাপে এর মধ্যে কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়। এমনকি বিরোধও দেখা দেয়।


একেশ্বরবাদী ধারণা সম্বলিত উপনিষদের নির্বাচিত অংশসমূহের ওপর ভিত্তি করে ব্রাহ্ম ধর্মবিশ্বাস পুনর্নিমাণের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। ব্রাহ্ম সমাজের সংশোধিত মতবাদটি ১৮৫০ সালে ‘ব্রাহ্ম ধর্ম’ অথবা ‘এক সত্য ঈশ্বরের পূজারীদের ধর্ম’ নামে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। এতে বেদের অভ্রান্ততা স্বীকার করা হলেও ব্রাহ্ম আন্দোলনে অপরিহার্য হিন্দু চরিত্র ধরে রাখা হয়।

ব্রাহ্মসমাজ তিনটি ভাগে বিভক্ত: রক্ষণশীল আদি সমাজ যারা পরিপূর্ণভাবে হিন্দু ধর্মীয় পুস্তক বিশেষ করে উপনিষদের উপর নির্ভরশীল, নববিধান সমাজ যারা হিন্দু ধর্মীয় পুস্তকের বাইরে বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা ইসলাম ধর্ম থেকে ধার করতে বলে এবং সবশেষে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ- যারা জাতপ্রথাকে অস্বীকার করে, ভিন্ন জাতের বিবাহকে মানে ও অন্যান্য ধর্মের সাথে নিজেদের মহিলাদের ব্রাহ্ম রীতি অনুযায়ী বিবাহতেও এদের আপত্তি নেই। এই ব্রাহ্মসমাজ মূলত একেশ্বরবাদী ধারণা থেকে উদ্ভুত। ব্রাহ্মসমাজের মনোযোগের প্রধান বিষয় হল- ১. একেশ্বরবাদ, ২. জাতপাত দূরীকরণ, ৩. যৌতুক প্রথার বিলোপ, ৪. সতীদাহ প্রথার বিলোপ ও ৫. জ্ঞানের বিস্তার।

সারবত্তা হচ্ছে, রামমোহন রায় হিন্দুধর্মের মধ্যে খুব অনুজ্জ্বলভাবে বিদ্যমান একেশ্বরবাদীতাকে তার ধর্মের চালিকাশক্তি করেন। এর বাইরের দিকটি ছিল ইসলাম ও খ্রিষ্টান ধর্মের মতো একশ্বেরবাদের সঙ্গে যুক্ততা। কারণ রাজনৈতিক, জ্ঞানগত ও ধর্মীয় দিক থেকে হিন্দুধর্মের বহু ঈশ্বরবাদ ও জাতপ্রথা নানাভাবে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছিল বলে তারা মনে করতেন। যা একইসঙ্গে নব্য শিক্ষিত ও নীচু শ্রেণীর মানুষদের ক্রমবর্ধমানহারে ধর্মান্তরিত করছিল।

মুসলিমরা যখন বাংলায় প্রবেশ করে, তখন তারা ব্রাহ্মণ রাজপূত ও অন্যান্য যুদ্ধবাজ গোত্রগুলোর উপর নিজেদের সামরিকভাবেই যে কেবল শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়েছিল তা নয়, বরং উপমহাদেশের ধর্মীয় সংস্কারেও প্রভাব বিস্তার করেছিল। যার ফলশ্রুতিতে মধ্যযুগে একেশ্বরবাদ হিন্দু সংস্কার আন্দোলনের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে যায়। এমনকি বাঙলায় লোক সমাজের ভক্তি আন্দোলনের দিকে তাকালে দেখা যায় এখানে জাতপাতহীনতা ও একেশ্বরবাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া ইংরেজদের খ্রিষ্টান ধর্ম নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয়। সেদিক থেকে হিন্দু সমাজে রামমোহনের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

(দ্য রিপোর্ট/ডব্লিউএস/একেএম/ফেরুয়ারি ০৭, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

ধর্ম এর সর্বশেষ খবর

ধর্ম - এর সব খবর