thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৯ মে 24, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১,  ১ জিলকদ  1445

শান্তি চুক্তির ১৯ বছরেও অস্থির পাহাড়-২

নিখোঁজ মুকুল চাকমার স্ত্রী-কন্যাও পালিয়ে বেড়াচ্ছে

২০১৬ ডিসেম্বর ২৫ ২২:৪৮:২২
নিখোঁজ মুকুল চাকমার স্ত্রী-কন্যাও পালিয়ে বেড়াচ্ছে

কাওসার আজম, পার্বত্যাঞ্চল থেকে ফিরে : সাত মাস আগে অপহৃত হয়েছেন সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট মুকুলকান্তি চাকমা (৪৫)। এ ঘটনার এক মাস চার দিন পর মামলা নিয়েছে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি থানা পুলিশ। সে মামলায় গ্রেফতার হওয়া প্রভাবশালী আসামিরা জামিনও নিয়েছেন। কিন্তু এখনো খোঁজ মেলেনি জেলার মারিস্যা এলাকার মুকুল চাকমার। তিনি এখন কোথায় আছেন, কেমন আছেন কিংবা আদৌ বেঁচে আছেন কি না জানে না তার পরিবার। প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন মুকুল চাকমার স্ত্রী সাধনা চাকমা, দুই মেয়ে অনার্সের ছাত্রী নমিসা চাকমা ও স্কুলপড়ুয়া মণীষা চাকমা। আত্মগোপনে থেকে একদিকে তারা মুকুল চাকমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার আকুতি জানাচ্ছেন, অন্যদিকে অপহরণকারীদের শাস্তি নিশ্চিতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দ্বারে দ্বারে।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, সাবেক সেনা কর্মকর্তা মুকুলকান্তি চাকমা গত ৩০ মে অপহৃত হন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ঘটনার এক মাস চার দিন পরে গত ৪ জুলাই বাঘাইছড়ি থানায় মামলা করেন তার মেয়ে নমিসা চাকমা। এতে বাঘাইছড়ি উপজেলা জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান বড়ঋষি চাকমা (৩৯), সংগঠনের উপজেলা সভাপতি প্রভাত কুমার চাকমা ওরফে কাকলী বাবু (৫৫), জেএসএস-এর স্থানীয় নেতা ত্রিদিপ চাকমা (৫০), বিস্তার চাকমা (৩৩)মানিক চাকমা ওরফে আবিষ্কার (৩২), খোকন চাকমা (৪৫), প্রীতি বিকাশ চাকমা (৩৫), অজয় চাকমা (৩৩) এবং জুপিটার চাকমাসহ (৩২) অজ্ঞাত আরও ৮ থেকে ১০ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়।

মামলায় চার আসামি বড়ঋষি চাকমা, প্রভাত কুমার চাকমা, ত্রিদিব চাকমা ও অজয় চাকমাকে গ্রেফতার করে পুলিশ তাদের ১০ দিনের রিমান্ড চায়। গত ২০ সেপ্টেম্বর রাঙামাটি চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত তাদের চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এরপর আদালত থেকে জামিনে বের হয়ে যান তারা। অন্য আসামিরা পলাতক রয়েছেন।

মামলার বিবরণে জানা যায়, চলতি বছরের ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি বাঘাইছড়ির রাবার বাগান এলাকায় অস্ত্রধারী জেএসএস সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুকুল চাকমারযোগসাজশে এ ঘটনা ঘটেছে বলে আসামিরা অভিযোগ করেন। স্থানীয় জেএসএসের অভিযোগ ছিল, সাবেক সেনা সার্জেন্ট হওয়ার কারণে মুকুল চাকমা সেনাবাহিনীর পক্ষে কাজ করেন। সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন তথ্য দেন। এমন সন্দেহ থেকে গত ৬ মে মুকুল চাকমাকে বাড়ি থেকে স্থানীয় বাঘাইছড়ি স্কুল মাঠে ডেকে নিয়ে মারধর করেন স্থানীয় জেএসএস নেতা বিস্তার চাকমাসহ অন্য সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনার পর বাড়ি ছেড়ে খাগড়াছড়ি জেলা সদরে গিয়ে থাকতেন মুকুল। ঘটনার মীমাংসার কথা বলে ৩০ মে বিকেলে মোবাইলে ফোন করে উপজেলার উগছড়ির লাইল্যেঘোনার বক্কা চাকমার দোকানে মুকুলকে ডেকে নেন প্রভাত কুমার চাকমা ওরফে কাকলি বাবু (জেএসএস উপজেলা কমিটির সভাপতি)। সেখান থেকে মুকুল একবার তার স্ত্রী সাধনা চাকমাকে ফোন করে বলেন, সেখানে প্রভাত চাকমা, আবিষ্কার চাকমা, ত্রিদিব চাকমা এবং বিস্তার চাকমা আছে এবং তিনি তাদের সঙ্গেই কথা বলছেন। এদিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে মুকুলের সঙ্গে শেষ কথা হয় সাধনার। মুকুলের ফিরতে দেরি হওয়ায় রাত ৯টার দিকে আবারও স্বামীকে ফোন দেন তিনি। কিন্তু এবার মোবাইলটি বন্ধ পাওয়া যায়। রাতে আরও কয়েকবার ফোন দিয়েছেন; কিন্তু মোবাইল বন্ধ। সেই থেকেই নিখোঁজ মুকুল। তিন-চার দিন পরে একবার ফোনটি খোলা পাওয়া গিয়েছিল, কেউ ফোন ধরেনি। তারপর থেকে আর কোনো সংযোগ মেলেনি। এ দিকে ঘটনার পর বিষয়টি থানা পুলিশকে অবহিত করা হয়। পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি করতে থাকে।

