thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১,  ২০ জমাদিউল আউয়াল 1446

আল মাহমুদের ৮৩-তে পা

২০১৮ জুলাই ১১ ০০:৫৪:১৬
আল মাহমুদের ৮৩-তে পা

মহিউদ্দীন মোহাম্মদ, দ্য রিপোর্ট : কবি আল মাহমুদ দেখতে দেখতে বিরাশি পেরিয়ে তিরাশিতে পা দিচ্ছেন। একদা এক অস্পষ্ট কুয়াশার মধ্যে যাত্রা করে কবি দিগন্তে আলোর ঝলকানিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছেন এই লোকালয়ে। আজ কবি আমাদের সবার হৃদয় নিসর্গের এক অপরূপ ছবি হয়ে ভেসে আছেন। শত বৎসরের দিকে ধাবমান কবির দিকে চেয়ে থাকি অনবরত বর্ষণের জন্য, সেই বর্ষণ ঘনবৃষ্টির নয়; শুধু আকাঙ্ক্ষামাত্র— আবার একটি নতুন কবিতা জন্ম দিবেন কবি। যদিও অনেক বিপন্নতার মাঝে এমন সংশয় কবি প্রস্তুত করেন—

..কিন্তু একজন কবিকে কি দেবে তোমরা? যে ভবিষ্যতের দিকে
দাঁড়িয়ে থাকে বিষণ্ন বদনে? অঙুলি হেলনে যার নিসর্গও
ফেটে যায় নদীর ধারায়। উচ্চারণে কাঁপে মাঠ,
ছত্রভঙ্গ মিছিল, মানুষ, পাক খেয়ে এক হয়ে যায়।

যখন সে ফিরে, দেখে, আচ্ছন্ন উঠোন। সে দেখে
শিশুর শব নিস্পৃহ মায়ায়। সে দেখে ধর্ষিতার শাড়ি
ছিন্ন ভিন্ন, হত্যায় ছাপানো। স্তব্ধতার মধ্যে তার ঠোঁট নড়ে
ইতিবৃত্ত ভেঙে পড়ে রক্তবর্ণ অক্ষরের স্রোতে।

(স্তব্ধতার মধ্যে তার ঠৌঁট নড়ে/সোনালি কাবিন)

কবির সেই স্বদেশ ভূম জাগ্রত হয়ে উঠেছে, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কবি হয়ে আছেন তাই তিনি এখন। ‘হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোন কবি করে না কসুর।’— এই মন্ত্রে ‘ভাষার শপথ আর প্রেমময় কাব্যের শপথ’ নিয়ে আজও তাই প্রাণ উজাড় করে লিখছেন তিনি, তিনিই আল মাহমুদ।

’আমাকে এ অদম্য চলার পথে নিয়ে এসেছে
তারা তো সবাই জানে আমার পা পাথর,
দৃষ্টি শক্তি স্বপ্নের কুয়াশায় আচ্ছন্ন।
তবু মানুষের মন বলে একটা কথা আছে। আছে না কি?
হ্যাঁ, মন বলছে এখনও আমার দিগন্তে পৌঁছার
খানিকটা পথ বাকি।’

(অদম্য চলার ইতিহাস/কবিতা সংগ্রহ)

এক সাক্ষাৎকারে আল মাহমুদ বলেছেন, ... আমিতো মনে করি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মতো যোগ্য কবি জসীমউদ্‌দীনও ছিলেন। কিন্তু নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ভাগ্য সবার কি হয়? জসীমউদ্‌দীনের মতো সমকক্ষ কবিরাই বিশ্বে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। জসীমউদ্‌দীনের মতো কবি যদি অন্য ভাষায় থাকতো তাহলে তাকে ঠিকই নোবেল পুরস্কার দেওয়া হতো।’

কেন জানি মাঝে মাঝে আমার মনে হয়— জীবনান্দ দাশ ও জসীমউদ্‌দীনের মিলিত স্বর, শৈলীর উত্তুঙ্গ প্রকাশ আর মধুসূদনের নিপাট সাহসের সম্মিলন আল মাহমুদ।

