thereport24.com
ঢাকা, মঙ্গলবার, ১ জুলাই 25, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২,  ৫ মহররম 1447

আজ বিশ্ব বাঘ দিবস

হুমকির মুখে সুন্দরবনের বাঘ

২০১৮ জুলাই ২৯ ০৯:১৪:৩৫
হুমকির মুখে সুন্দরবনের বাঘ

খুলনা ব্যুরো : মানুষের অত্যাচার আর প্রাকৃতিক কারণে হুমকির মুখে পড়েছে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের বাঘ। এর ফলে উদ্বেগজনক হারে কমে যাচ্ছে বাঘের সংখ্যা। সবচেয়ে বেশি মারা পড়ছে মানুষের হাতে। দীর্ঘদিন ধরে চোরা শিকারিরা শিকার করে চামড়া, হাড়সহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচার করে আসছে। খাদ্য সংকটসহ বিভিন্ন কারণে লোকালয়ে চলে আসা বাঘ পিটিয়ে হত্যা করছে গ্রামবাসী। বার্ধক্যজনিত কারণে ও লবণাক্ত পানি পান করায় লিভার সিরোসিস রোগেও মারা যাচ্ছে অনেক বাঘ। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগেও মৃত্যু হচ্ছে তাদের। এই পরিস্থিতিতেই দেশে আজ উদযাপিত হচ্ছে বিশ্ব বাঘ দিবস।

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০০৪ সালে পাগ মার্ক বা পায়ের ছাপ গণনা পদ্ধতিতে করা শুমারিতে সুন্দরবনে ৪৪০টি বাঘ ছিল। আর ২০১৫ সালে ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতিতে করা শুমারি অনুযায়ী সুন্দবরনে বাঘ রয়েছে মাত্র ১০৬টি।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১৭ বছরে বিভিন্ন কারণে ৪৩টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে লোকালয়ে আসা ১৪টি বাঘ। চোরা শিকারিদের হাতে আটটি বাঘ নিহত হয়েছে। আর বাঘের চামড়া উদ্ধার হয়েছে ১০টি। বার্ধক্যজনিত কারণে আটটি ও অসুস্থতার কারণে দুটি বাঘ মারা গেছে। ঘূর্ণিঝড় সিডরে মারা গেছে একটি বাঘ। এ ছাড়া ২০১২ সালের ১১ জুন পাচারের সময় উদ্ধার হয় বাঘের তিনটি বাচ্চা। স্থানীয় বন বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এই সংখ্যা সরকারি হিসাবের তুলনায় বেশি।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. মদিনুল আহসান বলেন, 'এখন সুন্দরবনের বাঘের প্রধান হুমকি তিনটি- বাঘ হত্যা, বাঘের শিকার প্রাণী (হরিণ) হত্যা এবং বাঘের আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। ২০১৮ থেকে ১০ বছরের জন্য প্রণীত টাইগার অ্যাকশন প্ল্যানে এই হুমকিগুলো চিহ্নিত করে তা মোকাবেলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে।

সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারে বাঘের চামড়া, হাড়, দাঁতসহ অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সে কারণে চোরা শিকারিরা দীর্ঘদিন ধরে বাঘ শিকার করছে। আগে বনদস্যুরা শুধু বনজীবীদের কাছ থেকে চাঁদা ও মুক্তিপণ আদায় করলেও এখন বন্যপ্রাণীও শিকার করছে তারা।'

তিনি আরও বলেন, 'বাঘের বিচরণক্ষেত্রগুলোতে হরিণের সংখ্যা কমে যাওয়ায় মাঝে মধ্যে বাঘের খাদ্য সংকট দেখা দেয়। এ ছাড়া বিভিন্ন কারণে বাঘ নদী-খাল পেরিয়ে লোকালয়ে চলে আসে। তখন গ্রামবাসী গণপিটুনি দিয়ে তা হত্যা করে। অসুস্থতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বার্ধক্যজনিত কারণেও কিছু বাঘ মারা যাচ্ছে।'



খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, 'জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জোয়ারের সময় নদীর পানির উচ্চতা বাড়ছে। এর ফলে বনভূমি ডুবে যাওয়ার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় কমেছে বাঘের বিচরণক্ষেত্র। পাশাপাশি লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় মিষ্টি পানি পাচ্ছে না তারা। ওই পানি পান করায় অসুস্থ হয়ে পড়ছে বাঘ। নির্বিচারে গাছ কেটে উজাড় করা, খাদ্য সংকট, অপরিকল্পিত পর্যটন ও বনের মধ্য দিয়ে ভারী নৌযান চলাচলেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাঘের ওপর।'

