thereport24.com
ঢাকা, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১,  ২১ জমাদিউস সানি 1446

কুরআন ও আধুনিক বিজ্ঞান-১

২০১৯ মার্চ ১৫ ০০:৩০:১৩
কুরআন ও আধুনিক বিজ্ঞান-১

আবদুর রহীম গ্রিন

এটা একটা স্বীকৃত সত্য যে আমরা যে বিশ্বে বাস করছি তা সমপ্রসারণশীল। “আল্লাহই দিন এবং রাত তৈরী করেছেন, এবং চাঁদ ও সূর্য। প্রত্যেকেই নিজ নিজ গতিতে কক্ষপথে সাঁতার কাটছে/ঘুরছে।” নিজ গতিতে চলার জন্য যে আরবী শব্দ ব্যবহৃত হয় তা হচ্ছে সাবাহাহ্‌ (এই আয়াতে ইয়াসবিহুনা)। এটা এমন গতি নির্দেশ করছে যা বস্তুর নিজের। যদি এটা পানিতে ঘটত, তাহলে এটা হত সাঁতার কাটা; এটা সেই নড়াচড়া যা একজনের পায়ের মাধ্যমে হয়। মহাশূন্যে নড়াচড়ার সময় এটা হবে নিজের অক্ষের উপর ঘুরে যাওয়া। সূর্য নিজের কক্ষপথে পৃথিবীর চারপাশে নয়, বরং ছায়াপথের কেন্দ্রের চারপাশে ঘোরে, সুতরাং এখানে কোন বৈপরীত্য নেই, কারণ কুরআন সূর্যের কক্ষপথ নির্দিষ্ট করেনি।

কুরআন হচ্ছে শেষ ওহী এবং একটি প্রমাণ, যা শুধু চৌদ্দশত বৎসর আগের আরবদের জন্য নয়, আজকের বিজ্ঞানীদের জন্যও। যারা বিংশ শতাব্দীতে বাস করছে–যা খুব শীগগিরই একবিংশ শতাব্দী হয়ে যাবে, তাদের জন্য কুরআনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হয়তোবা এটা যে, আধুনিক বিজ্ঞানের অধিকাংশ আবিষ্কার ও কুরআন পরস্পর সঙ্গতিপূর্ণ, এবং কোন কোন ক্ষেত্রে আগের ধারণাকৃত বহু বিষয় গত বিশ বৎসরে আবিষ্কৃত হয়েছে। এ বিষয়ে অগ্রণী পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন মরিস বুকাইলী, যিনি গভীর অধ্যয়নের ফলস্বরূপ ‘বাইবেল, কুরআন ও বিজ্ঞান’ নামক একটি বই লিখেছেন। এ বইয়ে তিনি প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক বিষয়ে প্রাপ্ত বাইবেল ও কুরআনের বক্তব্য তুলনা করেছেন। বিচার–বিশ্লেষণের পরে তাঁর সিদ্ধান্ত হচ্ছে:

