thereport24.com
ঢাকা, মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারি 25, ২১ মাঘ ১৪৩১,  ৫ শাবান 1446

তুখোড় খেলোয়াড় শাহীন যেভাবে হয়ে উঠলেন বন্দুক শাহীন

২০১৭ অক্টোবর ১৪ ০০:৩৩:৩৪

একসময়ের দুর্দান্ত ব্যাডমিন্টন খেলতেন শাহীন। জীবনযুদ্ধের এক স্তরে এসে খেলোয়াড় থেকে কুখ্যাত ‘বন্দুক শাহীন’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। আর শেষ পযন্তমারা পড়েন বন্দুক যুদ্ধেই। শুক্রবার ভোরে পুলিশের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হওয়ার পর থেকেই খেলোয়াড় শাহীনের বন্দুক শাহীনে রপান্তরের কাহিনী নারায়নগঞ্জবাসীর মুখে মুখে ভাসতে থাকে।

শুক্রবার ভোরে নারায়নগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি) সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন শাহীন। এ সময় উদ্ধার করা হয় একটি ৭.৬৫ বোরের পিস্তল ও ৪ রাউন্ড গুলি।

নব্বইয়ের দশকের শেষ সময়ে বিএনপির নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় ক্যাডার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন শাহীন। এ সময়ে কাটা রাইফেলসহ পুলিশের কাছে গ্রেফতার হন তিনি। এরপর থেকে তুখোড় ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় শাহীনের নাম হয়ে যায় ‘বন্দুক শাহীন’। ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট সরকার গঠন করলে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের তৎকালীন বিএনপিদলীয় এমপি মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিনের শেল্টারে শাহীন বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। এ সময় অপারেশন ক্লিনহার্ট অভিযানে গ্রেফতার হলেও গিয়াস উদ্দিনের তদবিরে রক্ষা পান।
ফিরে এসে এলাকায় চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। সঙ্গে নেন তার ছোট বোনের স্বামী তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী আসলামকে। নারায়ণগঞ্জ শহরের কলেজ রোড এলাকায় শুরু করেন ফেনসিডিলের ব্যবসা। ২০০৪ সালে বিএনপি নেতা তৈমুর আলম খন্দকারের মেজ ভাই ব্যবসায়ী নেতা সাব্বির আলম খন্দকার খুনের মামলায় সাবেক এমপি গিয়াস উদ্দিন এবং শাহীন আসামি হন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন মহলে দহরম মহরম করে শাহীন পুরোদমে মাদক ব্যবসা শুরু করেন। গড়ে তোলেন বিশাল মাদক সাম্রাজ্য।

শাহীনের মাদক ব্যবসায় প্রত্যক্ষভাবে পরিচালনার দায়িত্ব পায় ‘৪ খলিফা’খ্যাত তার আপন দুই ছোট ভাই মামুন ওরফে বাবা মামুন, মাসুমসহ ইভান ওরফে বাবা ইভান এবং খাজা রনি। ওই সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে ৭ খুনের ঘটনার পর নূর হোসেন দেশ ত্যাগ করলে পুরো জেলার ইয়াবা ও ফেনসিডিলের একক আধিপত্য চলে আসে বন্দুক শাহীনের কাছে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ১৩নং ওয়ার্ডের মাসদাইর, গলাচিপা এলাকার শীর্ষ মাদক সম্রাট বন্দুক শাহীনের ৪ শতাধিক সহযোগী ও সমর্থক রয়েছে বলে জানা গেছে। যার মধ্যে মাসদাইর গলাচিপায় আড়াই শতাধিক সহযোগী ও সমর্থক এবং আমলপাড়া এলাকায় দেড় শতাধিক সহযোগী ও সমর্থক রয়েছে। গেল কয়েক বছরে বন্দুক শাহীনকে ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করলেও বন্দুক শাহীন ছিল অধরা।

