thereport24.com
ঢাকা, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১,  ২০ জমাদিউস সানি 1446

রঙিন পর্দার সোনালি দিন কি আর ফিরবে না?

২০১৭ মে ০২ ১০:৩৮:৪২
রঙিন পর্দার সোনালি দিন কি আর ফিরবে না?

সাইফুল ইসলাম খান : ৬০ থেকে ৮০’র দশক সময়কালকে বাংলা সিনেমার সোনালী যুগ বলা হয়। তখনকার সময়ে আজকের মত এত আধুনিক প্রযুক্তি ছিল না। রেকর্ড মান ভাল ছিল না। তবুও তখনকার সিনেমার গল্প আর মান ছিল অনন্য। যা নিয়ে সত্যিই গর্ব করা যায়। এখন দেশ ডিজিটাল হয়েছে, উন্নত মানের সিনেমাবান্ধব প্রযুক্ত তৈরি হয়েছে। আর এখনই দেশের চলচ্চিত্র শিল্প বাজে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে! তবে কয়েক বছর পরপর আমরা দু-একটি ভাল সিনেমা দেখতে পাই বটে। বর্তমানে এফডিসিতে ৩৭৫ জন পূর্ণাঙ্গ পরিচালক এবং ১০০জনের মত সহযোগী পরিচালক রয়েছেন। এক সময় যে এফডিসিতে বছরে ১০০ থেকে ১২০টি সিনেমা তৈরি হত এখন সেখানে অতি কষ্টে বছরে ৬০ থেকে ৭০টির মতো সিনেমা তৈরি হয়। তারপরেও আমাদের পরিচালকদের বেকার বলা যাবে না!

ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই দেশে সর্বপ্রথম নবাব পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯২৭ সালে ‘সুকুমারি’ নামে প্রথম স্বল্প দৈর্ঘের নির্বাক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। আর ১৯৩১ সালে ‘দ্যা লাস্ট কিস’ নামে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য নির্বাক চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। আর ১৯৫৭ সালে আব্দুল জব্বার খানের পরিচালনায় প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ তৈরি হয়। এরপর একের পর এক কালজয়ী সিনেমা যুক্ত হয়েছে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে। মুখ ও মুখোশের মুক্তির ৭০ বছরের মাথায় এখন কেন দিন দিন দর্শক হারিয়ে নকল কাহিনী আর চরিত্রের মুখোশ পরানো হচ্ছে দেশি অভিনেতাদের।

শাকিব খানকে ‘মেয়েলী ঢংয়ের পুরষ’ আর ‘বউ ছাড়া বাচ্চার বাপ’ যাই বলা হোক না কেন, এক সময়ের রোগা, পাতলা পার্শ্ব চরিত্রের শাকিব খান এখন ঢাকাই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির প্রধান নায়ক। এ কথা বললে বেশি বলা হবে না, শাকিবের চাহিদা এখন এতটাই যে তাকে দিয়ে সিনেমা বানানোর মত বাজেটও দেশি অনেক পরিচালকের নেই। শাকিব ঢাকাই চলচ্চিত্রে এখন পর্যন্ত অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তবে শাকিব তার ব্যক্তিগত বিষয়ে বিশেষ করে তার স্ত্রী অপু বিশ্বাস ও সন্তান নিয়ে যে হাস্যকর বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন তার জন্য তিনি সমালোচিত হয়েছেন। এই বিতর্কের মাঝে শাকিব নিজের স্ত্রী-সংসার নিয়ে নানা প্রলাপ বকার মাঝে একটি সত্য কথা বলে ফেলেছেন সেটি হল- তিনি দেশী পরিচালকদের ‘বেকার’ বলে মন্তব্য করেছেন। নকল কাহিনী নির্ভর সিনেমা বানানো আর বেকার থাকা একই কথা। এসব মানহীন আজে-বাজে সিনেমা বানিয়ে চলচ্চিত্র শিল্পকে নষ্ট না করে বেকার বসে থাকা অনেক ভাল।