“পূর্ববর্তী দুটি ঐশীবাণী অর্থাৎ তাওরাত ও ইঞ্জিলের পর কুরআন অবতীর্ণ হয়। কুরআনের বাণীসমূহ যে শুধুমাত্র স্ববিরোধিতা থেকেই মুক্ত তা নয়, বাইবেলের মত এতে মানুষের কোন হস্তক্ষেপের প্রমাণ নেই। কেউ যদি নিরপেক্ষভাবে এবং বৈজ্ঞানিক বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর বক্তব্যসমূহ পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে দেখতে চায়, তাহলে দেখতে পাবে যে তা আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তদুপরি বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট বক্তব্য ও বাণী সেখানে রয়েছে। তারপরও এটা অচিন্তনীয় যে মুহাম্মাদের সময়ের একজন মানুষ এর রচয়িতা হতে পারে।এতকাল যাবত যে সব আয়াতের বক্তব্য ব্যাখ্যা করা সম্ভব হচ্ছিল না, আধুনিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞান আমাদেরকে সে সবের অর্থ বোঝার ব্যাপারে সাহায্য করেছে। একই বিষয়ে বাইবেল ও কুরআনের বক্তব্যের তুলনা করলে কিছু মৌলিক পার্থক্য ধরা পড়ে। বাইবেলের বর্ণনা যেখানে বৈজ্ঞানিকভাবে অগ্রহণযোগ্য, সেখানে কুরআনের বর্ণনা আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে প্রাপ্ত জ্ঞান ও তথ্যের আলোকে সঙ্গতিপূর্ণ। উদাহরণ হিসাবে সৃষ্টিতত্ত্ব ও মহাপ্লাবনের বিষয নেওয়া যেতে পারে। ইহুদীদের মিসর–ত্যাগের ঘটনার বর্ণনায় কুরআন বাইবেলের সম্পূরক। যেমন প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারে দেখা গেছে, মূসার আমলকে চিহ্নিত করা যায় এমন সব নিদর্শন কুরআন ও বাইবেলের বর্ণনার মিল প্রমাণ করছে। এছাড়া অন্য সব বিষয়ে এই দুই গ্রন্থের পার্থক্য বিরাট। যা আসলে এতদিন যাবত মুহাম্মাদ সম্পর্কে চলে আসা এই অভিযোগকেই খণ্ডন করছে যে তিনি কুরআন রচনা করেছেন বাইবেল থেকে নকল করে, কোন প্রমাণ দেওয়া ছাড়াই এসব অভিযোগ করা হতো।

মুহাম্মাদের আমলের জ্ঞানের উৎকর্ষতার আলোকে এটা ধারণাতীত যে কুরআনের বিজ্ঞান সম্পর্কিত বক্তব্য কোন মানুষের করা। সুতরাং এটা স্বীকার করে নেওয়া অত্যন্ত যথাযথ যে কুরআন শুধু অবতীর্ণ কিতাব নয়, বরং এর সঠিকত্বের নিশ্চয়তার জন্য এবং এতে বর্ণিত বৈজ্ঞানিক তথ্যের জন্য একে বিশেষ মর্যাদার স্থান দেওয়া উচিত, কারণ কুরআনের অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা একথাই প্রমাণ করে যে এর কোন মানবিক ব্যাখ্যা অসম্ভব।”
আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা সমর্থিত কিছু বক্তব্য-

১। ভ্রূণসৃষ্টি ও এর বিকাশ সম্পর্কিত যথাযথ বর্ণনা:

নবী মুহাম্মাদের সময়ে এ সম্পর্কে বিরাজমান তত্ত্বের ভিতরে এরিস্টটলের এই ধারণা অন্তর্ভুক্ত ছিলো যে একটি শিশু রক্তের জমাট বাঁধা অবস্থা থেকে সৃষ্ট, যেভাবে পনীর তৈরী হয়। আঠারশ শতাব্দীতে হার্টসিকার দাবী করেন যে তিনি আদি মাইক্রোস্কোপ–এর সাহায্যে স্পার্ম এর মধ্যে প্রাথমিকভাবে গঠিত মানুষ দেখতে পেয়েছেন। কুরআন এসব কিছুই বলছে না, বরং মানবের ভ্রূণাবস্থার বিকাশের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বর্ণনা দিচ্ছে:

“আমি তো মানুষকে মাটির উপাদান থেকে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর আমি তাকে শুক্রবিন্দুরূপে এক নিরাপদ আধারে স্থাপন করি, পরে আমি শুক্রবিন্দুকে পরিণত করি জমাট রক্তে, অতঃপর জমাট রক্তকে পরিণত করি পিণ্ডে এবং পিণ্ডকে পরিণত করি অস্থিপিঞ্জরে, অতঃপর অস্থিপিঞ্জরকে মাংস দ্বারা ঢেকে দিই, অবশেষে তাকে রূপ দান করি। সুনিপুণ স্রষ্টা আল্লাহ কত মহান! এরপর তোমরা অবশ্যই মৃত্যুবরণ করবে। অতঃপর কিয়ামতের দিন তোমাদের পুনরুত্থিত করা হবে।” (সূরা আল মু’মিনুন, ২৩, ১২–১৬)

