thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১,  ২১ জমাদিউল আউয়াল 1446

‘ভয়ের’ মোহাম্মদপুরে ‘অভয়’ দিয়ে মাঠে নিরাপত্তা বাহিনী

২০২৪ অক্টোবর ২৮ ০৮:৪২:৫৪
‘ভয়ের’ মোহাম্মদপুরে ‘অভয়’ দিয়ে মাঠে নিরাপত্তা বাহিনী

দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক:শনিবার সন্ধ্যা, ঢাকার মোহাম্মদপুরে হঠাৎ শুরু হয় গোলাগুলি। গুলির শব্দে তাজমহল রোড, বাবর রোড ও হুমায়ুন রোডের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে; নিরাপদ গন্তব্যের খোঁজে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি শুরু করেন।

গুলির শব্দে সন্ধ্যার পর থেকে পুরো এলাকার দোকানপাট বন্ধ ও যান চলাচল থমকে যায়। সন্ধ্যা থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষ থেমে থেমে চলে কয়েক ঘণ্টা। গুলিবিদ্ধ হন তিনজন; আহত হন আরও দুজন।

স্থানীয়রা বলছেন, ঢাকার পুরনো আবাসিক এলাকা মোহাম্মদপুরে এমন পরিস্থিতি ফিরে ফিরে আসে। রাজনীতির পট পরিবর্তনের পর হঠাৎ যেন অপরাধীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে এই এলাকায়। বেড়েছে খুনখারাবি, ছিনতাই ও ডাকাতি।

মোহাম্মদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আলী ইফতেখার বলেন, ‘এ ঘটনায় আমরা আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছি। তবে থানায় লোকবল কম থাকায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কিছুটা হিমশিম খেতে হচ্ছে। তারপরও চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

উদ্ভূত আতঙ্কের পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে মোহাম্মদপুরবাসীকে ‘অভয়’ দিয়ে নিরাপত্তার বার্তা নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে সেনাবাহিনী, যাদের নেতৃত্ব যৌথ অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছে অর্ধশতাধিক সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও ছিনতাইকারী।

রোববার (২৭ অক্টোবর) মোহাম্মদপুর ঘুরে কথা হয় বাসিন্দাদের সঙ্গে। তারা বলেছেন, মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পকেন্দ্রিক একটি গ্রুপ নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে সব সময় মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিছু এলাকায় গড়ে উঠেছে নতুন সন্ত্রাসী গ্রুপ। মোহাম্মদপুরের প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ। সব ঘটনা গণমাধ্যমে আসে না। আবার অনেকে আইনি ঝামেলা এড়াতে থানায় অভিযোগ করার সাহস পান না।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর ২৩ ইস্ট বেঙ্গলের উপ-অধিনায়ক মেজর নাজিম আহমেদ শনিবার রাতে মোহাম্মদপুরবাসীর উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা আতঙ্কিত না হয়ে আমাদের তথ্য দিন। তথ্য দিলে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছাবে। অপরাধ করে কেউ পার পাবে না।’

ঢাকা উদ্যান, চাঁদ উদ্যান ও বিভিন্ন হাউজিং সোসাইটিতে অভিযান চালিয়ে ৪৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের মধ্য প্রায় ১৫ থেকে ১৬ জন কিশোর গ্যাংয়ের লিডার রয়েছেন। তারা চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক বিক্রিসহ নানা অপকর্মে জড়িত। এলাকাবাসীকে শান্তিতে রাখতে এ অভিযান অব্যাহত রাখা হবে।’

রোববার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আইএসপিআর জানায়, দেশের চলমান পরিস্থিতিতে জনসাধারণের জানমাল ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহের সার্বিক নিরাপত্তা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড রোধ ও আইনের শাসন সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে দেশব্যাপী নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করছে সেনাবাহিনী।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এরই ধারাবাহিকতায় শনিবার আনুমানিক রাত ১০টার দিকে মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে সেনাবাহিনীর ৪৬ স্বতন্ত্র ব্রিগেড, র‍্যাব ও পুলিশের সমন্বয়ে এই যৌথ অভিযান পরিচালিত হয়। এই অভিযানে সেনাবাহিনী, র‍্যাব এবং পুলিশের একাধিক দল অংশগ্রহণ করে।

