thereport24.com
ঢাকা, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১,  ২০ জমাদিউস সানি 1446

জিএমবি আকাশের সারভাইভার্স এবং তার স্বপ্ন

২০১৩ নভেম্বর ০৬ ২১:৪৬:৫১
জিএমবি আকাশের সারভাইভার্স এবং তার স্বপ্ন

(জিএমবি আকাশ ১৯৭৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ফটোগ্রাফি শুরু করেন ১৯৯৭ সাল থেকে। তিনি ২০০২ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো জুম সোয়ার্ট মাস্টারক্লাস হিসেবে নির্বাচিত হন।এছাড়াও প্রায় ৭০টির বেশি আন্তর্জাতিক পুরস্কারের স্বীকৃতি পান। তিনি মূলত ডকুমেন্টরি ফটোগ্রাফার, মাল্টিমিডিয়া জার্নালিস্ট।জিএমবি আকাশ শুধুমাত্র সামাজিক সমস্যার চিত্রই তুলে ধরতে চান না বরং তিনি তার “সারভাইভার্স” প্রোজেক্টের মাধ্যমে তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চান। তার সেই স্বপ্নের কথা তিনি জানাচ্ছেন দিরিপোর্ট২৪ এর ভিসিটরদের।)

খেয়া মেজবা, দিরিপোর্ট২৪ প্রতিবেদক : সারভাইভার্স প্রোজেক্ট আমার দীর্ঘ সময়ের ভাবনার ফসল। এই বইয়ের ছবিগুলোতে রয়েছে সমাজের প্রান্তিক মানুষদের দুর্দশার অবস্থা; যে মানুষগুলো সারাদিন স্ট্রাগল করে কিন্তু কখনো হাল ছেড়ে দেয় না। এই মানুষগুলোর কখনো কোন অভিযোগ নেই জীবনের বিরদ্ধে। প্রচণ্ড শক্তিশালী তারা। অনেকে মনে করেন আমি প্রান্তিক মানুষদের ছবি তুলি। সমাজের একটা নেগেটিভ দিক দেখানোর চেষ্টা করি।

আমি সেক্স ওয়ার্কার, চাইল্ড লেবার নিয়ে কাজ করছি। এছাড়াও ক্লাইমেট চেঞ্জ ইস্যুসহ আরো অনেক বিষয়ে কাজ করেছি। আমি মূলত দুইটা উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করি। আমাদের সমাজের সেই বিষয়গুলো তুলে ধরতে চাই যেগুলো পজিটিভলি বদলানো উচিত। আরেকটি বিষয় হলো আমার ছবিতে সেই জিনিসগুলো দেখাতে চাই যেগুলোকে সমাদর করা উচিত, এই রকম সিচুয়েশনে এই মানুষগুলো কাজ করেছে সেই বিষয়কে সমাদর করা উচিত।

আমি আমার দেশকে অনেক ভালবাসি, তাই সেই বিষয়গুলো তুলে আনতে চাই যেগুলোর পরিবর্তন হওয়া উচিত। সারভাইভার্স হচ্ছে প্রায় দশ বছরের ষাটটি ছবি নিয়ে আমার দশ বছরের জার্নি। প্রান্তিক মানুষের গল্প নিয়ে আমার বইটি। এই বইটি বের করার একটি মূল কারণ হচ্ছে এটা শুধুমাত্র আমার কাছে একটি বই না, আমার স্বপ্ন। এখানে যে সমস্ত পরিবারের ছবি আছে সেই পরিবারগুলোর মধ্যে কিছু পরিবারকে আমরা ছোট ছোট বিজনেস গিফট করেছি। এই পর্যন্ত ১৪টা পরিবারকে আমরা ছোট ব্যবসা করে দিয়েছি। বিষয়টা এমন না যে তাদের কোন কিছু আমাকে দিতে হবে বা তাদের কাছ থেকে আমাদের কোন কিছু পাওয়ার আশা আছে।

গত ১৫ বছর ধরে আমি অনেক কাজ করেছি, ফটোগ্রাফি থেকে অনেক কিছুও পেয়েছি। অনেক দেশ ট্রাভেলিং করেছি, অনেক খ্যাতি পেয়েছি। এওয়ার্ড পেয়ে টাকা পাচ্ছি, এসাইনমেন্ট থেকে টাকা পাচ্ছি। এই মানুষগুলোর সাথে আমার অনেক নিবিড় সম্পর্ক হয়েছে, এখনো তাদের সাথে আমার যোগাযোগ ভাল। কিন্তু গত ১০/১৫ বছরের মধ্যে আমি এদের জীবনে তেমন কোন পরিবর্তন দেখিনি। এগুলো ভাবলে আমার ভেতরে এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করে। যেমন কিছুদিন আগে সুইজারল্যান্ডে সারভাইভার্স নিয়েই আমার প্রদর্শনী ছিল। এদের ছবি ছাড়া আমার কোন অস্তিত্ব নাই কিন্তু এই মানুষগুলো কিছু পায় না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমি ভাবতাম, যখনই আমি এসাইমেন্ট করি তখন সেখান থেকে আমি আমার টাকার একটা অংশ আলাদা করে রাখি। ছবি বিক্রি হলেও এই কাজটা আমি করি। সেই টাকা দিয়েই সারভাইভার্স প্রোজেক্ট শুরু করা এবং ১৪টা পরিবারকে ছোট ছোট বিজনেস গিফট করা।

