thereport24.com
ঢাকা, মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারি 25, ২৪ পৌষ ১৪৩১,  ৭ রজব 1446

‘বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কাজ করেছি’

২০১৪ মার্চ ২৬ ১৫:৩৪:৩৩
‘বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কাজ করেছি’

শতবর্ষী সিদ্দিক ড্রাইভারের কাগুজে নাম মোহাম্মদ তমিজ উদ্দিন। সবার কাছে সিদ্দিক ড্রাইভার নামেই পরিচিত। দ্রুত গতি ছাড়া গাড়ি চালাতে পারেন না তিনি। তার ভাষায় ‘স্লো গাড়ি চালাইলে আমার ঘুম আহে।’ ছয় নম্বর রোডে (কমলাপুর-গুলশান) এখনও প্রতিদিন একটিপ গাড়ি চালান তিনি।

‘শতবর্ষী সিদ্দিক ড্রাইভার এখনও ঝড় তোলেন’ শিরোনামে প্রথম পর্বের সাক্ষাৎকার ছাপা হয় দ্য রিপোর্টে। এবার থাকছে তার মুক্তিযুদ্ধ পর্ব...

১৪ বছরের সিদ্দিক বাংলাদেশে এসে দুই দিন থেকে জার্মানিতে ফেরার কথা বলাই দিব্যি দেন মা- ‘তুই যদি যাস তাইলে আমার বুকের দুধের দাবি ছাড়ুম না। আল্লাহও তোরে মাফ করব না।’ মায়ের কথা ফেললেন না সিদ্দিক। সেই থেকে আজ পর্যন্ত দেশেই গাড়ি চালাচ্ছেন দ্রুতগতির ড্রাইভার সিদ্দিক।

জার্মান থেকে দেশে আসলেন ১৯৬৮ সালে। তখন তো তুমুল আন্দোলন চলছিল... সিদ্দিকের স্মৃতিতে ভাসে সেই দিনগুলো। সরাসরি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অনেক হরতাল সফল করতে কাজ করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর সরাসরি নির্দেশ কীভাবে পেয়েছেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন ‘আমি কোনো দল-টল করতাম না। খুব সাহসী আছিলাম। মারপিট-ভাঙচুরের দরকার হইলে বন্ধুরা লইয়া যাইত। আমার খুব কাছের ছিল শফিক নামের একজন। শফিক আওয়ামী লীগ করত। বঙ্গবন্ধু ওরে খুব ভালোবাসতেন। হরতাল ঘোষণা হইলে আমগর এলাকার দায়িত্বে কারে দেওয়া যায় জিগাইতো (বঙ্গবন্ধু)। শফিক আমার নাম কইতো। তখন পল্টনের পার্টি অফিসে গেলে বঙ্গবন্ধুর লগে দেখা হইতো। উনি কইতেন ওইদিন কাম আছে। গাড়িতে যাওয়া যাইব না। গাড়িতে যাইতাম না। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে হরতাল সফল করতাম। ভাঙচুর কইরা কয়েকটা গাড়ি আটকাইয়া দিলেই পুরা এলাকায় গাড়ি বন্ধ।’

১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরুর পর কি করলেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘৩০ মার্চ ঢাকা থাইকা কলকাতার উদ্দেশে রওনা দেই। চার মাসে হাঁইটা কলকাতা, সেইখান থাইকা ট্রেইনে আগরতলা যাই।’ দীর্ঘ হাঁটার রাস্তায় পড়ে থাকা স্মৃতি হাতড়ালেন সিদ্দিক।

কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন, ‘কুমিল্লায় এক বাড়িতে ভাত চাইলাম। দূর দূর কইরা যাইতে কইল। আমি সরলাম না। ভাতের পাতিলটা আমার সামনে রাইখা পেছনের রুমে গেল মহিলা। গায়ের জামা খুইলা পুরা পাতিলের ভাত জামায় ঢাইলা দৌড়। চারদিন খালি ভাত খাইলাম। রাস্তায় এক হিন্দু ভদ্রলোক জিগায় খালি ভাত কেন খাই। একটু লবণ দিল, আরেক বাড়িতে পাইলাম একটু ডাইল। নিমু কেমনে। ভাতের লগে মাখাইয়া লইলাম। শেষ দিন ভাতে দুর্গন্ধ, তারপরও খাইলাম, ক্ষিধার জ্বালায়।’সিদ্দিক বলেন, ‘কলকাতায় পৌছাইয়া পাইলাম এলাকার (ঢাকা) এক ড্রিংকিং পার্টনাররে। পরিচিত মানুষ দেইখা খুব ভাল লাগল। কী করমু ওই বুদ্ধি দিল আগরতলা যাইয়া মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে। অন্তত খাওন তো পাওয়া যাইব। সঙ্গে দিল বিশটা টেকা। গিয়াই পাইলাম এম এ জি ওসমানীকে। আমার ভাগ্যই ভালো। যেই খানেই যাই বড় বড় মানুষের লগেই দেখা ওয়’ পরিচয় হওয়ার পর ওসমানী সাহেবের নির্দেশে ট্রেনিংয়ে যোগ দিলেন।’