গত বছরের ২৪ আগস্ট দিনগত রাত সাড়ে ১২টায় (সময় অনুযায়ী ২৫ আগস্ট) ডিবির এস আই আসাদুজ্জামান শেখ বাদী হয়ে ২৬জনের নাম উল্লেখ করে ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেছেন, তাদের টিম ২৪ আগস্ট সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গলাচিপা এলাকাতে অভিযান চালায়। তখন প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ ব্যাক্তি বেআইনী মারাত্মক অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পুলিশের উপর আক্রমণ চালায়। তাদের ছোড়া ইটের আঘাতে কনস্টেবল হুমায়ূন কবিরের বাম পায়ে গুরুতর জখম হয়। এছাড়া কনস্টেবল জাহিদুল ইসলাম ও কাজী রেজার শরীরের বিভিন্ন স্থান জখম হয়। তাদেরকে নারায়ণগঞ্জ শহরের ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।
ওই মামলায় আসামীর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের চিহ্নিত মাদক বিক্রেতা মনিরুজ্জামান ওরফে বন্দুক শাহীনকে করা হয়েছে তিন নাম্বার আসামী। প্রধান আসামী ছিলেন খাজা রনি। অপর আসামীরা ছিলেন, রিপন ওরফে বুইট্টা রিপন, জয়ন্ত ওরফে সজীব, তারাল মনা, বাবু ওরফে কালা বাবু, সুমন, ইবান, মনির, ইকবাল, রাসেল ওরফে দেবার রাসেল, সজীব, রাব্বি, রিয়াদ, হৃদয়, ফারুক, ডাবলু মাসুদ, চায়না, সাইফুল ইসলাম, ফয়সাল, নাসির, আরমান, শাকিল ওরফে শাইক্কা, সুমন ২, আয়নাল হক, হারুন ও নান্টু।

গত বছরের ৭ জুলাই সন্ধ্যায় মাসদাইরে ডিবি পুলিশের অভিযানে মনিরুজ্জামান শাহীন ওরফে বন্দুক শাহীনের উকিল মেয়ের জামাতা সাইফুল ইসলাম (২৮) ও তার সহযোগি শাকিল ওরফে পিচ্চি শাকিলকে (২৪) কয়েক বোতল ফেনসিডিল সহ আটক করা হয়। পরে বন্দুক শাহীনের বোন লাভলী, সহযোগি মাহাবুব, মনির ও রবিন সহ আরো কয়েকজন মিলে ডিবি পুলিশের উপর হামলা করে সাইফুল ইসলাম ও পিচ্চি শাকিলকে ছিনিয়ে নেয়।
ওই সময়ে ডিবির ওসি মামুনুর রশিদ মন্ডল জানিয়েছিলেন, দুই মাদক বিক্রেতাকে আটকের জন্য় অভিযান চালানোর সময়ে পালিয়ে যায়। ওই দুইজনের কাউকেই গ্রেপ্তার করতে পারেনি। ওই ঘটনায় ডিবি কোন মামলাও করেনি।

২০১৩ সালের ৩ মে মাসদাইরে একই স্থানে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের এসআই সফিকুল ইসলাম ও এএসআই মনিরের নেতৃত্বে ডিবি পুলিশের একটি টিম অভিযান চালায়। অভিযানের সময় বাড়ির ছাদে অবস্থান করছিলেন বন্দুক শাহীন। এ সময় পুলিশ ফেনসিডিলসহ শাহীনের ছোট ভাই মামুনকে আটক করে। ফেনসিডিলসহ মামুনকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসার পথে মামুনকে ছিনিয়ে নিতে হামলা চালায়। ওই ঘটনায় ১১ জনের নাম উল্লেখ করে মোট ৪৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। এসব আসামীদের মধ্যে শাকিল ও সাইফুল ইসলামকেই গত ২৭ জুলাই ছিনতাই করে নিয়ে যায় সহযোগিরা।

২০১৪ সালের ৯ ফেব্রয়ারী রাতে শহরের গলাচিপা রূপার বাড়ি এলাকায় বন্দুক শাহীনকে আটক করতে অভিযান চালায় র‍্যাবের একটি টিম। ওই সময়ে শাহীনের লোকজন র‍্যাব সদস্যদের ডাকাত আখ্যা দিয়ে মারধর করে এবং তাদের একটি মটরসাইকেল পুকুরে ফেলে দেয়। এ ঘটনায়ও শাহীনকে প্রধান আসামী করে ৯জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত আরো ৩০-৪০জনকে আসামী করা হয়।
এভাবে প্রায় প্রতিটি ঘটনায় কোনো না কোনো ভাবে শাহীন রক্ষা পেয়ে যান। আর ছাড়া পাওয়ার পরপরই নিজেকে আরো বেশী শক্তিশালী ভাবতে শুরু করেন। হয়ে উঠেন আরো বেপরোয়া। তবে শেষ রক্ষা হলো না তার। বন্দুক যুদ্ধেই মরতে হলো বন্দুক শাহীনকে।

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর

জেলার খবর - এর সব খবর