thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ১৮ মে 24, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১,  ১০ জিলকদ  1445

চীনা ব্যাংকের দেরিতে ৬৬৫ কোটি গচ্চা বাংলাদেশের!

২০১৯ জুলাই ০৩ ১৯:২৬:২২
চীনা ব্যাংকের দেরিতে ৬৬৫ কোটি গচ্চা বাংলাদেশের!

দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: ‘খুলনা ৩৩০ মেগাওয়াট ডুয়েল ফুয়েল কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ’ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৯ সালের জুনে। আড়াই বছরে কাজ শেষ তো হয়নি, কেবল শুরু হচ্ছে! প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ১২ থেকে ১৩ শতাংশ।

এ অবস্থায় গত ১৮ জুন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটির মেয়াদ প্রাক্কলিত সময়ের চেয়ে বেশি অর্থাৎ তিন বছর বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, চলতি বছরের জুনের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে বাংলাদেশের খরচ হতো তিন হাজার ২৫৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এখন খরচ করতে হবে তিন হাজার ৯১৯ কোটি ২৬ লাখ টাকা। তাদের দাবি, চুক্তিবদ্ধ চীনা ব্যাংক ঋণ দিতে দেরি করেছে। এজন্য প্রকল্পের কাজ যথাসময়ে শেষ করা যায়নি। চীনা ব্যাংক ঋণ দিতে দেরি করায় বাংলাদেশকে বাড়তি অর্থ গচ্চা দিতে হচ্ছে। এ অর্থের পরিমাণ ৬৬৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা!

বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের এ প্রকল্পে ঋণ দিচ্ছে এক্সপোর্ট ক্রেডিট এজেন্সির (ইসিএ) আওতায় এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক অব চায়নার দ্য জিয়াংজু শাখা। এ প্রকল্পে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করছে ইসিএ।

এ বিষয়ে প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী জ্যোতির্মায়া হালদার বলেন, ‘এ প্রকল্প এতটা পিছিয়ে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, চীনের ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ পেতে দেরি হওয়া। ঋণ পেতে প্রায় দুই বছর লেগে গেছে। অথচ প্রকল্পের মেয়াদ হলো আড়াই বছর।’

তার বক্তব্য, দেরি না হলে হয়তো এত ব্যয় বাড়ত না। দেরির কারণে ব্যয় বাড়ছে। এটা আমাদের হাতে ছিল না। আমরা চেষ্টা করেছি, কিন্তু ব্যাংকটা দেরি করেছে।’

‘চায়নার জিয়াংজু ব্র্যাঞ্চের এক্সিম ব্যাংক, ওরাই দেরিটা করছে। ওদের এটা সরকারি ব্যাংক, এতে ওদের প্রেসিডেন্টের অনুমোদন লাগছে। এ অনুমোদন নিতেই তাদের সময় লাগছে বেশি। এটা তাদের (চীনের) ভাষ্য। চিঠিপত্র বিভিন্ন সময় আমরা লিখছি তো, সেসব চিঠিতে তারা জানাইছে…’- যোগ করেন জ্যোতির্মায়া হালদার।


তবে বাংলাদেশের এ ক্ষতির দায়ভার নেবে না চীনের ব্যাংকটি- জানান প্রধান প্রকৌশলী।

প্রকল্পটির উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) যিনি তৈরি করেছেন, তারও ভুল রয়েছে বলে জানান প্রকৌশলী জ্যোতির্মায়া হালদার। তার বক্তব্য, ‘ইসিএ-এর আওতায় অর্থ পেতে দেরি হয়। আগে যারা উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) বানাইছে, তারাও ভুল করছে। এটা নিয়ে আলোচনাও হইছে। এখানে সময় লাগে, তাহলে এত কম সময় ধরছেন কেন?’

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়/বিদ্যুৎ বিভাগের উদ্যোগে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড।

যেখান থেকে অতিরিক্ত অর্থ আসবে
প্রকল্পের মূল অনুমোদিত ডিপিপি অনুযায়ী, এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক অব চায়নার দ্য জিয়াংজু শাখার ঋণ দেয়ার কথা ছিল দুই হাজার ১২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। কিন্তু অতিরিক্ত ৬৬৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকার জোগান পেতে বাংলাদেশ এখন ব্যাংকটির কাছ থেকে অতিরিক্ত ৩৫৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ঋণ নেবে। অর্থাৎ চীনের ব্যাংকটির কাছ থেকে বাংলাদেশ এখন ঋণ নিচ্ছে দুই হাজার ৩৭০ কোটি ৪১ লাখ টাকা।