র‌্যাব, পুলিশ, বন বিভাগ ও বনজীবী সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনে চোরা শিকারিরা বিভিন্নভাবে বাঘ হত্যা করে থাকে। তারা কখনও গুলি করে, আবার কখনও ফাঁদে আটকে বাঘ শিকার করে। ছাগল বা হরিণ মেরে সেগুলোর শরীরে বিষ মেখে বাঘের খাবার হিসেবে বনে ফেলে রাখা হয়। বাঘ এসব বিষমাখা মৃত প্রাণী খেয়ে বিষের প্রতিক্রিয়ায় মারা যায়, আর তা না হলে মুমূর্ষু হয়ে পড়ে। তখন সেটিকে সহজে হত্যা করা হয়।

মৃত বাঘের শরীর থেকে চোরা শিকারিরা চামড়া, মাথার খুলি, দাঁত, পুরুষাঙ্গ, হাড়সহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করে। এরপর আন্তর্জাতিক চোরাকারবারিদের কাছে এসব চড়া দামে বিক্রি করে দেয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কালোবাজারে বাঘের চামড়া, হাড়, দাঁত, মাংস, চর্বির তেল ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

এদিকে বাঘ প্রায়ই বন সংলগ্ন গ্রামগুলোর লোকালয়ে হানা দিয়ে মানুষসহ গবাদিপশু হত্যা করে। পাশাপাশি সচেতনতার অভাবেও পিটিয়ে বাঘ হত্যা করছে গ্রামবাসী। সর্বশেষ গত ২৩ জানুয়ারি লোকালয়ে আসা একটি বাঘ বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ উপজেলার গুলিশাখালীর গ্রামবাসী পিটিয়ে হত্যা করেছে। বনের অভ্যন্তরের লবণাক্ত পানি পান করার জন্য লিভারের নানারকম পীড়ায় অনেক বাঘের অকাল মৃত্যু হচ্ছে।

খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, 'বাঘসহ বন্যপ্রাণী শিকার প্রতিরোধে সুন্দরবনের মধ্যে জিপিএস সিস্টেমের সাহায্যে চলছে 'স্মার্ট পেট্রোলিং'। বন বিভাগ, পুলিশ, র‌্যাব, কোস্ট গার্ড ও নৌ পুলিশ যৌথভাবে বাঘ শিকার প্রতিরোধে কাজ করছে। বাঘ রক্ষা ও সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বন বিভাগ সচেষ্ট রয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'অসুস্থ বাঘকে সেবাদানের জন্য খুলনায় একটি 'ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টার' স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া লোকালয়ে আসা বাঘ রক্ষায় সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামগুলোতে ৪৯টি ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম গঠন করা হয়েছে।'

র‌্যাব-৬-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এনায়েত হোসেন মান্নান বলেন, 'বাঘ শিকার ও বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচার বন্ধে র‌্যাব সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ও লোকালয়ে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। শিকারিদের তৎপরতা আগের তুলনায় এখন অবশ্য কম।'



বাঘ মনিটরিংয়ের ফল ডিসেম্বরে

সুন্দরবনে ক্যামেরা ট্রাপিং পদ্ধতিতে বাঘ মনিটরিং বা পরিবীক্ষণ-এর ফলাফল প্রকাশ করা হবে আগামী ডিসেম্বর মাসে। তখন জানা যাবে ২০১৫ সালে করা শুমারির চেয়ে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে, নাকি কমেছে।

বন বিভাগ জানিয়েছে, ২০১৬ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০১৭ সালের ১৫ মার্চ পর্যন্ত সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের ৩৪০টি পয়েন্টে মোট ৪৪১টি ক্যামেরা বসিয়ে বাঘ মনিটরিং করা হয়। এরপর গত ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মাস বনের খুলনা ও শরণখোলা রেঞ্জের ৪৮০ বর্গকিলোমিটার এলাকার ২৩৯টি পয়েন্টে গাছ বা খুঁটির সাথে ৪৭৮টি ক্যামেরা বসিয়ে বাঘ মনিটরিং করা হয়।

বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. মদিনুল আহসান বলেন, বর্তমানে ক্যামেরায় তোলা ছবিসহ অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত বিশ্নেষণের কাজ চলছে ঢাকার জিআইএস ল্যাবে। বাঘের সংখ্যাসহ বর্তমান অবস্থা এবং বাঘ যেসব প্রাণী খায় সেগুলোর অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য এই পরীবিক্ষণ করা হয়েছে। যেসব এলাকায় বাঘ রয়েছে সেখানে বনজীবীদের উপস্থিতি কেমন, পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে তাও। আগামী ডিসেম্বরে ফলাফল প্রকাশের সম্ভাবনা রয়েছে।

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/জুলাই ২৯,২০১৮)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

জাতীয় এর সর্বশেষ খবর

জাতীয় - এর সব খবর