thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ ফেব্রুয়ারি 25, ২৩ মাঘ ১৪৩১,  ৭ শাবান 1446

সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ হোতাপাড়ার কবরস্থান

২০১৪ ফেব্রুয়ারি ১৭ ০৪:৪২:০৭
সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ হোতাপাড়ার কবরস্থান

মতিনুজ্জামান মিটু, দ্য রিপোর্ট : এখন ফাল্গুন মাস। চারপাশ সেজেছে বাসন্তি রঙে। কিন্তু ওদের মনে কোনো রঙ নেই। রাতে ঝরে যাওয়া প্রিয় সখিকে গোসল করানোর কাজ চলছে। শেষ বিদায়ের জন্য স্টিলের খাটিয়া এনে একটি গাছের নিচে রাখা হয়েছে। প্রিয় বান্ধবীর না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার এই কর্মযজ্ঞের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়েছিলেন তারই নির্বাসিত জীবনের সঙ্গী ষাটোর্ধ কয়েক মহিলা। চোখেমুখে তাদের আতঙ্কের ছাপ। কখন জানি তাকেও পাড়ি দিতে হবে প্রিয় সখির মতো ওই অচীন দেশে।

এদিকে দাফনের জন্য গোর (কবর) খোড়ার কাজ চলছিল বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের ভিতরের কবরস্থানে। মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধসহ সকল ধর্মের মানুষকে পাশাপাশি দাফন ও সৎকার করার এ এক অন্য রকম স্থান।

গাজীপুরের জয়দেবপুর উপজেলার মনিপুর হোতাপাড়ার বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী এই কবরস্থানের অস্তিত্বের জানান দিতে লাগানো রয়েছে একটি সাইন বোর্ড। তাতে লেখা রয়েছে মুসলিম, হিন্দু ও খ্রিষ্টান কবরস্থান।

বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের মোট ৭২ বিঘা জমির দক্ষিণাংশে গড়ে তোলা হয়েছে এই কবরস্থান। কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আবু শরীফ দ্য রিপোর্টকে বলেন, আনুমানিক ৭ থেকে সাড়ে ৭ বিঘা জমিজুড়ে কবরস্থান। এটিকে ৩ ভাগে বিভক্ত করে এক ভাগে মুসলিমদেরকে দাফন করা হয়। বাকি ২ ভাগের একটি অংশে হিন্দুদের এবং অপরভাগে খ্রিষ্টান বৌদ্ধসহ অন্যান্য ধর্মের মানুষের সৎকার হয়। স্থাপনের পর থেকে এখানে ৪০১ জন মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীকে এই কবরস্থানে দাফন এবং সৎকার করা হয়েছে।

কেন্দ্রে দায়িত্বরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, বুধবার রাতে মুসলিম ওই মহিলা মারা যান। অনেক খবর দেওয়ার পর তার ছেলে স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে মায়ের মুখ দেখতে আসেন।

তিনি বলেন, ওরা বেশিরভাগই কিছু বলতে চান না। মনে দুঃখ নিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদেন। এক মহিলা অনেক পীড়াপীড়িতে একদিন বলেছিলেন, আপন ছেলে তাঁকে চিড়িয়াখানা দেখানোর নাম করে এখানে রেখে যায়।

ওই কর্মকর্তা কাহিনীটি বলেন এভাবে, ‘স্ত্রীসহ নিজের শান্তির জন্য ওই মহিলার ছেলে একদিন মাকে বলে, মা চিড়িয়াখানা দেখতে যাবে? মা ছেলের কথায় রাজি হন। ছেলে চিড়িয়াখানায় নেওয়ার ছলে মাকে গাড়িতে তোলে। বনের মধ্যে এসে মা ছেলেকে জিজ্ঞাসা করেন, বাবা এ তো বন-জঙ্গল। চিড়িয়াখানা কই? ছেলে উত্তর দেয় এই জঙ্গলের পরেই চিড়িয়াখানা। এভাবে ভুলিয়ে এখানে এনে ছেলেটি মাকে রেখে চলে যায়।’

কর্মকর্তা বলেন, ওই মা সে সময় সব জেনে বুঝেও টুশব্দটি করেননি। আড়ালে আবডালে এসে চোখ মোছেন। আজও কাউকে তিনি সে কথা বলতে চান না।

কৃষক আয়ুব হোসেন ১ ফাল্গুন সরেজমিন কেন্দ্র পরিদর্শন করে বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে হোতাপাড়ার এই কবরস্থান। এ সময় ছেলে শামিম সিকদারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমাকে কি তোরা এখানেই রেখে যাবি?

কেন্দ্র পরিদর্শন করে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের শস্যমান ও পুষ্টি বিভাগের প্রধান ড. ম. আলী সিদ্দিকি বলেন, যা সর্বনাশ হবার তা হয়েই গেছে। ছেলেমেয়েদেরকে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা ছাড়া হৃদয় বিদারক এই ঘটনার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসা যাবে না।

তিনি বলেন, আমাদের সমাজে এখনও বাবা-মাকে উপেক্ষা করার প্রবণতা অহরহ ঘটছে। বাবা-মাকে বাইরে বা দূরে রেখে স্ত্রী ও ছেলে মেয়েদের নিয়ে বসবাসের উপযোগী অবকাঠামোও তৈরি করা হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে ছোট ছোট ফ্লাট বাড়ি। সেখানে স্বামী-স্ত্রীর এবং ছেলে মেয়েদের জন্য জায়গা থাকলেও বাবা-মায়ের জন্য কোনো রুম থাকে না।

ড. আলী আরও বলেন, এ ক্ষেত্রে বাবা মায়ের শেষ ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম ছাড়া আর কিইবা হতে পারে?

(দ্য রিপোর্ট/এম/জেএম/এএল/ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর

জেলার খবর - এর সব খবর