শনিবার মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে গোলাগুলি ও আহতের ঘটনায় ঢাকার পুরনো এই এলাকাটিতে নিরাপত্তা নিয়ে বাসিন্দাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়। এর আগে দোকান ডাকাতির ঘটনাটিও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আবাসিক এলাকাগুলোর নিরাপত্তা ও সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনী।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) হিসাব অনুযায়ী, ১ থেকে ২৫ অক্টোবর, এই ২৫ দিনে মোহাম্মদপুর থানায় চারটি হত্যাকাণ্ড, একটি ছিনতাই ও দুটি ডাকাতির মামলা হয়েছে। এর আগে সেপ্টেম্বর মাসে এই থানায় ১৭ খুন ও একটি ছিনতাইয়ের মামলা হয়।

ভয় জাগানো কিছু ঘটনা

গত ২৫ অক্টোবর রাতে মোহাম্মদপুরের বছিলা এলাকায় ধারালো অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে একটি সুপার শপ ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের দোকানে দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। দোকানের সিসি ক্যামেরায় দেখা যায়, ডাকাতদলের হাতে ধারালো অস্ত্র ছিল। প্রায় একই সময়ে কাছের আরেকটি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের দোকানে হামলা চালিয়ে নগদ টাকা নিয়ে যায় তারা।

ওই ঘটনার পর ২৬ অক্টোবর রাতে মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযানে নামে র‌্যাব, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা।

এর আগে গত ২৯ জুলাই ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ নেতা কামাল হোসেনকে কাটাসুরে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

১ সেপ্টেম্বর নবোদয় হাউজিং এলাকায় স্থানীয় কবজি কাটা গ্রুপের মূলহোতা আনোয়ার, রংপুইরা আকাশ, রাফাত, তুষার ও আহমেদের নেতৃত্বে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ফাইটার বিল্লাল গাজী নামে এক যুবককে।

৪ সেপ্টেম্বর জেনেভা ক্যাম্পে সনু নামে এক যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর শাহাদাত নামে এক যুবককে গ্রিন ভিউ হাউজিং এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

২০ সেপ্টেম্বর রায়েরবাজারে নাসির ও মুন্না নামে দুই যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সদ্য কারামুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালের নির্দেশে কিশোর গ্যাং লিডার এলেক্স ইমন ও তার লোকজন এই হত্যাকাণ্ড ঘটায় বলে এজাহারের সূত্র ধরে পুলিশ জানায়।

২৪ সেপ্টেম্বর চাঁদ উদ্যানে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মান্নান হোসেন ও একই ওয়ার্ডের লাউতলা ইউনিটের নেতা রিয়াজ ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হন। সন্ধ্যায় ৭ থেকে ৮টি মোটরসাইকেলে ১৫ থেকে ২০ জন সন্ত্রাসী এসে প্রথমে গুলি চালায়। এরপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তাদের আহত করে।

২ অক্টোবর রাতে স্বপ্নধারা হাউজিংয়ের ১ নম্বর রোড থেকে শুরু করে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিভিন্ন গলির মুখে ব্যারিকেড দিয়ে অস্ত্রের মুখে ছিনতাই করে একদল সশস্ত্র কিশোর। তারা অন্তত ১৫-২০ জন পথচারীর টাকা-পয়সা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এ সময় দুজন নারীকেও মারধর করা হয়।

১৬ অক্টোবর রাতে জেনেভা ক্যাম্পে গুলিবিদ্ধ হয়ে শানেমাজ ওরফে শাহনেওয়াজ ওরফে কাল্লু নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। গত দুই মাসে সানু, শাহেন শাহ ও সাগরসহ ৫ জন নিহত হয়েছেন এই ক্যাম্পে

১৭ অক্টোবর ভোরে বসিলা চল্লিশ ফুট এলাকায় এক সিএনজি অটো-রিকশাচালককে কুপিয়ে হত্যা করে ছিনতাইকারীরা।

১৯ অক্টোবর বসিলায় ছিনতাইকারীরা তিন ব্যক্তির কাছ থেকে অস্ত্রের মুখে দুটি মোবাইল ফোন ও ৯ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। ২০ অক্টোবরমোহাম্মদপুর হাউজিং লিমিটেড এলাকায় দুটি মোটরসাইকেলে করে ছয় ছিনতাইকারী প্রকাশ্যে অস্ত্র ঠেকিয়ে গাড়ি ভাঙচুর করে এবং একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ১১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ও ১৭ হাজার টাকার চেক ছিনিয়ে নেয়।