কবিতার শব্দ-ব্যবহারের নিপুণতাই নয় কিন্তু স্বতঃবেদ্য স্বাভাবিকতা এবং বিশ্বাসের অনুকুলতা নির্মাণে আল মাহমুদ নিঃসংশয়ে আধুনিক বাংলা ভাষার একজন অগ্রগামী কবি।

’আমাকে শিখতে হবে।
যেমন আমি একদা বৃক্ষের আওয়াজ থেকে বের করে নিতাম।
নদীর কাছ থেকে রপ্ত করেছিলাম তরঙ্গের ভাষা।
আমি গোখরো সাপের হিস্ হিসানির মধ্যেও কোনো জটিলতা দেখি না।
কিন্তু মানুষ যখন রাজনীতি, মানবকল্যাণ ও গণতন্ত্রের কথা বলে
তখন যেন মনে হয় একটা আস্ত দেশকে কতিপয় গূঢ়ার্থবাদী পিশাচ
----------------------------------ছারখার করে দিচ্ছে?
মানুষের ভাষার মত দুর্বোধ্য পৃথিবীতে আর কিছু নেই।’

(বিপরীত উচ্চারণ/কবিতা সংগ্রহ)

তার সম্পর্কে সৈয়দ আলী আহসান বলেছেন, আধুনিক জীবনের কর্মকাণ্ডের মালটিপ্লিসিটি বা বহুলীকৃত অজস্রতা অনেক কবিকে অস্থির করেছে, তাই তাঁদের কবিতায় ভাষার অস্পষ্টতা এবং জটিলতা এসেছে। আল মাহমুদের কবিতা এ-সংকট থেকে মুক্ত। আন্তরিক সত্যের সামীপ্যে তাঁর কবিতা স্পষ্টবাক প্রকৃতির মতো উন্মুক্ত ও স্বাভাবিক। কোনও অঘটনে নয় কিন্তু হৃদয়ের লোক-লোকান্তরে তার বসতি; তাই তিনি উজ্জ্বল, স্বতন্ত্র এবং একনিষ্ঠ’।

কবি ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামের মোল্লাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মীর আব্দুর রব, মাতা রওশন আরা মীর। জীবনস্মৃতির প্রকাশধর্মী গ্রন্থ— ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’তে তিনি বাল্যকাল এবং তার পরিবারের ঐতিহ্য এবং পরিবেশ বর্ণনা করেছেন তাতে তিনি তার এবং পরিবার সম্পর্কে যে সমস্ত কথা বলেন তা হচ্ছে—

‘আমার দাদা মীর আব্দুল ওহাব ছিলেন কবি। আরবী-ফার্সি ভাষায় সুপণ্ডিত। সংস্কৃতও জানতেন।।... লাঠিখেলা ও তরবারি চালনায় ওস্তাদ। পশু-পাখি ইত্যাদি পোষার অত্যন্ত শখ ছিল। ... তিনি ছিলেন ধর্মভীরু, অতিথিপরায়ণ ও অপরিণামদর্শী। ... সামান্য জমিজমা থেকে তার পরিবার সংসারের আহার্যের সংস্থান হতো। তাছাড়া তিনি বাড়ির সামনেই যে হাইস্কুলটি ছিল তাতে শিক্ষকতা ও প্রধান কেরানীর চাকরি করতেন।... গান-বাজনা ভালবাসতেন। কোরআন তিলাওয়াতের সময় মনে হতো এক অপার্থিব কণ্ঠ সুষমার অধিকারী তিনি।'

এই সত্যতার মাঝে ক্রমশ তৈরি হয়েছে কবির মানস গঠন। তার সমগ্র সৃষ্টিশীলতা আরও বহুকাল চিন্তাশীল মানুষকে আলোর পথ দেখাবে এ প্রত্যাশা আমাদের। কবির ৮২ তম জন্মদিন ১১ জুলাই বুধবার। জন্মদিনে তার প্রতি অশেষ ভালবাসা, শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি আমরা। আর সবার মত দ্য রিপোর্ট পরিবারও আপ্লুত এই শুভ ক্ষণটিতে। কবি দীর্ঘজীবী হোক এই দৃঢ়চেতা প্রত্যাশা আমাদের।

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/জুলাই ১১,২০১৮)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

সাহিত্য এর সর্বশেষ খবর

সাহিত্য - এর সব খবর