কাজটা অনেক কঠিন, অনেক বেশি সময় সাপেক্ষ। কারণ এমন একটা পরিবারকে আমি খুঁজে বের করি যারা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চায়, নিজেদের একটা পজিটিভ ইচ্ছা আছে এবং ভাগ্য পরিবর্তন করতে চায় কিন্তু তাদের কোন সুযোগ-সুবিধা নাই। তারপর আমরা বের করার চেষ্টা করি কি ধরনের কাজ তারা করতে পারবে। তারপর আমরা বাজার রিসার্স করি যে এই ব্যবসা চলবে কিনা। তখন কাজ শুরু করি এবং তাকে ৩/৪ মাস মনিটর করার চেষ্টা করি যে আর কিভাবে ভাল করা যায় বা তারা ঠিক মত চালাতে পারছে কিনা। এই মানুষগুলোকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। এরা তো কিছুই পায় না, ফটোগ্রাফাররা এদের থেকে এতো কিছু পায় কিন্তু তাদের জন্যে আমরা কিছুই করি না, এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত। সেই যন্ত্রনা থেকেই, সেই ইচ্ছা থেকেই এই মানুষগুলোর পেছনে দাঁড়ানো। আমি নিজেও সারভাইভিং ফটোগ্রাফার কিন্তু এদের জন্যে সামান্য কিছু করার ইচ্ছা আমার আছে। একটা কোট আমাকে সব সময় ইন্সপায়ার করে। আমি সেটা শেয়ার করতে চাই।

"I am only one, but still I am one. I cannot do everything, but still I can do something; and because I cannot do everything, I will not refuse to do something that I can do.- Helen Keller"

আমি সব কিছু পরিবর্তন করতে পারব না। কিন্তু আমরা প্রত্যেকেই যদি খুব অল্প করে হলেও করতে পারি, নিজেদের সামান্য কিছুও যদি আমরা দিতে পারি তাহলে আমাদের দেশে কোন দারিদ্র্য থাকবে না। সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের দেশে ১৮ কোটি মানুষ, ১৮ কোটি মানুষের ৩৬ কোটি হাত। এই ৩৬ কোটি হাত দিয়ে সব কিছু বদলে ফেলা সম্ভব। পজিটিভলি যদি আমরা একটা উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করি। এই পরিবারগুলোকে খুঁজতে সাতক্ষীরা, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিং সহ আরো নানান জায়গায় যেতে হয়েছে। এই প্রক্রিয়া অনেক বেশি জটিল। অনেকে মনে করেন আমি এনজিও চালাই। এদেরকে বুঝানো যে আমি সিম্পল একজন ফটোগ্রাফার এবং এও বোঝানো যে সবাই এগুলো করবে না। আমি আমার ইচ্ছা থেকেই করছি। এটা যে করতেই হবে এমন না, আমি এগুলো ফিল করি বলেই করা।

সারভাইভার্স বইতে শুধুমাত্র বাংলাদেশের মানুষের ছবি না- ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ বিভিন্ন দেশের মানুষের ছবি আছে। দারিদ্র্য আমাদের দেশে ছাড়াও আরো অনেক দেশেই রয়েছে। ইন্ডিয়া, ফিলিপাইনসহ নানা জায়গায় ঘুরে আমি দেখেছি গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই ভাল করছে এবং সেসব আমি দেখছি ইন্ডিভিজুয়াল মানুষের ক্ষেত্রে। আমি জানি না স্টেট কি করছে। আমাদের সরকার যদি আরো নজর দিত তাহলে ওইযে বললাম সবাই মিলে পরিবর্তন সম্ভব। আমি ফিল করেছি যে আমাদের দেশের মানুষ অনেক বেশি পজিটিভ। প্রতিটা মানুষ নিজেরা তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে। প্রত্যেকেই কিছু না কিছু কাজ করে, এটা অনেক বেশি ইন্সপায়ারিং।

আমাদের দেশের বেশিরভাগ ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফার সাদা-কালো তে ছবি তোলে। আমার ছবি অনেক বেশি রঙ নির্ভর এবং আমি নিজে রঙ অনেক পছন্দ করি। আমাদের জীবন রঙ্গীন, আমরা রঙ দেখি, রঙ এর মধ্যেই বসবাস করি। সাদা-কালো ছবিগুলোতে গরীব মানুষগুলোকে আরো গরীব মনে হয়। যেমন সুলতানের ছবির ক্ষেত্রে আমরা অনেক বলিষ্ঠ মানুষ পায়, অনেক বেশি ডিগনিটি তাদের। সাদা-কালোতে এই বিষয়ে সমস্যা মনে হয় আমার কাছে।