কিন্তু 'বেকার' পরিচালকরা শাকিবের এই ঔদ্ধত্বের শাস্তি দিতে মোটেও আলসেমী করেননি। তারা শাকিবকে শাস্তি দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। শাকিবের মন্তব্যের জেরে পরিচালকরা স্বগর্বে জানান দিলেন তারা বসে থাকার মানুষ নন! তারা কঠিন দায়িত্ব পালন করেন। অল্প সময়ের মধ্যে অনির্দিষ্টকালের জন্য তারা শাকিবকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিলেন! শেষ পর্যন্ত নানা নাটকীয়তার পর শাকিব খানের নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়া হয়েছে।

তবে প্রশ্ন হলো, দেশের প্রধান অভিনেতারা এভাবে হেনস্থা হলে এবং আগামীতে আবারও যদি নিষিদ্ধ হন তবে সেই অভিনেতার ভক্তরা কার সিনেমা দেখবেন। দেশি পরিচালকরা তো তাদের নিষেধাজ্ঞা জারির মহান দায়িত্ব পালন করে ঘুমের প্রস্তুতি নেন। তারা ঘুমের ঘোরে থাকলেও দেশের দর্শকরা তো জেগে থাকেন। তারা নিশ্চয়ই বাধ্য হয়ে পাশের দেশের সিনেমা দেখতে বসে যাবেন।

নিজ দেশেই যখন ভিন্ন দেশের সিনেমার দর্শক চাহিদা বেড়ে যাবে তখন আপনারাই শহীদ মিনার কিংবা সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে বিদেশী সিনেমার অবাধ প্রবেশ বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন কিংবা অনশন কর্মসূচি দেবেন। মনে রাখবেন, ততদিনে কোন লাভ হবে না। কারণ আপনারা অনশন করলেও দর্শক ততদিনে বিদেশী সিনেমায় তাদের উদরপূর্ণ করে ফেলবে।

গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক যুগান্তরে বিনোদন সাংবাদিক অনিন্দ্য মামুন, রাফসান জানি ও আমি মিলে “পাততাড়ি গুটাচ্ছে সিনেমা হলগুলো” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন করেছিলাম। সেই প্রতিবেদনে আমি ঢাকাই সিনেমা হলগুলোর সরেজমিন চিত্র উপস্থাপন করেছিলাম। আমার সেই প্রতিবেদনে “পূর্ণিমা সিনেমা হলে আশার আলো নেই” উপ-শিরোনামে হলটির করুণ অবস্থা তুলে ধরা হয়েছিলো। প্রতিবেদনে সিনেমা হলটির করুণ চিত্র প্রকাশ করার বছর পেরোতেই পূর্ণিমা সিনেমা হলের আলো নিভে গেল। মানহীন সিনেমা, বাড়তি টিকেট মূল্য, হলের ভিতরের অস্বস্তিকর পরিবেশ, ছেঁড়া-পুরনো আসন, ছারপোকার উপদ্রব, ভ্যাপসা গরম আর ভাড়ায় সিনেমা দেখার সাথীদের নিয়ে একশ্রেণির রুচিহীন মানুষের অশ্লীলতার চর্চা দেশের প্রেক্ষাগৃহকে ধ্বংসের শেষ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। কানায় কানায় দর্শক পূর্ণতার পরিবর্তে এখন কোণায় কোণায় দর্শক পাওয়া যায়। শুধু কারওয়ান বাজারের পূর্ণিমা নয়, এমন অবস্থা চলতে থাকলে দেশের বাকি সিনেমা হলগুলোও বন্ধ হতে বাধ্য।