২০২২ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হতেই বাংলাদেশকে এ ঋণের বিপরীতে শুধু সুদই দিতে হবে ১৯৪ কোটি ২২ লাখ ৬ হাজার টাকা। অতিরিক্ত ৬৬৫ কোটি টাকার খরচ মেটাতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে দিতে হবে ১৯৬ কোটি দুই লাখ টাকা এবং বাংলাদেশ সরকার রাজস্ব খাত থেকে দেবে ১১৩ কোটি দুই লাখ টাকা।

কাজ না হলেও বেতন বাবদ খরচ ২ কোটি
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পটি শুরু হলেও অর্থায়ন না থাকায় বস্তুতপক্ষে তেমন কোনো কাজ ছিল না। তবে প্রকল্পের আওতায় নিযুক্ত কর্মকর্তাদের ঠিকই বেতন দিতে হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বেতন বাবদ খরচ হয়েছে এক কোটি ৪৫ লাখ ১৫ হাজার টাকা।

পরিবেশগত ছাড়পত্রের জন্য এ প্রকল্পে পরামর্শ সেবায় খরচ হয়েছে এক কোটি ১৯ লাখ ৩২ হাজার টাকা। দুই বছরে এতটুকুই ছিল কাজের অগ্রগতি, যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের শূন্য দশমিক ০৪ শতাংশ।

এ বিষয়ে প্রধান প্রকৌশলী জ্যোতির্মায়া হালদার বলেন, ‘এনভায়রনমেন্টাল কনসালটেন্টের (পরিবেশবিষয়ক পরামর্শক) জন্য খরচ হয়েছে। একটা প্রকল্প করতে গেলে পরিবেশগত ছাড়পত্র লাগে। এটার জন্য আমরা সরকারের একটা প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম। ওরা ওয়াটার বোর্ডের ট্রাস্টি। এ প্লান্টটা হলে পরিবেশের কী ধরনের পরিবর্তন হবে, এর ওপর ওরা একটা কাজ করেছে। এতে খরচ হয়েছে।’

স্থানীয় প্রশিক্ষণ, পরামর্শ সেবা, সভাসহ ৩০ খাতে খরচ বেড়েছে
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র মতে, প্রকল্পটির ৪০টি খাতের মধ্যে যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে সভা, বিজ্ঞাপন, মেরামত, ভাতা, বেতন, যানবাহন, ভ্যাট, পরামর্শ সেবা, বৈদেশিক প্রশিক্ষণ, স্থানীয় প্রশিক্ষণ, খুচরা যন্ত্রাংশ কেনাসহ ৩০টিতেই খরচ বেড়েছে।

বাড়তি ৬৬৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকার মধ্যে অফিসারদের বেতন বেড়েছে ৫৯ লাখ ৫৫ হাজার, কর্মচারীদের ২৭ লাখ চার হাজার, ভাতা ৫১ লাখ ৯৫ হাজার, রিপেয়ার, মেইনটেনেন্স ও রিহাবিলিটেশনে ১৫ লাখ, বিজ্ঞাপন, মিটিং ও অন্যান্য ২৬ লাখ ৮৮ হাজার টাকা।

ওয়ারেন্টি পিরিয়ড পরিচালনা খরচ বেড়েছে ৬৭ হাজার, বৈদেশিক প্রশিক্ষণ নয় লাখ ৯৪ হাজার, স্থানীয় প্রশিক্ষণ এক লাখ ৩৪ হাজার, ডিজাইন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ২৬ লাখ ৮৫ হাজার, ডকুমেন্টেশন (ডিজাইন, অপারেশন ইত্যাদি) ২৭ হাজার, যানবাহন ২৪ লাখ ৮২ হাজার, ভ্যাট ও ট্যাক্স নয় কোটি ৩১ লাখ ৬২ হাজার টাকা।

গ্যাস বুস্টার কম্প্রেসার ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি আট কোটি ১৭ লাখ ৬৮ হাজার, পরামর্শ সেবা তিন কোটি ৪৯ লাখ ৬২ হাজার, কাস্টমস ডিউটি ও ট্যাক্স ১২৮ কোটি ৮২ লাখ ৭৬ হাজার, বীমা প্রিমিয়াম ১৫১ কোটি ৩৯ লাখ ৯২ হাজার, অতিরিক্ত ভ্যাট ও ট্যাক্স ২৪ লাখ ৮৭ হাজার টাকা।

গ্যাস টারবাইন জেনারেটর ইউনিট স্থাপনে ৩৯ কোটি ৮৩ লাখ ১৯ হাজার, স্টিম টারবাইন জেনারেটর ইউনিট স্থাপনে ১৯ কোটি ৫১ লাখ ৩৭ হাজার, হিট রিকভারি স্টিম জেনারেটর সেট স্থাপনে ১০ কোটি ৩৭ লাখ ৪৯ হাজার, স্টেপ-আপ ইউনিট ট্রান্সফরমার ফর জিটি অ্যান্ড এসটি, সুইচগিয়ার ও অক্সিলারিতে ৩৯ কোটি ১৯ লাখ ২২ হাজার, ২৩০ কেভি সুইচ ইয়ার্ডসহ পাওয়ার ইভাকুয়েশন সুবিধা স্থাপনে এক কোটি তিন লাখ ৪১ হাজার, কন্ট্রোল ও ইন্সট্রুমেন্টেশনে ৪৭ কোটি ৯১ লাখ ৯৩ হাজার, আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ক্রয় ও স্থাপন (ওভারহেড ইলেকট্রিক ক্র্যান, জিটি, এসটি, সিডব্লিউপি হাউজ, মোবাইল ক্র্যান, পাঁচ টন ট্রাক, মেশিন শপ ইকুইপমেন্ট, ফায়ার ফাইটিং ইত্যাদি) এক কোটি ১৫ লাখ ২৬ হাজার, তরল জ্বালানি ক্রয় এবং তার পরিবহন ও সংরক্ষণে ১৪ কোটি ৬১ লাখ ৭৪ হাজার টাকা।

আরও যা বলছেন প্রধান প্রকৌশলী
প্রকল্পের ব্যয় বাড়ার বিষয়ে প্রধান প্রকৌশলী জ্যোতির্মায়া হালদার আরও বলেন, ‘আমরা যখন চুক্তি করেছি, তখন ডলারের দাম ছিল ৭৭ টাকা ৮০ পয়সা। আজ (বুধবার, ২৬ জুন) দেখলাম ডলারের দাম ৮৪ টাকা ৬২ পয়সা। দিন দিন বাড়ছে ডলারের দাম, কী করা যাবে?’

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে চীনা ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি হয় বলেও জানান তিনি। প্রকল্পের অগ্রগতি প্রায় ১২ থেকে ১৩ শতাংশ উল্লেখ করে প্রধান প্রকৌশলী বলেন, ‘এ বছরের এপ্রিলে ৪২৭ কোটি টাকা অ্যাডভান্স পেমেন্ট করেছি। চুক্তি অনুযায়ী ৫০ শতাংশ অ্যাডভান্স পেমেন্টের কথা বলা আছে।’

‘ফাইনাল ড্রাফটা তারা আগস্টেই দিয়েছিল। কিন্তু এটার ওপর তো আমাদের অর্থ, আইন, এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেটিং (মতামত) লাগছে, এতে প্রায় তিন মাস সময় গেছে’- যোগ করেন তিনি।

গত ২৮ মার্চ পরামর্শকদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে জানিয়ে জ্যোতির্মায়া বলেন, ‘নতুন যে পরামর্শক, তারা হলো পোল্যান্ডের। তারা পুরো প্রকল্পের পরামর্শক। তিন বছর প্রকল্পের কাজ হবে, এ সময় তারা সুপারভাইজ করবে, ড্রয়িং ডিজাইন করবে, অনুমোদন দেবে। এখানে বাংলাদেশের সাতজন এবং পোল্যান্ডের সাতজন, মোট ১৪ জন পরামর্শক রয়েছেন। দেশিদের খরচ অনেক কম। বিদেশি আর দেশি কি এক হয়?’

বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, খুলনার খালিশপুরের ভৈরব নদের তীরে প্রায় ৬২ একর জমিতে ১৯৫৪ সালে খুলনা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হয়। এ প্ল্যান্টে বর্তমানে ৬০ ও ১১০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট চালু আছে। কিন্তু এতে খুলনা অঞ্চলের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় না। বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের লক্ষ্য অর্জন এবং আঞ্চলিক চাহিদা মেটানোর জন্য নতুন করে ৩৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার।

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

জাতীয় এর সর্বশেষ খবর

জাতীয় - এর সব খবর