একটা বিষয় হচ্ছে আমি তো অনেক বেশি ট্রাভেল করি। অনেক দেশ আমি ঘুরেছি। কিছুদিন আগে সুইজারল্যান্ডের এক একজিবিশনে অনেক দেশের বড় বড় ফটোগ্রাফার ছিল। সেখানে এক ফটোগ্রাফার এসে আমাকে বলল, "যত প্রেজেনটেশন দেখলাম, যতগুলো কাজ দেখলাম আমার কাছে তোমার কাজ সবচেয়ে আলাদা মনে হয়েছে। যেগুলো মানুষের ডিগনিটিকে রিপ্রেজেন্ট করে, তোমার ছবিগুলো ফেক না, ওভার ফটোশপড না। এই ছবিগুলোতে বাস্তব জীবনকে ফিল করা যায়। তোমার ছবিগুলো মানুষের জীবনের গল্প বলে।" তার এই কথাগুলো আমাকে অনেক ইন্সপায়ার করে। আমি খুব সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছি, ভাল স্কুলে পড়াশুনা করি নাই। এদের সাথে আমি যত মিশেছি আরো বেশি করে নিজেকে চিনতে পেরেছি, আরো বেশি মানুষ হয়ে উঠছি। মানুষের ভাল-মন্দ তার নিজের কাছে, তুমি নিজেকে কিভাবে রাখতে চাও তা তোমার উপর।

আমি কিছুদিন আগে নারায়ণগঞ্জে "ফার্স্ট লাইট ইন্সটিটিউট অফ ফটোগ্রাফি" নামে এক স্কুল খুলেছি। সেখানে একেবারে কম পয়সায় ফটোগ্রাফি শেখার চেষ্টা করছি। সেখানে আমি এই সমস্ত শিশুদেরকেও পড়ানো হয় যাদের পড়াশুনার পেছনে খরচ করার সামর্থ নেই।

অনেকে বলেন, আমি তো সোশাল ওয়ার্কার নই; তাহলে কেন এই সমস্ত কাজ করি। কিন্তু আমি মনে করি ফটোগ্রাফারের পাশাপাশি আমি মানুষ। শুধু মাত্র ছবি তোলাই আমার কাজ না। আমি ছবি তোলা শুরু করেছি এই মানুষগুলোর ভাগ্য পরিবর্তন আনার জন্যে। সেটা যদি ছবি তুলে না হয় তাহলে অন্য ভাবেও আমি সেটা করতে রাজি আছি। আমি মনে করি আমাদের অনেকেই এগুলো করতে পারে। আর সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে যাদের ছবি আমি তুলছি তাদেরকে সন্মান করা। তারা আমাদের মতই মানুষ, তাদের মানুষ হিসেবে দেখা। আমার স্বপ্ন হচ্ছে এরকম আরো ৫০০ পরিবারকে ব্যবসা দিয়ে দাঁড় করানো। আর আমি যে তাদের সহযোগিতা করছি এটা তাদের প্রাপ্য টাকা, এটা তাদেরই একটা অংশ। এদের ছবি বেচে আমি আমার পরিবার চালাই। তাদের সাথে এই অংশ শেয়ার করা আমার জন্যে আনন্দের বিষয়।

আমি সোশাল ইস্যু নিয়ে কাজ করি। যেমন আমি প্রস্টিটিউশন নিয়ে কাজ করেছি। এই বিষয়ে আমরা অনেক কম জানি, এখানে যেতেও অনেকে অস্বস্তি বোধ করেন। এই সমস্ত বিষয়ে কাজ করা অনেক কঠিন। আবার ড্রাগ ইস্যু নিয়ে কাজ করাও অনেক কঠিন একটি বিষয়। আমি একটা বিষয় নিয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে কাজ করি। ছবি তুলতে গিয়ে আমি তাদের সাথে মিশে যাই। আমি গল্প বলি তাদের, তাদের কথা শুনি। যখন ওরা আমাকে বিশ্বাস করে, যখন বুঝতে পারে আমি তাদেরকে নিয়ে কাজ করতে আসছি তখন তারা আমার জন্যে পথ খুলে দেয়। আমরা যেখানে জন্মগ্রহণ করি সেখান থেকেই আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ হয়। এই মানুষগুলো ভুল জায়গায় জন্মগ্রহণ করেছে।

আমার আরেকটি কথা হল, নিজের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে না ফেলে কাজ করা। আমার "নাথিং টু হোল্ড অন" সিরিজের কাজ করতে গিয়ে ট্রেনের ছাদে উঠে ছবি তুলতে হয়েছে। সেখানে একবার এক ঘটনায় আমার মনে হয়েছে একটা ছবির জন্যে জীবনের ঝুঁকি নেওয়া ঠিক না, বেঁচে থাকলে আমি আরো অনেক ছবি তুলতে পারব।

(দ্য রিপোর্ট২৪/কেএম/এমডি/নভেম্বর ০৬, ২০১৩)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

সাহিত্য এর সর্বশেষ খবর

সাহিত্য - এর সব খবর