বাংলাদেশে নব্বই দশকের আগে সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ হাজার ৩০০টির মতো। শুধু রাজধানী ঢাকাতেই ছিল প্রায় ৪০টির মতো। বর্তমানে সারা দেশে সিনেমা হলের সংখ্যা কমতে কমতে ৩০০টিতে এসে ঠেকেছে । আর ঢাকায় অবশিষ্ট রয়েছে ১১ থেকে ১২টি। একসময় দেশের প্রতিটি জেলাতে একাধিক সিনেমা হল ছিল। এখন জেলায় একটি মাত্র সিনেমা হল চালু থাকলেও তা চলছে খুঁড়িয়ে-হামাগুড়ি দিয়ে। মাসখানেক আগে শরীয়তপুর গিয়েছিলাম। জেলা সদরের পৌরসভাতেই দুটি সিনেমা হল ছিল। তার একটি চলেছে থেমে থেমে। অপরটি পরিত্যক্ত, ময়লার ভাগাড় হিসেবে ব্যবহার করে মানুষ। শহরের সব ময়লা আবর্জনা জড়ো হয় সেখানে। দুর্গন্ধে নাক ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে বড় দম নিয়ে অসহায় এ সিনেমা হলটির সামনে দিয়ে হেঁটে যায় মানুষ।

যুগের সাথে তাল মিলিয়ে পরিচালকরা যদি ভাল কাজের নেতৃত্ব দিতে না পারেন তবে তাদের সিনেমা দেখতে দর্শক আসবে না। নাকে কাপড় চেপে উঠে গিয়ে বিদেশি সিনেমা-সিরিয়ালের ঘ্রাণ নিবে। সিনেমা হল ও সিনেমার এ দীনতা ফেরাতে তাদের মানসম্মত সিনেমা তৈরি করতে হবে। দীর্ঘসময় পরে হঠাৎ করে ভেলকিবাজি দেখিয়েছেন অমিতাভ রেজা। চঞ্চল চৌধুরীকে নিয়ে তিনি তার ‘আয়নাবাজী’ সিনেমার মাধ্যমে হলে দর্শক ফেরাতে সক্ষম হয়েছিলেন। আয়নাবাজী দেখতে মাসব্যাপী দর্শকদের দীর্ঘ লাইন লক্ষ্য করেছি সিনেমা হলের সামনে। বলাকা সিনেমা হলের সামনে দর্শকদের পা ফেলার জায়গা ছিল না। হঠাৎ করে ছবিটি পাইরেসি হওয়ায় বড় মাপের ধাক্কা খেয়েছেন অমিতাভ। তবে তারপরেও তিনি সফল হয়েছেন।

আয়নাবাজী শেষ হওয়ার সাথে সাথে আবার আমাদের সিনেমা হল ফাঁকা হয়ে গেছে। কারণ আমাদের পরিচালকরা যে সিনেমা বানান তাতে তাদের ঘরের দর্শকরাই বিমুখ। তাদের ঘরে বসেই হয়ত স্টার জলসা, জি বাংলার সিরিয়াল চলে আর বিজ্ঞাপন এলে স্টার মুভিতে গিয়ে রিমোট থামে।

পরিচালকদের উচিত কোন অভিনেতাকে নিষিদ্ধ না করে বরং নতুন অভিনেতা খুঁজে বের করা। কোন অভিনেতাকে সরাতে চাইলে তার প্রতিদ্বন্দ্বী অভিনেতা তৈরি করুন। নিজেদের পরিচয় কাজ দিয়ে প্রমাণ করুন। এতে চলচ্চিত্র শিল্প বাঁচবে, শিল্পী বাঁচবে, সিনেমা হল বাঁচবে, দেশের দর্শক আপনাদের মাথায় রাখবে। রাজনৈতিক দলের মত সমিতিতে বিদ্বেষ চর্চা না করে বরং নতুন গল্প খুঁজুন, অস্কার জয়ের স্বপ্ন নিয়ে কাজ করুন। নিজে বাঁচবেন, দেশ বাঁচবে।

লেখক: সাংবাদিক ও ঢাবি শিক্ষার্থী
msikhan717@gmail.com

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর