thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১,  ২০ জমাদিউল আউয়াল 1446

রিকসাশিল্পের কথকতা

২০১৮ জুলাই ২০ ১৮:৫৯:২১
রিকসাশিল্পের কথকতা

'ও সখিনা গেছস্ কিনা ভুইলা আমারে
আমি এহন রিসকা চালাই ঢাহা শহরে।’

হ্যাঁ। রিকসা একটি ত্রিচক্রযান, যা মনে আসলে ভেসে ওঠে রঙিন উজ্জ্বলময় যানের কথা। যা কিনা শিল্পের মান বিচারে হয়তোবা তেমন স্থান করে নিতে পেরেছে কিনা বলা কঠিন। তবে রিকসা যে একটি গাম্ভীর্যপূর্ণ শিল্পধারা বহন করে তা তার আপাদমস্তক চিত্রকলা বহন করবার শক্তি ও সাহস দেখলেই বোঝা যায়।

এটি ত্রিচক্রযান হলেও একটি শিল্পধারাকে সে বহন করে চলেছে বহু দশক ধরে। যাকে বলা যেতে পারে “একটি চলমান চিত্রপ্রদর্শনী”। কিন্তু এই রিক্সা কবে থেকে রিকসা হয়ে উঠল ! ১৮৬৩ সালে ফ্যালিস বিটোর ছবিতে রিকসা দেখা যায় ইয়োকাহামাতে। ১৮৭০ এর দিকে জাপানী কাঠের তৈরী রিকসার ব্যবহার দেখা যায়। পরবর্তীতে ১৯৩০ সালে ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, চীন ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে রিকসা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯১৯ সালে মিয়ানমার থেকে চট্টগ্রামে রিকসা এসে পৌঁছায় বলে ধারণা করা হয়। ঢাকায় প্রথম রিকসা আসে কলকাতা থেকে ১৯৩০ সালে। রিকসার ঐতিহ্যগতভাবে ঘোড়া, পালকি ও নৌকা ব্যবহারের জন্য এটি বেশ কৌতুকের জন্ম দেয়।

রিকসাশিল্প

তিনটি চক্রের প্যাডিক্যাব যা সাধারণত রিকসা নামে পরিচিত, ১৯৪০ এর যা ছিল একেবারেই সজ্জাহীন। এই দশকের শেষের দিকে রিকসার পেছনে ফুল, লতা-পাতা ও নেভিগেশন মোটিভ নিয়ে রিকসার সাজসজ্জা শুরু হয়। আমাদের দেশে ঢাকা ও রাজশাহীতে এবং প্রতিটি জেলায় নিজস্ব শৈলী নিয়ে রিকসা শিল্প হাজির হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে চট্টগ্রামকে পবিত্র নগরী মনে করা হতো বিধায় এখানকার রিকসাগুলোতে এজাতীয় চিত্রের ব্যবহার ছিল অপ্রতুল। কিন্তু ঢাকার রিকসায় বিভিন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্য, কুমিল্লার রিকসায় ফুল, নকশা ও আল্লাহু লেখা। ফলে রিকসাশিল্প স্থান-কাল-পাত্রভেদে তার বিষয়কে পরিবর্তন করে এগিয়ে চলে।

রিকসাশিল্পের ধারক কারা ?

বলা হয় সাধারণ মানুষের জন্য সাধারণ মানুষের যে শিল্প তাই লোকশিল্প। সেই বিচারে রিকসা শিল্পকে লোকশিল্প বলা যেতে পারে। আবার রিকসাশিল্পের মধ্যে কারুশিল্পও মিশ্রিত। আকৃতি অনুযায়ী কোথাও রঙের পেলবতা, কোথাও বা কাঠ-স্টিল-পিতলের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। রিকসাশিল্প সব শ্রেণির মানুষকে আকৃষ্ট করে বলে মনে হয়। কারণ তার নিজস্ব চিত্ররীতি ও রঙের ব্যবহারের স্বকীয়তার কারণে। উচ্চমানের গ্যালারি নয়, তবে রিকসাচিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে সবচেয়ে জনবহুলতায়, জনসমুদ্রে, রাস্তায়-রাস্তায়। পুরান ঢাকায় আর. কে. দাশ ও আলাউদ্দিন আহমেদ ১৯৬০ এর প্রথম রিকসাচিত্র শুরু করেন। রিকসাচিত্র ঢাকা ও এলাহাবাদে শিল্পকলা হিসেবে ব্যাপক আলোড়িত হয়।

বিষয় অবস্থানে রিকসাশিল্প

রিকসা একটি পরিবহন, যা নিজেই লোকশিল্পের একটি টুকরো। ফলে লোকশিল্পের নানা বিষয়াদি রিকসা চিত্রকলায় উঠে এসেছে। প্রকৃতি বা ল্যান্ডস্কেপ একটি জনপ্রিয় বিষয় যা রিকসা চিত্রে নানা আঙ্গিকে দেখা যায়। তবে তা পুরোপুরি একাডেমিক ঢংয়ের তো নয়ই, নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে স্বতন্ত্র রীতিতে তা অঙ্কিত। এর বিষয়বন্তু হিসেবে আমরা দেখতে পাই এক বিচিত্রতা। কখনও তা রাজনৈতিক, কখনওবা আন্তর্জাতিক, ধর্মীয় চরিত্র বা মিথ, আবার কখনও আমাদের গর্বের ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি নিয়ে, কিংবা ব্যাঙ্গাত্বক কিন্তু প্রতিবাদমুখরচিত্র। বিষয় নির্বাচনে একেবারেই খাটো করে দেখা যায় না। রিকসাচিত্র স্থান-কাল-পাত্রভেদে তার বিষয় নিয়ে এগিয়ে চলে। চিত্রকলায় সময়োপযোগী প্রাসঙ্গিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য দিক।

হয়তো চলচিত্রের নানা ধরনের রঙ্গিন স্বপ্নের জগতকে একটি ফ্রেমে বন্দী করে এগিয়ে চলে রিকসা শিল্প। সাধারণ মানুষকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ওই সময়ে। প্রতিবাদের ভাষা যে সবসময় রূঢ় হয়না, তা রিকসাচিত্র দেখলেই বোঝা যায়। কখনো তা ব্যঙ্গাত্বকও হয়ে ওঠে। উদাহরণ স্বরূপ আমরা বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র ‘চার্লি চ্যাপলিন’ দেখলে বুঝতে পারি, কৌতুকময় অভিনয়ের মধ্যেও কি গাঢ় প্রতিবাদ লুকিয়ে থাকে। ঠিক তেমনি অবস্থানে আমাদের রিকসার চিত্রের মধ্যেও একটি প্রতিবাদী চরিত্র লক্ষ্য করা যায়। বিশ্ব ইতিহাস থেকে যেমন চীনের প্রাচীর, মিশরের পিরামিড, তাজমহল, কিংবা আমাদের ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের বিষয়গুলি নিয়ে রিকসাচিত্র অনেকভাবেই চিত্রিত হয়েছে। উঠে এসেছে মহান বীরদের মুখাবয়ব। মুখাবয়ব রিকসাচিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক্ষেত্রে যেমন বিশ্ববরেণ্যের মুখচ্ছবি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থেকে পেলে, ম্যারাডোনাকে দেখা যায় তেমনি রাজনৈতিক মুখাবয়ব হিসাবে লাদেন, বুশ এর মুখচ্ছবিও দেখতে পাই আমরা। ধর্মীয় নানাচিত্র যেমন আল্লাহু লেখা, নানা আরবি হরফে নানা ঢঙে লেখা, কাবা শরিফ এর চিত্রও দেখা যায় রিকসা শিল্পে।

অতি সাধারণের কাছাকাছি একটি শিল্প এই রিকসাশিল্প। ফলে সাম্প্রতিক সময়ের চারপাশের যা কিছু আছে তা উঠে আসে এই রিকসা শিল্পে। আবার পরিবার, সমাজ ও নিজস্ব অনুভূতি, দুঃখ, ভালোবাসার গল্পও রচিত হয় নিজস্ব ঢঙে রিকসার প্রতিটি কোণায়। রিকসা একটি পরিবেশবান্ধব ও স্বল্প খরচের যান হওয়ায় সমাজের প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছায় তার আবেদন। ফলে রিকসা শিল্পও সব স্তরে পৌঁছে যায় তার রঙিন স্বপ্নময় চিত্রজগৎ নিয়ে।

(আগামী কিস্তিতে সমাপ্ত)

লেখক : চিত্রশিল্পী ও সমালোচক

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/জুলাই ২০,২০১৮)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

সাহিত্য এর সর্বশেষ খবর

সাহিত্য - এর সব খবর