thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ১ জুন ২০২৪, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১,  ২৪ জিলকদ  ১৪৪৫

জলবায়ু পরিবর্তনে তলিয়ে যাচ্ছে উপকূল, বাড়ছে দারিদ্রতা

২০২৩ সেপ্টেম্বর ০১ ১৮:১৪:০৪
জলবায়ু পরিবর্তনে তলিয়ে যাচ্ছে উপকূল, বাড়ছে দারিদ্রতা

আবদুল্লাহ নয়ন, দ্য রিপোর্ট:জলবায়ূ পরিবর্তনের ফলে হুমকির মুখে পড়েছে কক্সবাজার। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চল। এবারের ভয়াবহ বন্যায় মারা গেছে ২০ জন। পানির নীচে তলিয়ে গেছে কয়েক হাজার বসতঘর, ফসলি জমি এবং চিংড়ি ঘের। প্রধান সড়ক, গ্রামীণ জনপদ, গবাধি পশু ও কালর্ভাটসহ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল এক জেলা থেকে অন্যজেলার যোগাযোগ।

উপকুলীয় বাসিন্দা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের এ ধারা অব্যাহত থাকলে জেলার দীপাঞ্চল এবং নিম্নাঞ্চলীয় বহু মানুষ বাস্তহারা হবে। নেমে আসতে পারে চরম দারিদ্রতা। প্রশাসনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এবারের বন্যায় ৯ উপজেলার ৬০ ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। টানা ৬ দিন (৮ আগস্ট থেকে ১৩ আগস্ট) পানিবন্দি ছিল ৫ লাখের বেশি মানুষ। পানির ঢল আর পাহাড় ধসে মৃত্যু হয়েছে ২০ জন। চকরিয়ায় ১১ জন, পেকুয়ায় ৬ জন, উখিয়ায় ২ জন এবং রামুতে ১ জনের মৃত্যু হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে চকরিয়া-পেকুয়া উপজেলা।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ জানান, এবারের বন্যায় কেবল উপকুলীয় এলাকা নয়; ডুবেছে নতুন কিছু উঁচু স্থানও। যার একমাত্র কারণ জলবায়ু পরিবর্তন।
তিনি জানান, বন্যায় সড়ক বিভাগের ৫৯ কিলোমিটার সড়ক এবং এলজিইডির ৮০ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার গ্রামীণ রাস্তা ও ৪৭ ব্রিজ-কালভার্ট বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এছাড়া জেলায় ১৫ হাজার ৬৩৮ হেক্টও ফসলি জমি, ১ হাজার ৭৫২ টি পুকুর-দীঘি-খামার, ১ হাজার ৮৩২ টি মৎস্য ঘের, ২৬২ মেট্রিক টন ফিন ফিশ, ৭০০ মেট্রিক টন চিংড়ি, ৯.৯৫ মেট্রিক টন পোনা ও ১৭৯ টি জাল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। উপকুলীয় অঞ্চলে যেসব মানুষ কৃষি ও মৎস্য চাষ নির্ভর। এবারের তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এতে করে ফসল ও মৎস্য উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে।

পেকুয়া উপজেলার মগনামা ইউনিয়নের চাষী আবদুল মজিদ (৪৩) বলছেন, স্মরণকালের এই ভয়াবহ বন্যায় যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠা অসম্ভব। আগে কখনো বন্যায় এত পানি হয়নি। ঋতু পরিবর্তনের কারণে এমনটা হচ্ছে বলে মনে করছেন এই কৃষক। চকরিয়ার লক্ষ্যারচরের বাসিন্দা মোবারক আলী জানান, বন্যার পানিতে সব শেষ হয়ে গেছে। এখনকি ঘর মেরামত করব নাকি চাষের জমি ঠিক করব বুঝতে পারছিনা। এছাড়া পকেটেও টাকা নাই। জীবনটাই অনিশ্চিয়তার মধ্যে পড়ে গেছে। পরিবারের ভরণ-পোষণ নিয়েও চিন্তিত।



জলবায়ু পরিবর্তনে হুমকির মুখে পড়েছে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণীয় কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কও। সম্প্রতি সাগরে সৃষ্ট লঘুচাপ ও পূর্ণিমার জোয়ারের প্রভাবে তীব্র ঢেউয়ের আঘাতে সড়কটির অন্তত ১০ থেকে ১৫ টি স্থানে ভাঙ্গন দেখা দেয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বালিভর্তি জিওব্যাগ দিয়ে ভাঙ্গন প্রতিরোধের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। পানির উচ্চতা না কমা পর্যন্ত পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের বাহারছড়া ঘাট থেকে হাদুরছড়া বিজিবি ক্যাম্প শ্মশান পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সড়কটিতে এসব ভাঙ্গন অব্যাহত। এতে মেরিন ড্রাইভের চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য্য বিনষ্ট হওয়ার পাশাপাশি লোকালয়ে পানি প্রবেশের হুমকির মধ্যে রয়েছে দুই সহস্ত্রাধিক পরিবার। স্থানীয়দের মধ্যে সাইফুল ইসালাম নামে এক ব্যক্তি জানান, অন্য বছরের চেয়ে এ বছরের ভাঙ্গন তীব্র ও আগ্রাসী। জোয়ারের পানি ঢুকে উপকুলীয় এলাকা ডুবে যাচ্ছে। আগে কখনো এরকম হতে দেখিনি।

এ ব্যাপারে কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি আ.ন.ম হেলাল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে বৈরী আবহাওয়ার কারণে মেরিন ড্রাইভ ভাঙ্গনের কবলে পড়ে। প্রতিবারই সংশ্লিষ্টরা বালিভর্তি জিওব্যাগ দিয়ে ভাঙ্গন প্রতিরোধে চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু তাতে স্থায়ী সমাধান আসে না। তাই সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে মেরিন ড্রাইভটি রক্ষায় টেকসই উদ্যোগ নেওয়া জরুরী।

সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে সৌন্দর্য বর্ধনকারী সবুজ বেষ্টনী ঝাউবাগান হুমকির মুখে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুমে সাগরের ঢেউয়ের ধাক্কায় ভাঙছে বালিয়াড়ি ও সড়ক। সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে সৈকতের ঝাউবাগান। গত ১০ বছরে বিলীন হয়েছে লক্ষাধিক ঝাউগাছ।
দ্রুত সময়ের মধ্যে শহররক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও সৈকতের বালিয়াড়িতে শেকড়যুক্ত গাছ রোপণের দাবি পরিবেশবাদীদের। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ১৯৭২-৭৩ সালে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বালিয়াড়িতে ঝাউবাগান গড়ে তোলা হয়। এ সময় বালিয়াড়ির প্রায় ৫শ’ হেক্টর জায়গায় লাগানো হয় সাড়ে ১২ লাখেরও বেশি ঝাউগাছ। পরে বাগানের আয়তন আরো বাড়ে। এই সবুজ বেষ্টনী, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য বাড়ানোর পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে কক্সবাজার শহর রক্ষা করে।

তবে, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় এবং ঢেউয়ের ধাক্কায় গত কয়েক বছর ধরে বর্ষা মৌসুমে সৈকতের বালিয়াড়িতে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করছে। ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে ঝাউ বাগানের। গত ১০ বছরে ঝাউ বাগানের এক লাখেরও বেশি গাছ সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগেও ঝাউ বাগানের ক্ষতি হয়েছে। কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা দিপু জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কক্সবাজারে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকতের পাড় ঘেঁষে যে ঝাউবাগান রয়েছে, ইতিমধ্যে সেটির এক লাখের বেশি ঝাউ গাছ বিলীন হয়েছে।

তবে জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান জানান, সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে ভাঙন দেখা দিয়েছে। তাই সৈকতের কলাতলী থেকে নাজিরারটেক পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার এলাকা ভাঙনরোধে সুনির্দিষ্ট প্রকল্পের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পর্যটন করপোরেশনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া, চকরিয়া, রামু, খুরুশকুল, টেকনাফের বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। চলতি মৌসুমে বীজ বপন, শীতকালীন সবজি চাষেও ব্যাঘাত ঘটতে পারে বলে আশংকা করছেন নিম্নাঞ্চলের বাসিন্দারা।

(দ্য রিপোর্ট/ টিআইএম/১ সেপ্টেবর,২০২৩)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর

জেলার খবর - এর সব খবর