নবী (সা.) আরো ব্যাখ্যা করেন যে “নুতফা” পুরুষের শুক্রাণু ও নারীর ডিম্বাণু উভয়টিকেই বোঝায়। “আলাকা” শব্দটির তিনটি অর্থ আছে আরবীতে: (১) আঁকড়ে থাকা বস্তু, (২) জমাট রক্তবিন্দু, (৩) জোঁকের মত বস্তু। তিনটি অর্থই বিকাশমান ভ্রূণের প্রথম ধাপকে সঠিকভাবে বর্ণনা করে। নিষিক্ত ডিম্বাণু এমন হয় যে তা জরায়ূর দেওয়াল আঁকড়ে ধরে রাখে। তারপর আকার ও আচরণের দিক থেকে সেটা জোঁকের সাদৃশ্য অবলম্বন করে। জোঁক এবং ভ্রূণ উভয়েই রক্ত শোষণ করে। এটা জমাট রক্তবিন্দুর মতও হয়ে থাকে। পরবর্তী স্তরে এটা চিবানো–বস্তুর মত হয় দেখতে, এটাও সঠিক। এটাও সত্যি যে পেশী ও মাংসের পূর্বে অস্থি তৈরী হয়। রাসূলের হাদীসে এসেছে:
“যখন বিয়াল্লিশ দিন পার হয়, আল্লাহ একজন ফেরেশতা পাঠান যখন সে ভ্রূণকে আকার দান করে, এর কান, চোখ, চামড়া, মাংস এবং হাড় তৈরী করে। তারপর সে জানতে চায়, “হে রব, এটা কি পুরুষ অথবা নারী? এবং তোমাদের প্রভু স্থির করেন যা তিনি চান এবং তখন ফেরেশতারা তা লিখে নেয়।”

এই যথাযথ তথ্য বর্ণিত দিকগুলির বিকাশের সঠিক সময় জানাচ্ছে এবং ভ্রূণের লিঙ্গ ঠিক বিয়াল্লিশ দিনের পূর্বে সুনিশ্চিত ভাবে জানা সম্ভব নয়। মাত্র কয়েক দশক পূর্বেও শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কারের আগে এটা জানা সম্ভব ছিল না। শীর্ষস্থানীয় ভ্রূণতত্ত্ববিদগণের অন্যতম কিথ মুর, কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনাটমি বিভাগের প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, কুরআনের এই সমস্ত বক্তব্য ও সহীহ হাদীসের বক্তব্য সম্পর্কে বলেন, “উনিশ শতক পর্যন্ত, মানবীয় বিকাশের ধাপগুলি সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না। উনিশ শতকের শেষ দিকে বর্ণমালার প্রতীকের উপর ভিত্তি করে মানব ভ্রূণের বিকাশের বিভিন্ন ধাপ চিহ্নিত করা হয়। বিশ শতকে সংখ্যার সাহায্যে এর ২৩টি ধাপ বর্ণনা করা হয়। এই সংখ্যার সাহায্যে চিহ্নিতকরণ পদ্ধতি অনুসরণ করা সহজ নয় এবং একটি ভালো পদ্ধতি হবে অঙ্গসংস্থান বিদ্যার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা পদ্ধতি। সামপ্রতিককালে কুরআনের অধ্যয়নের ফলে ভ্রূণবিকাশের বিভিন্ন ধাপ চিহ্নিতকরণের আর একটি পদ্ধতি প্রকাশিত হয়েছে যা এর সহজবোধ্য আকৃতির পরিবর্তন ও নড়াচড়ার উপর ভিত্তি করে তৈরী। এখানে যেসব শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তা আল্লাহ জিবরাইলের মাধ্যমে রাসূল (সা.) কে জানিয়েছেন এবং তা কুরআনে লিপিবদ্ধ হয়েছে…. এটা আমার কাছে পরিষ্কার যে এসব বক্তব্য নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছ থেকে মুহাম্মাদ (সা.) এঁর কাছে এসেছে কারণ এই জ্ঞানের প্রায় সবটুকুই অবিষ্কৃত হয়েছে এর বহু শতক পরে। এটা আমার কাছে প্রমাণ করছে যে মুহাম্মাদ নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল।”

ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এনাটমি বিভাগের প্রফেসর ও চেয়ারম্যান এবং ফিলাডেলফিয়ারটমাস জেফারসন বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্যানিয়েল বাও ইনস্টিটিউটের পরিচালক মার্শাল জনসন বলেন, “বিজ্ঞানী হিসাবে আমি সেসব বস্তু নিয়ে কাজ করি যা আমি নির্দিষ্টভাবে দেখতে পারি। আমি ভ্রূণতত্ত্ব এবং ডেভেলপমেন্টাল বায়োলজি বুঝতে পারি। আমি কুরআনে যে শব্দগুলি আমার কাছে অনুবাদ করে দেওয়া হয়েছে তা বুঝতে পারি। আমাকে যদি আমার আজকের জ্ঞান ও বর্ণনার যোগ্যতা সহকারে সেই যুগে স্থানান্তর করা হয়, আমি ব্যাপারগুলি যেভাবে বর্ণনা করা আছে সেভাবে বর্ণনা করতে পারব না। আমি এটা প্রত্যাখ্যানের কোন কারণ দেখি না যে মুহাম্মাদ এই তথ্য অন্য কোথাও থেকে পেয়েছেন, সুতরাং আমি এই ধারণার সাথেও সাংঘর্ষিক কিছু দেখতে পাই না যে তিনি যা বলেছেন তাতে ঐশী হস্তক্ষেপ রয়েছে।”

২। মহাকাশবিজ্ঞান:

“অবিশ্বাসীরা কি ভেবে দেখে না যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল; অতঃপর আমি উভয়কে পৃথক করে দিলাম; এবং জীবন্ত সব কিছু পানি থেকে সৃষ্টি করলাম; তবুও কি তারা বিশ্বাস করবে না?” (সূরা আল আম্বিয়া, ২১:৩০)
এই আয়াতটি বিশ্বের উৎপত্তির সাধারণ তত্ত্ব বর্ণনা করছে, যে সত্য আজ থেকে চল্লিশ বছর আগেও নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যার সূচনার আগে আবিষ্কৃত হয়নি। এখানে যে পৃথক করার বলা হয়েছে তা বিজ্ঞানীদের কথিত “বিগ–ব্যাং” তত্ত্বের অনুরূপ। তাছাড়া, সমস্ত জীবিত প্রাণী প্রটোপ্লাজম দিয়ে তৈরী যার ৮০–৮৫% ভাগই পানি।
“অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন, যা ছিল ধূম্রপুঞ্জ বিশেষ। অনন্তর তিনি আকাশ ও পৃথিবীকে বললেন, ‘তোমরা উভয়ে আমার আদেশ পালনের জন্য ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় প্রস্তুত হও।’ তারা বলল, ‘আমরা তো অনুগত থাকতে পস্তুত আছি।” (সূরা আল ফুসসিলাত, ৪১:১১)
এখানে ধূম্রপুঞ্জ শব্দটি বিশ্বের আদিম অবস্থার সঠিক বর্ণনা দিচ্ছে, যা ছিল গরম গ্যাসের পিণ্ড যাতে বস্তুকণা দ্রুত ছোটাছুটি করছে, ধোঁয়ার মত। এ থেকে গ্রহ, নক্ষত্র ও পৃথিবী তৈরী হয়।
“আমি আমার ক্ষমতাবলে আকাশ নির্মাণ করেছি এবং আমিই একে সমপ্রসারিত করছি।” (সূরা আয যারিয়াত, ৫১:৪৭)

লেখক: বিখ্যাত ইসলামী স্কলার

(শেষাংশ আগামী কিস্তিত)

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/মার্চ ১৫,২০১৯)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

ধর্ম এর সর্বশেষ খবর

ধর্ম - এর সব খবর