সম্প্রতি পার্বত্যাঞ্চলে গিয়ে পালিয়ে বেড়ানো মুকুলের স্ত্রী ও দুই মেয়ের সঙ্গে কথা হয়। নিরাপদ একটি স্থানে কথা হচ্ছিল তাদের সঙ্গে। কিন্তু তাতেও তাদের চোখেমুখে একটা অজানা ভয় আর আতঙ্ক কাজ করছিল। মুকুলের বড় মেয়ে নমিসা চাকমা চট্টগ্রামের একটি কলেজে অনার্সের ছাত্রী। আর ছোট মেয়ে মণীষা চাকমা স্থানীয় একটি স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। বাবা অপহরণের পর থেকে দুই বোনই নিরাপত্তাহীনতায় স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।

মুকুলের বড় মেয়ে নমিসা চাকমা বলেন, ‘থানা পুলিশের অনেক গড়িমসির পর বাঘাইছড়ি থানায় গত ২০ মে একটি সাধারণ ডায়েরি করতে সক্ষম হই আমরা। এরপর বারবার বাবার অপহরণের বিষয়ে মামলা করতে গেলে পুলিশ তাদের নানা কথা বলে বিদায় করে দেয়। এদিকে সাধারণ ডায়েরি করার পরে পরিবারের অন্যান্য সদস্যকেও হুমকি দেওয়া হয়। চার-পাঁচজন মুখোশধারী লোক বাড়িতে গিয়ে হুমকি দিয়ে আসে। এরপর পরিবারের সদস্যরা অন্যত্র গিয়ে আশ্রয় নেন। গত ৪ জুলাই আমাদের এজাহার গ্রহণ করে পুলিশ। গত ২০ সেপ্টেম্বর রাঙামাটি চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির হয়ে আত্মসর্মণ করেন এ মামলার চার আসামি বড়ঋষি চাকমা, প্রভাত কুমার চাকমা, ত্রিদিব চাকমা ও অজয় চাকমা। কিন্তু তারা এরপর জামিনে বেরিয়ে এসেছেন। মামলা তুলে নিতে আসামিরা আমাদের নানাভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন।’

তিনি বলেন, ‘আমার মা ও আমরা দুই বোন আর বাড়িতে যেতে পারছি না। আমি কলেজে যেতে পারছি না। ছোট বোন স্কুলে যেতে পারছে না। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। জানি না আমার বাবা বেঁচে আছেন কি না। আমরা বাবাকে জীবিত ফেরত চাই। সন্ত্রাসীদের বিচার চাই। কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন নমিসা চাকমা। এ সময় তার ছোট বোন মণীষা চাকমা ও মা সাধনা চাকমার চোখে পানি টলমল করছিল। কথা বলতে গিয়েও কণ্ঠ থেমে যাচ্ছিল সাধনা চাকমার।’

এ ব্যাপারে রবিবার (২৫ ডিসেম্বর) বিকেলে মুকুল চাকমা অপহরণ মামলার ১ নম্বর আসামি বাঘাইছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান বড়ঋষি চাকমাকে ফোন দেওয়া হলে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। একইভাবে বাঘাইছড়ি থানার ওসি আবুল কালাম চৌধুরীর ফোন নম্বরও বন্ধ পাওয়া যায়।

তবে, পার্বত্য রাঙামাটি পুলিশ সুপার (এসপি) সাঈদ তারিকুল হাসান দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘মুকুল চাকমা অপহরণ মামলায় ৪ আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তারা এখন জামিনে আছে। ওই মামলায় (মুকুল চাকমা অপহরণ) সিটিং উপজেলা চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। অনেক বিষয় চিন্তা করে কিন্তু এটা করতে হয়েছে। নির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বারকে এই মামলায় আসামি করা হয়েছে। তাদেরকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। এক মাস ৪ দিন পরে মামলা কেন করা হয়েছে-এ নিয়ে হই-হই, রৈ-রৈ করা হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টা এত সহজ না। এ রকম সিটিং একজন উপজেলা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে যখন অভিযোগ নেব, তখন কতগুলো বিষয় নিশ্চিত হতে হবে। কোনো একটা পর্যায়ে গিয়ে আমি যেন অভিযোগগুলোর একটা প্রমাণ করতে পারি। অভিযোগের পেছনের কিছু অংশ থাকা প্রয়োজন, যাতে ভিত্তির জায়গা মজবুত হয়। না হলে বিতর্ক তৈরি হবে। উপজেলা চেয়ারম্যান বা অন্যরা উল্টো যে মামলা করতে যাবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে। পুলিশের বিরুদ্ধে বলবে। যদি মামলাটা সঠিকভাবে না নিতাম তাহলে এদের অ্যারেস্ট করা সম্ভব হতো না, আইনের আওতায় আনা সম্ভব হতো না। তদন্ত শেষে যথাসম্ভব চার্জশিট দেওয়া হবে।’

মুকুল চাকমার পরিবারকে হুমকি প্রদান প্রসঙ্গে এসপি বলেন, ‘মুকুল চাকমার মেয়ের অভিযোগ কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে। তাদের হুমকি দিচ্ছে এ ধরনের খবর আমরা পাইনি। বাঘাইছড়ির বাসায় তারা যাওয়া আসা করে, সব সময় কেউ সেখানে থাকে না। কেউ হুমকি দিলে তারা যেন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তবে, এটুকুই বলব, ভয়ভীতি দেখিয়ে কিছু করার সুযোগ এ মুহূর্তে বাংলাদেশে নেই।’

(দ্য রিপোর্ট/কেএ/এস/এপি/এনআই/ডিসেম্বর ২৫, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর