thereport24.com
ঢাকা, সোমবার, ২৯ এপ্রিল 24, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১,  ২০ শাওয়াল 1445

এক কিশোরের সাক্ষ্যে মৃত্যুদণ্ড ৭ জঙ্গির

২০১৯ নভেম্বর ২৮ ১০:৩১:০৪
এক কিশোরের সাক্ষ্যে মৃত্যুদণ্ড ৭ জঙ্গির

দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: আলোচিত হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা মামলার রায়ে ৭ জঙ্গিকে ফাঁসির দণ্ড দিয়েছেন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। এই মামলার বিচার চলার সময় মোট ১১৩ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। কিন্তু এরমধ্যে কিশোর এক সাক্ষীর সাক্ষ্যকে গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করেছেন আদালত।

রায় ঘোষণার সময় আদালত তাহরিম কাদেরী নামে ওই কিশোরের নামও উল্লেখ করেন। আদালত বলেন, ‘এই মামলায় তাহরীম কাদেরীর সাক্ষ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার সঙ্গে অভিযুক্তদের সম্পৃক্ত থাকার বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে। এছাড়া সে দুজন অভিযুক্তকে শনাক্ত করেছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণে তাহরীমের সাক্ষ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।’

গত ১৬ জুলাই এই আদালতেই সাক্ষ্য দিয়েছিল তাহরীম কাদেরী।

বর্তমানে ১৭ বছরের তাহরীম গুলশান হামলার ঘটনার পরপরই ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরে এক অভিযানে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের হাতে গ্রেফতার হয়। ওই অভিযানের সময় তাহরীমের বাবা তানভীর কাদেরী গলায় ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন। অপর দুই নারীর সঙ্গে তাহরীমের মা আবেদাতুল ফাতেম ওরফে খাদিজাকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর তাহরীম গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয়। এ কারণে তাকে আলোচিত এই মামলার সাক্ষী করা হয়। ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে সে ছিল ৩৯ নম্বরে। আজিমপুরের ওই ঘটনায় গ্রেফতারের পর আট মাস কিশোর সংশোধনাগারে থাকার পর ২০১৭ সালের জুনে জামিনে মুক্তি পায় তাহরীম।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ূন কবীর বলেছেন, ‘হলি আর্টিজান হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া ৫ জঙ্গি ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। তদন্তে অনেক তথ্য পেলেও নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছিল তাহরীম। এজন্য তাকে গুলশান মামলায় সাক্ষী হিসেবে যুক্ত করা হয়েছিল।’

আদালত, পুলিশ ও আইনজীবী সূত্রে জানা গেছে, এ মামলার শুনানিতে যারা সাক্ষ্য দিয়েছেন তাদের বেশিরভাগই ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষ ও পুলিশ সদস্য। তারা সবাই সবিস্তারে হামলার কথা বলেছেন। কিন্তু মামলার অভিযোগপত্রে নেপথ্যে থাকা ৮ আসামির বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে পারেননি বেশিরভাগ সাক্ষী। একমাত্র তাহরীম হামলার পরিকল্পনা ও নেপথ্য ব্যক্তিদের সম্পর্কে কথা বলেছে। আদালতে দুই আসামিকে শনাক্তও করে সে।

তদন্তে উঠে এসেছে, এই হামলার আগে জঙ্গিরা ঘুরেফিরে রাজধানীর ৮টি বাসায় অবস্থান করে। সর্বশেষ অবস্থান করে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ই-ব্লকের ৬ নম্বর সড়কের টেনামেন্ট-৩-এর ৩০১-এ প্লটের ৬-এ নম্বর ফ্ল্যাটে। হামলার আগমুহূর্ত পর্যন্ত ওই বাসায় পরিবারের সঙ্গে ছিল সে সময়ের ১৪ বছর বয়সী তাহরীম। মা-বাবার মাধ্যমে সেও তখন জঙ্গিবাদে যুক্ত ছিল। কিশোর সংশোধনাগার থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর তাকে কাউন্সেলিং করিয়ে জঙ্গিবাদের ভ্রান্তপথ থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

২০১৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আহসান হাবীবের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় তাহরীম। সে বলে, ‘একদিন র‌্যাশ (ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসলামুল ইসলাম) আর চকোলেট (বাশারুজ্জামান ওরফে চকোলেট) আঙ্কেল এসে পল্লবীর বাসার পাশাপাশি অন্য এক জায়গায় বাসা নিতে বলে। তখন রমজান মাস ছিল। আব্বু (তানভীর কাদেরী, গুলশান হামলার অর্থদাতা) তাদের কথামতো বসুন্ধরায় বাসা নেয়। আমরা রোজার প্রথম দিকে বসুন্ধরার বাসায় উঠি। ...আমরা বসুন্ধরা বাসায় ওঠার ৮-১০ দিন পর চকোলেট আঙ্কেল প্রথমে ২ জন, এরপর ৩ জনকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসে। এই ৫ জনের সাংগঠনিক নাম ছিল সাদ, মামুন, উমর, আলিফ ও শুভ। এর কয়েকদিন পর তামিম (গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম আহমেদ চৌধুরী) আঙ্কেল ও মারজান (গুলশান হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী) আঙ্কেল আমাদের বাসায় আসে। একই দিনে জাহাঙ্গীর (গুলশান হামলা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত) আঙ্কেল, তার স্ত্রী, ছেলে শুভ এবং হৃদয় আঙ্কেল চকোলেট আঙ্কেলের সঙ্গে আমাদের বাসায় আসে।’

তাহরীম তার জবানবন্দিতে বলে, ‘তামিম, চকোলেট, মারজানরা আমাদের বাসায় ব্যাগ নিয়ে আসে। ব্যাগে অস্ত্র ছিল। তামিম, সাদ, মামুন, ওমর, আলিফ, শুভ আমাদের বসুন্ধরার বাসাতেই থাকতো। তারা বাইরে কম বের হতো। তারা দরজা লাগিয়ে কথাবার্তা বলতো। আমাদের বাসার ৪টি বেডরুমসহ ৭টি রুম ছিল। তামিমসহ ৫ জন এক রুমে থাকতো। আমি, আমার ভাই ও আব্বু ড্রইংরুমে থাকতাম। আম্মু ও শুভর আম্মু এক রুমে থাকতো। ৫ জনের মধ্যে আলিফ ও ওমর অনেক অপারেশন করেছে বলে গল্প করতো। কুষ্টিয়ার একজন খ্রিস্টান বা হিন্দুকে মেরে রক্তমাখা প্যান্ট খুলে পালিয়ে আসে বলে গল্প করে। তারা আমাদের জিহাদের কথা বলতো। ট্রেনিং নিয়েছে বলেও জানায়।’

তাহরীম আরও বলে, “আঙ্কেলরা বলতো তারা একটি বড় অপারেশন করবে। তবে কী ঘটনা ঘটাবে তা গুলশান হলি আর্টিজানে হামলার আগে জানতাম না। হলি আর্টিজানে যেদিন অপারেশন হয়, সেদিন বিকাল ৫টা থেকে সাড়ে ৫টার দিকে সাদ, মামুন, উমর, আলিফ ও শুভ কাঁধে একটি করে ব্যাগ নিয়ে বের হয়। তারা ৫ জন ব্যাগ নিয়ে বের হওয়ার সময় আমাদের সঙ্গে কোলাকুলি করে বলে, ‘জান্নাতে গিয়ে দেখা হবে ইনশাল্লাহ।’ তার দুয়েকদিন আগে জাহাঙ্গীর আঙ্কেল, তার পরিবার ও হৃদয় আঙ্কেল বের হয়ে যান। ৫ জন চলে যাওয়ার পর তামিম আর চকোলেট আঙ্কেল বের হন। তামিম আর চকোলেট আঙ্কেল আমার আব্বুকে বলে যে, ‘তোমরা যত তাড়াতাড়ি পারো বাসা ছেড়ে চলে যাও’। সন্ধ্যার আগে পারলে ভালো হয়। আমরা ইফতার করে ব্যাগ-কাপড় নিয়ে ট্যাক্সিক্যাবে করে পল্লবীর বাসায় চলে আসি। পল্লবীর বাসায় গিয়ে আব্বু খুব টেনশন করছিল। বলে, এতক্ষণ হয়ে গেলো অথচ কোনও নিউজ পাচ্ছি না।”

তাহরীম আরও বলে, “আব্বু আমাদের বললো, দোয়া করো যেন ওরা ধরা না পড়ে এবং ভালো একটা অপারেশন করতে পারে। আমাদের বেশি বেশি ইসতেগফার করতে বলে। কিছুক্ষণ পর আমি খবরে দেখলাম গুলশান হলি আর্টিজানে গোলাগুলি হচ্ছে। তখন আমরা বুঝলাম হলি আর্টিজানে অপারেশন হচ্ছে। সকাল পর্যন্ত নিউজ দেখলাম। সকালে অপারেশনে অংশগ্রহণকারীদের ছবি প্রকাশ হলো। আব্বু আমাকে বললো, ‘অনেক ভালো একটা অপারেশন হয়েছে এবং তোমার ভাইয়েরা শহীদ হয়েছে।’ তখন আমরা সবাই বলি, ‘আলহামদুলিল্লাহ’। হলি আর্টিজানের ঘটনার পর নিহতদের ছবি বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশ পেলে বসুন্ধরায় আমাদের বাসায় অবস্থানকারীদের নাম জানতে পারি। সাদের প্রকৃত নাম নিবরাস ইসলাম, মামুনের নাম রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, উমরের প্রকৃত নাম খায়রুল ইসলাম পায়েল ওরফে বাঁধন, আলিফের নাম শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল এবং শুভর নাম মীর সামিহ মোবাশ্বের বলে জানতে পারি।”

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/নভেম্বর ২৮,২০১৯)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

জাতীয় এর সর্বশেষ খবর

জাতীয় - এর সব খবর