thereport24.com
ঢাকা, মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর ২০২৪, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১,  ৪ রবিউস সানি 1446

যুগোপযোগী নয় ঢাবির ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি

মেধাবীরা বঞ্চিত, সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালুর পরামর্শ

২০১৪ ফেব্রুয়ারি ২২ ২০:৫৬:১৭
মেধাবীরা বঞ্চিত, সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালুর পরামর্শ

দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) অনার্স প্রথমবর্ষ ভর্তির মাল্টিপল চয়েজ কোশ্চেন (এমসিকিউ) পরীক্ষা পদ্ধতি যুগোপযোগী ও বিজ্ঞানসম্মত নয় বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষাবিদরা। এ পদ্ধতিতে প্রকৃত মেধার মূল্যায়ন হয় না এবং ভর্তির ক্ষেত্রে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে বলেও মনে করেন তারা। একই সঙ্গে বিদ্যমান পদ্ধতির পরিবর্তন করে ভর্তি পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালুর পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষাবিদরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স প্রথমবর্ষে মোট পাঁচটি ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’, ‘ঘ’ ও ‘চ’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ‘চ’ ইউনিট বাদে সব ইউনিটের পরীক্ষায়ই অনুসরণ করা হয় মাল্টিপল চয়েস কোশ্চেন (এমসিকিউ) পদ্ধতি। এক ঘণ্টায় ১২০ নম্বরের ভর্তি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের সঙ্গে যুক্ত হয় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের প্রাপ্ত সিজিপিএ’র ভিত্তিতে ৮০-তে অর্জিত নম্বর। অর্থাৎ ২০০ (১২০+৮০) নম্বরের মধ্যে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ নম্বরের ধারাবাহিকতায় একজন শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য চূড়ান্তভাবে মনোনয়ন পায়।

এমসিকিউ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা সম্পর্কে ঢাবির ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘এমসিকিউ পদ্ধতিতে কখনও মেধার স্বীকৃতি পাওয়া যায় না। এটি যুগোপযোগী নয় বরং এক ধরনের দ্বৈবচয়ন পদ্ধতি। সেখানে একটা টিক মার্ক বা বৃত্ত ভরাট করতে হয়। এখানে ভাষার ওপর শিক্ষার্থীর জ্ঞান আমরা নিশ্চিত করতে পারি না। খুব ভাল একজন ছাত্র বা ছাত্রী সেই মুহূর্তে প্রশ্নটি না বুঝে সঠিক উত্তর নাও দিতে পারে, আরেকজন হয়ত জানেই না একটা জায়গায় আন্দাজে বসিয়ে দিতে পারে। সেটি সঠিকও হয়ে গেল। সেটা অনেকটা ভাগ্যেরও ব্যাপার। এমসিকিউ পদ্ধতিতে হয়ত মেধার মূল্যায়ন হয় কিন্তু ৫০ ভাগের মতো শিক্ষার্থীর মেধার মূল্যায়ন এ পদ্ধতিতে হয় না।’

এ পদ্ধতির বিকল্প হিসেবে এমসিকিউ’র পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে- মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘পরীক্ষার্থী একটা অংশ এমসিকিউ পদ্ধতিতে দিলেন আবার একটা অংশ তাকে লিখিত পরীক্ষা দিতে হবে। তিনি যদি ইংরেজি ভাষায় ভর্তি হতে চান তাহলে তাকে ইংরেজি ভাষার দক্ষতা পরীক্ষা দিতে হবে আর বাংলায় ভর্তি হতে চাইলে বাংলা ভাষার দক্ষতার পরীক্ষা দিতে হবে।’

নিজের অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘অনার্স প্রথমবর্ষে ইংরেজি বিভাগে যারা ভর্তি হন তাদের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ইংরেজি বিষয় পড়ার অযোগ্য। বিদ্যমান ভর্তি পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের মেধার অপচয়ের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও শক্তির অপচয় হচ্ছে। ফলে যে শিক্ষার্থীকে আমরা অত্যন্ত উঁচু মানের শিক্ষা দিয়ে তৈরি করতে পারতাম, তাকে একটা মধ্যম মানের শিক্ষা দিতেই আমাদের বহু বছর নষ্ট হয়ে যায়। কেননা সে এই বিষয়টার সঙ্গে পরিচিত নয়। আমি মনে করি এ ব্যবস্থা থেকে আমাদের পরিত্রাণ পাওয়া দরকার।’

