thereport24.com
ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১,  ২২ জমাদিউল আউয়াল 1446

নাগরিক পরিসরে একুশে ফেব্রুয়ারি

২০১৪ ফেব্রুয়ারি ২৮ ০৬:৩২:১৯
নাগরিক পরিসরে একুশে ফেব্রুয়ারি

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : ‘একুশে ফেব্রুয়ারি পূর্ব-পাকিস্তানে মৃদু গণতান্ত্রিক আন্দোলনেরই জোয়ার সৃষ্টি করেনি, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও এনেছে দিগন্ত বিস্তারী প্লাবন। প্রতিক্রিয়ার নির্মম হিংসা ও লোভের আগুন থেকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে বাঁচাবার জন্য দেশ জুড়ে জনতার যে দুর্জয় ঐক্য গড়ে উঠেছে পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে তার কোনো নজীর নেই। ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি এই দরদ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নতুন গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক বিকাশের বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে— আপামর মানুষের মনে আমাদের সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতিকে নতুন সম্ভাবনার পথে নিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছে।’- হাসান হাফিজুর রহমান/ ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সঙ্কলন থেকে।

বাংলাদেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব বিদ্যমান। রাজনীতির দিক থেকে পূর্ব বাংলায় জাতীয়তাবাদী ধারার বিকাশ ঘটে এই আন্দোলনের মাধ্যমে। এর ধারাবাহিকতায় দেখা যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ। আলোচনার আগের পর্বগুলোতে আমরা দেখেছি কীভাবে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটেছে।

স্বাধীন বাংলাদেশে দিনটি দেশীয় উদযাপনের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। তবে আন্দোলনটি রাষ্ট্রভাষাকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হলেও স্বীকৃতি মিলেছে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। অর্থাৎ সার্বজনীনতার দিক থেকে কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে।

শহীদ দিবসের আয়োজন : বাংলাদেশে ২১ ফেব্রুয়ারি ‘শহীদ দিবস’ এবং একইসঙ্গে শোকের এই দিনটি রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। রাত বারোটা থেকে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন শুরু হয়। প্রভাতফেরি থেকে সারাদিন চলে নানা আয়োজন। বাংলা একাডেমি মাসব্যাপী আয়োজন করে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বাংলাদেশে বেশিরভাগ বই প্রকাশিত হয় এই মেলাকে ঘিরে। এ মাসে ঘোষণা করা হয় বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বেসামরিক পদক ‘একুশে পদক’।

শিল্প-সংস্কৃতিতে অবদান : একুশের ঘটনা ও চেতনা নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য গান, নাটক, কবিতা ও চলচ্চিত্র। আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত ও আলতাফ মাহমুদ সুরারোপিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি বাংলাদেশে সর্বাধিক গীত ও শ্রুত গানগুলোর অন্যতম। আব্দুল লতিফের ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়’সহ রয়েছে আরও অনেক গান। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে রয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী রচিত নাটক ‘কবর’, শামসুর রাহমানের কবিতা ‘আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কবিতা ‘কোন এক মাকে’, ‘কিংবদন্তির কথা কয়’ ও ‘বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা’, জহির রায়হানের উপন্যাস ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ ও ‘আরেক ফাল্গুন’, আহমদ ছফার উপন্যাস ‘ওঙ্কার’ এবং শওকত ওসমানের ‘আর্তনাদ’। এ ছাড়া ভাষা আন্দোলনকে উপজীব্য করে নির্মিত হয়েছে জহির রায়হানের চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’। স্বাধীনতার আগে নির্মিত হলেও এই ছবির মাধ্যমে দেখানো হয়েছে এই ধরনের একটি আন্দোলন কী করে একটি জাতিকে স্বাধিকারের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া একুশের শহীদদের স্মরণে নির্মিত ‘শহীদ মিনার’ জাতীয় জীবনের নানা আন্দোলন-সংগ্রামের স্বাক্ষী।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস : ১৯৯৮ সালের ৯ জানুয়ারি কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশী রফিকুল ইসলাম জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল কফি আনানকে একটি চিঠি লেখেন। ১৯৫২ সালে ভাষা শহীদদের অবদানের কথা উল্লেখ করে প্রস্তাব করেন ২১ ফেব্রুয়ারিকে যেন ‘মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সেক্রেটারি জেনারেলের প্রধান তথ্য কর্মচারী হাসান ফেরদৌস ২০ জানুয়ারি রফিককে অনুরোধ করেন তিনি যেন জাতিসংঘের অন্য কোনো সদস্য রাষ্ট্রের কারো কাছ থেকে একই ধরনের প্রস্তাব আনার ব্যবস্থা করেন। রফিক তার সহযোদ্ধা আব্দুস সালামকে সঙ্গে নিয়ে ‘এ গ্রুপ অব মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এতে একজন করে ইংরেজিভাষী, জার্মানভাষী, ক্যান্টোনিজভাষী ও কাচ্চিভাষী সদস্য ছিলেন। তারা আবারও কফি আনানকে ‘মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভারস অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ এর পক্ষ থেকে একটি চিঠি লিখেন। এরপর তারা দেশী-বিদেশী অসংখ্য মানুষের সাহায্য পান।

নানা ঘটনার পর ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর প্রস্তাবটি উত্থাপন করা হয় ইউনেস্কোর সভায়। ১৮৮টি দেশ এতে সমর্থন জানায়। সর্বসম্মতিক্রমে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে গৃহীত হয়। এভাবেই একুশে ফেব্রুয়ারি একটি আন্তর্জাতিক দিনে পরিণত হয়।

বাংলাদেশে ভাষা বির্তক : বাংলাদেশে দুনিয়ার অন্যান্য দেশের মতই জীবনাচরণে ইংরেজির প্রভাব পড়েছে। সঙ্গে আছে হিন্দীর প্রভাব। শিক্ষার বিভিন্ন মাধ্যমে পর্যাপ্ত বাংলা না শেখানোর অভিযোগও উঠেছে। এই কারণে নতুন ধরনের ভাষাভঙ্গির উদ্ভব হয়েছে, যা নানা কারণে বিতর্কিত। ইংরেজি মিশ্রিত বাংলা ছাড়াও শহুরে তরুণদের একটা বড় অংশের মধ্যে আঞ্চলিক ও সাধু-চলিত মিশ্রিত এক ধরনের ভাষাভঙ্গির প্রচলন ঘটেছে। কথ্যরীতির সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যে এর প্রবেশ ঘটেছে। এই নিয়ে নানা ধরনের বিতর্ক চালু আছে নাগরিক পরিসরে।

অনেকে ভাষার প্রমিতকরণের দিকে জোর দিচ্ছেন। এটা নিয়ে আদালতের নির্দেশনার মতো ঘটনা রয়েছে। কেউ কেউ একে সাধুবাদ জানালেও কারো কারো মতে, ভাষা নদীর মতো। এর নিজস্ব গতিপথে নানান সংযোজন-বিয়োজন ঘটবে। একে নিয়মের নিগড়ে বাধা যায় না। ভাষার মতো সামাজিক বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা কাম্য নয়।

বিভিন্ন সময়ে আদালতে বাংলার ব্যবহারসহ নানান ধরনের প্রস্তাব উঠেছে। এভাবে নানান তর্ক-বিতর্কের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বাংলা ভাষার স্রোতধারা। অনেকে দাবি করেন, বাংলাভাষীদের একটা বড় অংশ ভারতে বসবাস করলেও চর্চা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশই বাংলা ভাষার বিপুলা ঐশ্বর্য নিয়ে গরিয়ান।

একইসঙ্গে নানা সময়ে বিভিন্ন নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে মাতৃভাষায় পড়ালেখার সুবিধা দেওয়ার দাবি উঠেছে। যা ভাষা আন্দোলনের মূল চেতনা ধারণ করে। জাতীয়তাবাদের গণ্ডি পেরিয়ে বৃহত্তর চেতনাকে ধরাই হলো এই তৎপরতার লক্ষ্য।

একুশের আয়োজনের পরিশেষে এই আশাবাদ থাকুক বাংলা ভাষাভাষী মানুষ তাদের স্বাধীনতার আকাঙ্খা, সহনশীলতা ও মননশীলতা ছড়িয়ে দিক সারাবিশ্বে।

(দ্য রিপোর্ট/ডব্লিউএস/এপি/ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর