thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১,  ২৬ জমাদিউল আউয়াল 1446

শামীমের কাজের টেন্ডার হলেই টাকার ভাগ পেতেন সম্রাট

২০১৯ সেপ্টেম্বর ২২ ১৫:৩৩:৩৫
শামীমের কাজের টেন্ডার হলেই টাকার ভাগ পেতেন সম্রাট

দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: ‘টেন্ডার কিং’খ্যাত গণপূর্তের ঠিকাদার জি কে শামীম অবৈধ লেনদেন সংক্রান্ত হিসাব রেখেছেন তার অফিসিয়াল খাতায় (বিশেষ লেজারবুক)। কখন কাকে কত টাকা ঘুষ বা কমিশন দিয়েছেন- তা লিখে রেখেছেন এ খাতায়।

এতে নাম রয়েছে যুবলীগ, ছাত্রলীগ থেকে শুরু করে প্রভাবশালী অনেক রাজনৈতিক নেতার। যারা তার কাছ থেকে নিয়মিত মোটা অঙ্কের কমিশন নিতেন।

খাতায় লেখা আছে- মেগা প্রকল্পের বেশ কয়েকটি কাজ পেতে টেন্ডার মূল্যের ১ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ কমিশন হিসেবে যাদের ‘হার্ড ক্যাশ’ (নগদ) দেয়া হয়েছে, তাদের নামের তালিকা।

এছাড়া টেন্ডার হলেই জি কে শামীমের কাছ থেকে যুবলীগের কমিশন হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকার ভাগ পেতেন যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট।

গ্রেফতারের পর জি কে শামীমের অফিস কক্ষ থেকে উদ্ধারকৃত খাতাপত্র ও টেলিফোনের ভয়েস রেকর্ড থেকে কমিশনপ্রাপ্তদের নামের তালিকাসহ এসব তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

র‌্যাব বলছে, জি কে শামীমের সঙ্গে সমাজের প্রভাবশালী অনেকের হট কানেকশন ছিল। রাজনৈতিক পদ-পদবিধারী নেতা ছাড়াও ৫-৬ জন মন্ত্রীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল ওপেন সিক্রেট।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জনৈক জিয়া নামের এক ব্যক্তির নাম জানতে পারে। যাদের সঙ্গে জি কে শামীম মোটা অঙ্কের অবৈধ লেনদেন করতেন। আবার অনেকের সঙ্গে গোপনীয় কথাবার্তা তিনি নিজের মোবাইল ফোনে রেকর্ডও করে রাখেন।

তার ৩টি মোবাইল ফোনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। কাজ পেতে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের পাশাপাশি সচিব থেকে শুরু করে প্রকৌশলীদের কাউকেই প্রাপ্য কমিশন থেকে বঞ্চিত করতেন না তিনি।

প্রভাবশালীদের ফোন : র‌্যাব বলছে, বেশ কয়েকদিন আগ থেকেই জি কে শামীমের টেন্ডারবাজি ও অর্থপাচারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয় যায়। এসব তথ্য যাচাইয়ের পর শামীমকে গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

আটকে ফেলা হয় প্রভাবশালী এই ঠিকাদারকে র‌্যাবের জালে। শুক্রবার ভোরে র‌্যাবের একটি গোয়েন্দা টিম ছদ্মবেশে শামীমের বাড়িতে হাজির হয়। কিন্তু বাড়ির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। দরজা খুলতে বলায় ভেতর থেকে পরিচয় জানতে চাওয়া হয়।

এ সময় র‌্যাব কর্মকর্তারা কৌশলগত কারণে পরিচয় গোপন করে ভিন্ন পরিচয়ে দরজা খুলতে বলেন। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে র‌্যাব সদস্যরা ভেতরে ঢুকে পড়েন। প্রথমেই তার অস্ত্রধারী বডিগার্ডদের আটক করা হয়।

এরপর জি কে শামীমের কক্ষে ঢুকে পড়েন র‌্যাব সদস্যরা। নিজের অফিস কক্ষে হঠাৎ র‌্যাবের টিম দেখে হতভম্ব হন তিনি। বিচলিত হয়ে প্রভাবশালীদের ফোন করতে শুরু করেন।

জি কে শামীমের ফোনে বেশির ভাগ প্রভাবশালী সাড়া না দিলেও কেউ কেউ শামীমকে ছেড়ে দেয়ার জন্য র‌্যাব কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেন। কিন্তু উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশ থাকায় কোনো অনুরোধই কাজে আসেনি। সকাল ৯টার দিকে শামীমের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেন র‌্যাব সদস্যরা।

এরপর তার বাসায় তল্লাশি শুরু হয়। তার অফিস কক্ষসহ বাসার বিভিন্ন জায়গা থেকে বিপুল অঙ্কের নগদ টাকা, ৮টি ব্যাংকের চেকবই, ২শ’ কোটি টাকার এফডিআর, অস্ত্র, গুলি ও মদের বোতল উদ্ধার করা হয়।

১০ কোটি টাকার অফার : হাতে হ্যান্ডকাফ লাগানোর পর জি কে শামীম তদবিরের হাল ছেড়ে দেন। এবার তিনি অভিযানে উপস্থিত র‌্যাব কর্মকর্তাদের ম্যানেজের কৌশল নেন। একজন র‌্যাব কর্মকর্তাকে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ১০ কোটি টাকার অফার দেন।

জি কে শামীম বলেন, ‘আমাকে ছেড়ে দেন। এখনই ১০ কোটি টাকা দিচ্ছি। চাইলে আরও দেব। যেখানে যেভাবে বলবেন সেখানে টাকা পৌঁছে দেব। শুধু আমাকে এবারের মতো ছেড়ে দিন।’

কিন্তু মোটা অঙ্কের টাকার প্রলোভনেও কাজ হচ্ছে না দেখে জি কে শামীম অসুস্থতার ভান করেন। বুকে ব্যথা হচ্ছে বলে জানান তিনি। তখন তাকে অফিস কক্ষেরই একটি চেয়ারে বসার অনুমতি দেয়া হয়।

র‌্যাব সূত্র জানায়, গ্রেফতারের পর শামীমকে নিচে নামিয়ে আনা হলেও র‌্যাবের গাড়িতে উঠতে তিনি রাজি হচ্ছিলেন না। শামীম তার কোটি টাকা মূল্যের আলফার্ড গাড়িতে করে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

কিন্তু তার সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি। বাইরে দাঁড়ানো পিকআপে তুলে তাকে র‌্যাব কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

সূত্র জানায়, জি কে শামীম সব সময় বিশেষ নিরাপত্তা বহর নিয়ে চলাফেরা করতেন। তার গাড়িবহরে ১০-১২টি মোটরসাইকেল, দুটি মাইক্রোবাস, পুলিশের ব্যবহৃত ট্রাফিক সরঞ্জাম ও ওয়াকিটকি ব্যবহার করা হতো।

এছাড়া শামীমের বডিগার্ডদের গায়ে বিশেষ নিরাপত্তা ফোর্স কর্তৃক ব্যবহৃত জ্যাকেট সাদৃশ্য পোশাক দেখা যায়। যা রীতিমতো বেআইনি।

কেউ এই জিয়া : জি কে শামীম প্রভাবশালী অনেকের সঙ্গেই অবৈধ কমিশন ও ঘুষ লেনদেনের আলাপ করেন নিজের মোবাইল ফোনে। তবে প্রমাণ রাখতে অনেকের সঙ্গেই কথাবার্তা বলার পর ফোনে তা রেকর্ড করে রাখতেন।

আবার অনেকের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, মেসেঞ্জার ও ইমো ব্যবহার করে কথাবার্তা বললেও অন্য আরেকটি ফোনে তা রেকর্ড করে রাখেন। এ কারণে শামীমের মোবাইল ফোনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলামত হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে অবৈধ লেনদেনের সঙ্গে জড়িতদের ভয়েস চিহ্নিত করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

সূত্র জানায়, জিয়া নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে কথোপকথনের একাধিক ভয়েস রেকর্ড রয়েছে তার মোবাইল ফোনে। এসব কথোপকথনের বেশির ভাগই চিত্রজগতের নায়িকা, মডেল ও শোবিজ জগতের তারকাদের ঘিরে।

টেন্ডার সংক্রান্ত কাজে তিনি অনেক সময় প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করতে এসব মডেল ও উঠতি নায়িকাদের ব্যবহার করতেন।

সূত্র বলছে, জি কে শামীমের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এক ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরেই পূর্ত মন্ত্রণালয়ে দাপটের সঙ্গে ঘোরাফেরা করেন। তার নাম জিয়া। অথচ তিনি পূর্ত মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী নন। আবার তিনি কোনো রাজনৈতিক নেতাও নন।

তবে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের সর্বস্তরে তার প্রভাব চোখে পড়ার মতো। সবাই তাকে দেখলে সালাম দেয়, সমীহ করে। লিফটম্যানরা তটস্থ হয়ে পড়ে। মন্ত্রীর কক্ষে ঢোকার আগেই দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকেন কর্মচারীরা।

জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে যে কয়জন সিঙ্গাপুরে মেরিনা বে ক্যাসিনোতে নিয়মিত জুয়া খেলতে যান জিয়া তাদের অন্যতম। সিঙ্গাপুরের ক্যাসিনোতে জিয়া হাজার হাজার ডলার উড়িয়ে দেন অবলীলায়। দেশের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় চলাফেরা করেন হেলিকপ্টারে। জিয়ার বাড়ি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি।

রাজধানীর গুলশান-১ এ তিনি থাকেন। গুলশানের হোটেল ওয়েস্টিনে তাকে নিয়মিত দেখা যায়। এই জিয়ার রাজনৈতিক ‘হট কানেকশন’ সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায়। বিএনপি আমলে তিনি বিএনপির লোক। আওয়ামী লীগ আমলে আওয়ামী লীগ।

একজন র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, জি কে শামীমের সঙ্গে এই জিয়ার মতো আরও অনেক প্রভাবশালীর ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। যাদের কাছে টাকা-পয়সা অনেকটা গাছের পাতার মতোই মূল্যহীন বস্তু।

গ্রেফতার করে গাড়িতে তোলার সময় জি কে শামীম তার কর্মচারীদের বলেন, ‘এই কয়টা টাকা দাও তো। সঙ্গে নিয়ে যাই।’ এ কথা বলে তিনি ১ হাজার টাকার নোটের কয়েকটা বান্ডিল হেলাফেলায় তুলে পকেটে ভরার চেষ্টা করেন।

কিন্তু র‌্যাব জানিয়ে দেয়, গ্রেফতার হওয়ার পর সঙ্গে নগদ একটি টাকাও নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। অগত্যা টাকাগুলো আবার যথাস্থানে রেখে দিতে বাধ্য হন তিনি।

র‌্যাব জানায়, জি কে শামীম অভিনব উপায়ে টেন্ডারবাজি করতেন। সম্প্রতি ই-টেন্ডার পদ্ধতি চালু হওয়ায় মূলত জি কে শামীমের মতো ঠিকাদারদের আরও সুবিধা হয়েছে।

কারণ আগে থেকেই দরপত্রে এমন শর্ত যোগ করা হয় যাতে পূর্বনির্ধারিত ঠিকাদার হিসেবে জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠানই কাজ পায়। এজন্য সংশ্লিষ্ট দফতর ও অধিদফতরের উচ্চপর্যায়ে নীতিনির্ধারকরা নির্ধারিত রেটে কমিশন নিতেন।

দীর্ঘদিন ধরে এমন কমিশন লেনদেনের ফলে জি কে শামীম অনেক কর্মকর্তারই আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। ফলে পূর্ত সংক্রান্ত মেগা প্রকল্পের ৮০ শতাংশ কাজের সঙ্গেই কোনো না কোনোভাবে জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠান জিকেবিপিএল যুক্ত থাকে।

কোনোটি তিনি নিজেই করেন। আবার কোনো কোনো কাজ জেভি’র (যৌথ উদ্যোগ) মাধ্যমে করেন। আবার বেশ কিছু কাজ তিনি অন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ৫ থেকে ৭ পার্সেন্ট কমিশনে বিক্রি করে দেন।

রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের বেশ কয়েকটি কাজ নিতে জি কের প্রতিষ্ঠানকে রীতিমতো মোটা অঙ্কের কমিশন দিতে হয়। এভাবে রূপপুরে কাজ পায় সাজিন ট্রেডার্স, এনডিই, পায়েল, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স, জামাল অ্যান্ড সন্স ও হাসান অ্যান্ড ব্রাদার্স।

র‌্যাব জানায়, জি কে শামীমের বিরুদ্ধে মাদক, অস্ত্র, মানি লন্ডারিংয়ের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে একাধিক মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে মাদক বা অস্ত্রের যে কোনো একটি মামলা তদন্ত করবে র‌্যাব। যাতে করে আইনের ফাঁক গলে তার মুক্তি পাওয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে আসে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক সারোয়ার বিন কাশেম শনিবার বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে জি কে শামীমকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।

বিভিন্ন মহলে তার হট কানেকশনের কথা শুনেছি। তবে আইনের চেয়ে কারও হাত লম্বা নয়। সে যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, অপরাধ করলে তাকে শাস্তি পেতেই হবে।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/সেপ্টেম্বর ২২,২০১৯)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

অপরাধ ও আইন এর সর্বশেষ খবর

অপরাধ ও আইন - এর সব খবর