এ প্রসঙ্গে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল গণমাধ্যমে প্রকাশিত তার এক কলামে লিখেছেন, ‘…এই দেশের অনেক নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নই কিন্তু খুব নিম্নমানের। অনেক সময়ই মেধাতালিকায় ভালো করা আর লটারিতে নাম ওঠার মাঝে বড় কোনো পার্থক্য নেই।’

তিনি আরও লিখেছেন, ‘…কাজেই ভর্তি পরীক্ষার মেধাতালিকায় ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের নাম খুঁজে না পেলে তারা যেন মন খারাপ না করে, নিজের উপর বিশ্বাস যেন না হারায়। সবসময়ই সেটি মেধার অভাব নয়, অনেক সময় সেটি সঠিক গাইডবই মুখস্থ করার ইচ্ছের অভাবও হতে পারে! এই দেশে যে ভর্তি কোচিংয়ের বিশাল একটা রমরমা ব্যবসা হতে থাকে, তার একমাত্র কারণ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় মুখস্থ নির্ভর গাইড বইয়ের প্রশ্ন!’

ঢাবির ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি কোনো দিক থেকেই বিজ্ঞানসম্মত নয় মন্তব্য করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘এমসিকিউ পদ্ধতি অনেকটা লটারিতে নাম ওঠার মতো। এ পদ্ধতিতে পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রের সঙ্গে একাধিক অপশন দেওয়া থাকে। শিক্ষার্থীরা নিজের ধারণা থেকে উত্তর বাছাই করে থাকে, যেটি প্রশিক্ষণ পেলে যেকোনো প্রাণীও করতে পারবে। এখানে বিদ্যার কোনো বিষয় নেই।’

এ পদ্ধতিতে প্রকৃত মেধাবী বাছাই করা যায় না জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘অনেকে বলেন, এ পদ্ধতি সময় বাঁচানোর জন্য। সময় বাঁচাতে গিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থায় এক ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। ফলে আমরা অমনোযোগী তথাকথিত শিক্ষিত পাচ্ছি। কিন্তু তারা কোনো বিষয়ে বেত্তা হতে পারছে না। অধিত বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান নিয়ে তারা গর্ব করতেও পারছে না।’

বিদ্যমান পদ্ধতির পরিবর্তন দরকার মন্তব্য করে তিনি আরও জানান, ‘বিষয় ধরে পরীক্ষা নিতে হবে। তাহলে আমরা মেধাবীদের ছেঁকে নিয়ে আসতে পারি। অন্যথায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আমাদের জাতীয় জীবনে।’

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক জালাল উদ্দিন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘এমসিকিউ পদ্ধতিতে স্বজনপ্রীতির কোনো সুযোগ নেই, তা ছাড়া সময়ও কম লাগে। তবে আগে আমরা শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে আলাদাভাবে ভিন্নধর্মী প্রশ্নে পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করতাম। ফলে মেধাবী শিক্ষার্থী পেতাম। বর্তমানে ‘খ’ ও ‘ঘ’ ইউনিটের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই মেধাবী শিক্ষার্থী পাচ্ছি না। এমসিকিউ পদ্ধতির মাধ্যমে সুপ্ত প্রতিভাধারীদের বের করে আনা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব নয়। ফলে আমরাও আগের মতো মেধাবী শিক্ষার্থী আর কোনোদিন পাব না। তবে সৃজনশীল প্রশ্নে ভর্তি পরীক্ষা নিলে প্রকৃত মেধাবীদের বের করে আনা সম্ভব।’

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এ প্রসঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘এমসিকিউ পদ্ধতিতে প্রকৃত মেধা যাচাই করা সম্ভব নয়, এটা সঠিক নয়। এমসিকিউ পদ্ধতির কিছু দু্র্বলতা আছে। এমসিকিউ ও লিখিত পরীক্ষার সমন্বয় ঘটাতে পারলে ভালো হতো। সময়ের অভাবে এটা করা যাচ্ছে না। কেননা লাখ লাখ শিক্ষার্থীর খাতা দেখা অনেক সময়সাপেক্ষ। তবে ভবিষ্যতে আমরা সৃজনশীল প্রশ্নে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছি।’

(দ্য রিপোর্ট/ এসআর/ এইচএসএম/ এনআই/ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

বিশেষ সংবাদ এর সর্বশেষ খবর

বিশেষ সংবাদ - এর সব খবর