২২ অক্টোবর ভোরে মোহাম্মদিয়া হাউজিংয়ের ৬ নম্বর রোডে রামদা-চাপাতি নিয়ে মুরগিবোঝাই মিনি ট্রাকের পথরোধ করে ৬-৭ জন তরুণ। তারা ২৪ হাজার টাকা ও মোবাইল ফোন নিয়ে যায়। ট্রাক থেকে মুরগি নিয়ে যাওয়ার সময় বাধা দিতে গেলে মুরগির মালিক কাশেমকে কুপিয়ে জখম করা হয়।

এসব ঘটনার প্রতিবাদ জানান স্থানীয় জনতা। ২৫ অক্টোবর মোহাম্মদপুর থানার সামনে শতাধিক মানুষ প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেন।

স্থানীয়রা বলেন, অপরাধীরা অস্ত্র প্রদর্শন করে চাঁদাবাজি করছে। এমনকি বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক গ্যাংয়ের সদস্যরা গণডাকাতিও করছে। কিন্তু পুলিশ তাদের আইনের আওতায় আনতে পারছে না।

স্থানীয় জনতার পক্ষে জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য মুতাসিম বিল্লাহ ডাকাতি ও ছিনতাই নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য পুলিশকে ৭২ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন।

তিনি বলেন, এই সময়ের মধ্যে মোহাম্মদপুর এলাকায় পুলিশের টহল বাড়াতে হবে ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কিশোর গ্যাং, চাঁদাবাজি ও সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। দৃশ্যমান কোনও পদক্ষেপ দেখা না গেলে ছাত্র-জনতা মোহাম্মদপুর থানায় অবস্থান করবে।

মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ইয়াজেম পলাশের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘রাতে অফিস থেকে ফিরতে হয়; বাসার গলিতে ঢুকতেই গা ছমছম করে ওঠে; এই বুঝি পেছনে থেকে কেউ চাপাতি নিয়ে তেড়ে আসছে!’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ হাকিম মোহাম্মদপুরে টাউন হলের পূর্ব দিকে একটি ভাড়া বাসায় কয়েক বন্ধুর সঙ্গে থাকেন। কথা হলে তিনি বলেন, ‘বাসা থেকে বের হলে বিশেষ করে সন্ধ্যার পর ছিনতাইয়ের ভয় কাজ করে। এ জন্য এখন তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসি।’

এমন পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা জোরদার করতে ব্যবস্থা নিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও ডাকাতিরোধে রোববার (২৭ অক্টোবর) থেকে প্রতিটি হাউজিংয়ে অস্থায়ী ক্যাম্প বসিয়েছে সেনাবাহিনী। এসব ক্যাম্প থেকে ওই এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সার্বক্ষণিক কাজ করবেন সেনা সদস্যরা।

রোববার আইএসপিআরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ‘নিরাপত্তাহীনতায় নিমজ্জিত মোহাম্মদপুরবাসীর জীবনে স্বস্তি আনার লক্ষ্যে যৌথ বাহিনীর এই অভিযান সুপরিকল্পিতভাবে পরিচালিত হয়। এতে মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে ৪৫ জন অপরাধী ৯টি দেশীয় ধারালো অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়।’

ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা পাওয়ার পর থেকে মোহাম্মদপুর, আদাবর এবং শের-ই-বাংলা নগর থানাধীন ১৫২ জন অপরাধী, ১৮টি আগ্নেয়াস্ত্র, ২৭১ রাউন্ড গোলাবারুদ, ১৭২ ধরনের বিভিন্ন দেশি-বিদেশি অস্ত্র, একটি গ্রেনেড এবং বিপুল পরিমাণ নেশাজাত দ্রব্য উদ্ধার হয়, বলা হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে।

সন্ত্রাস দমন এবং আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে সেনাবাহিনীর কঠোর অবস্থান অব্যাহত থাকবে জানিয়ে আইএসপিআর বলেছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গ্রেপ্তারকৃতদের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

সার্বিক মোহাম্মদপুরে নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে থানার অফিসার ইনচার্জ আলী ইফতেখার রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘সেনাবাহিনী, র‌্যাবসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা কাজ আমাদের সহযোগিতা করছে।

‘এর পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদেরও সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে। তারা নানাভাবে এসব অপরাধীদের তথ্য আমাদের দিতে পারে; সঙ্গে সঙ্গে সেখানে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

অপরাধ ও আইন এর সর্বশেষ খবর

অপরাধ ও আইন - এর সব খবর