তিনি জানান, ট্রেনিং শেষে ২৭ জনের ফুল প্লাটুনসহ কুমিল্লা দিয়ে ঢুকলেন বাংলাদেশে। কমান্ডার তৈয়ব আলী। সহকারী কমান্ডার আলাউদ্দিন। কমান্ডারের পড়াশোনা তেমন ছিল না, সামন্য পারতেন সহকারী কমান্ডার। দলের চিঠি-পত্র বা লেখালেখির দায়িত্ব পড়তো সিদ্দিকের ওপরেই। কুমিল্লার মিয়াবাজারের কাছাকাছি একটি গ্রামে প্রথম রাত যাপন করেন। ওই গ্রামের মানুষের যত্ন আত্মি পান পর্যাপ্ত। থাকলেন ‘গোয়াইল’ ঘরের ‘খেড়ের’ উপর। এখানে অবস্থান করেই অনেক সফল অপারেশন করল তাদের দল।

স্মরণীয় কোনো অপারেশনের কথা বলবেন? উত্তরে জানালেন, কুমিল্লা থাকাকালে বাড়িতে বেড়াতে আসলেন। ছোট ব্যাগে চালের মধ্যে নিলেন তিনটি গ্রেনেড। গুলিস্তানের (বর্তমান সার্জেন্ট আহাদ) পুলিশ বক্সের বিপরীতে তখন মিরপুরের গাড়িগুলো থাকতো। বাড়ির সবার সঙ্গে দেখা করে সেখানে গিয়ে দেখেন একটা গাড়িতে ২০-২৫ জন পাক আর্মি বসে আছে। পাশে ছিল দেয়াল ঘেরা সুইপার কলোনি। দেয়ালের ওপাশ থেকে ঠিকমতো গাড়ি দেখা যায় না। কোনো মতে ছাদটা দেখা যায়। আন্দাজ করে মারলেন তিনটি গ্রেনেড। দুইটি পড়ল গাড়িতে। তিন পাক আমি মরল। আহত প্রায় সবাই।

আরেকটি অপারেশনের কথা বলতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন সিদ্দিক ড্রাইভার। ২৭ জনের দলে থাকা তার প্রিয় মানুষটি শহীদ হলেন, নাম শুক্কুর। অপারেশনটি ছিল গোড়ানে। শুক্কুরের মাকে খবর দিতে গিয়ে কেদেঁ দিলেন সিদ্দিক। কাঁদলেন না শুক্কুরের মা। দেশের জন্য জীবন দেওয়ায় সেই মা গর্ব করে দোয়া করেছিলেন আল্লাহর কাছে।

শেষ অপারেশন করেছেন ১১ ডিসেম্বর। পাক আর্মিরা মগবাজারের পাশেই কয়েকজন নারীকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করছিল। অভিযান চালিয়ে ৬ পাক হানাদারকে নিষ্ঠুরতম নির্যাতনের পর গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন তারা।

বিজয়ের দিনে অনুভূতি কেমন ছিল? জবাবে তিনি বলেন, ‘বইলা বুঝান যাইব না। অনেক খুশি। সবাই কয় ওই সিদ্দিক যুদ্ধ কইরা আইছে। কি যে ভাল লাগছে।’

মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এখন তো অনেক সম্মান পান, তাই না? ‘না রে বাবা। এইসব সম্মানের ধার ধারি না আমি। এমনও লোক দেখি মুক্তিযুদ্ধার বেইজ পইড়া ঘোরে। কই যুদ্ধ করছে জিগাইলে আবল-তাবল কয়।’

যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নেননি সিদ্দিক। যখন সবাইকে সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছিল তখন সিদ্দিকের মা তাকে বলেছিলেন, ‘হুনবার পাইছি মুক্তিযোদ্ধাগোর তালিকা কইরা মাইরা ফালাইব। তুই সার্টিফিকেট আনতে যাইবি না।’ সিদ্দিক যাননি স্বীকৃতি নিতে।

বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে যা হয় তাতে হতাশ সিদ্দিক জানান, রাজনীতিতে খারাপ-ভালো মানুষ আগেও ছিল। কিন্তু এখন যে অবস্থা তাতে খুব খারাপ লাগে। দলের বাইরে মানুষের কোনো পরিচয় নাই। এইটা কোনো কথা হইলো? এক দলের মানুষ আরেক দলেরে দেখতে পারে না। আগেও ভিন্ন দল ছিল, মানুষ এই রকম ছিল না।

(দ্য রিপোর্ট/বিকে/এনডিএস/মার্চ ২৬, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর