thereport24.com
ঢাকা, বুধবার, ২৫ জুন 25, ১১ আষাঢ় ১৪৩২,  ২৮ জিলহজ 1446

পাহাড়ে মিষ্টি তেঁতুল

২০১৪ এপ্রিল ০৯ ২১:৪২:৪১
পাহাড়ে মিষ্টি তেঁতুল

তেঁতুলের নাম শোনা মাত্রই টক স্বাদের জন্য জিহ্বায় পানি এসে যায় যে কোনো ব্যক্তির। মিষ্টি স্বাদের তেঁতুলও যে আছে তা অনেকে হয়ত ভাবতে পারেন না। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে-বাংলাদেশের পাহাড়ে এখন চাষ হচ্ছে মিষ্টি তেতুল! তবে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও মাতৃগাছের অভাবে মিষ্টি তেঁতুল চাষের আশানুরূপ প্রসার ঘটছে না। এমনটিই দাবি সংশ্লিষ্টদের।

২০০৯ সালে বারিতে (বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট) মিষ্টি জাতের তেঁতুল অবমুক্ত করার পর প্রায় ৬ বছর হতে চলেছে। কিন্তু এখনও পাহাড়ি অঞ্চল ছাড়া উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কৃষকের হাতে ওই তেঁতুল গাছের চারা তুলে দেওয়া সম্ভব হয়নি। কবে নাগাদ ব্যাপকভাবে কৃষকের হাতে এ চারা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে তা সংশ্লিষ্ট দফতরের কোনো কর্মকর্তা স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না। এখনও কেন্দ্রীয়ভাবে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের কাছেও বিতরণের জন্য চারা দেওয়া সম্ভব হয়নি।

পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের উর্ধ্তন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. ম. আব্দুর রউফ দ্য রিপোর্টকে বলেন, তেঁতুল টক স্বাদের ফল হিসেবে আমাদের কাছে পরিচিত। মিষ্টি তেঁতুলের সঙ্গে আমাদের দেশের মানুষের পরিচিতি নেই বললেই চলে। মিষ্টি স্বাদের কারণে ও খাদ্যমান বিবেচনায় মিষ্টি তেঁতুল আমাদের দেশেও যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

মিষ্টি তেঁতুলের চাষাবাদ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন পাহাড়ে বছরে ২০/২২টি চারা উৎপন্ন করা সম্ভব হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৩/৪শটি চারা বিভিন্ন পর্যায়ে দেওয়া হয়েছে। তবে প্রকৃতপক্ষে কত সংখ্যক ও কোথায় কোথায় দেওয়া হয়েছে এবং চারাগুলোর বর্তমানের অবস্থা কি তা তিনি স্পষ্ট করে বলতে পারেননি।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের(বারি) মহাপরিচালক ড. ম. রফিকুল ইসলাম মণ্ডল বলেন, ২০০৯ সালে বারি তেঁতুল-১ নামের এই মিষ্টি তেঁতুলের জাতটি অবমুক্ত হয়। একই বছর পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র মিষ্টি তেঁতুলের জাতটি উদ্ভাবন করে। এই মিষ্টি তেঁতুলের উৎপত্তিস্থল থাইল্যান্ড। নিয়মিত ফলধারী এই জাতটি থাইল্যান্ড থেকে আনা জার্মপ্লাজম থেকে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচন করা হয়। ১৯৯৯ সালে প্রথম খাগড়াছড়িতে এই গাছ লাগানো হয় এবং ২০০৭ সালে এটি প্রথম ফল দেয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।

মহাপরিচালক ড. ম. মন্ডল এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, আমাদের দেশে অত্যন্ত সুপরিচিত একটি ফল হলেও মিষ্টি তেঁতুল ততটাই অপরিচিত। তেঁতুলের নাম শোনা মাত্রই সবার একটি টক স্বাদের ফলের কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু এই তেঁতুলটি সম্পূর্ণ মিষ্টি স্বাদযুক্ত একটি ফল। তিনি বলেন, মিষ্টি তেঁতুলে রোগবালাই ও পোকার আক্রমণ তুলনামূলকভাবে অনেক কম এবং এর চাষাবাদ সহজ হওয়ায় বাংলাদেশে বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চলে এই তেঁতুলের চাষাবাদের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। মিষ্টি তেঁতুলের বাজার মূল্য এবং চাহিদাও খুব বেশি। তাই বাংলাদেশে এই তেঁতুলের চাষ ও প্রচার ব্যাপকভাবে করা দরকার।

চাষাবাদের গতিহীনতার কথা জানতে চাইলে বারি মহাপরিচালক দ্য রিপোর্টকে বলেন, বারির দায়িত্ব গবেষণা করে জাত উদ্ভাবন ও অবমুক্ত করা। মাঠ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরসমূহ পালন করে থাকে। এ ক্ষেত্রে আমাদের আর বিশেষ কিছু করার থাকে না।

পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. ম. মহব্বত উল্যা বলেন, দেশে মিষ্টি তেঁতুলের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। তবে মাতৃগাছের অপ্রতুলতা ও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে এই তেঁতুল চাষের প্রসার ঘটাতে আরও ব্যাপক সময়ের প্রয়োজন।

তিনি বলেন, মিষ্টি তেঁতুল লিগিউমিনোসি পরিবারভুক্ত উদ্ভিদ। খাদ্যমানের দিক থেকেও এটি একটি অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিমান সমৃদ্ধ ফল। প্রতি ১০০ গ্রাম মিষ্টি তেঁতুলে ৭০ গ্রাম ক্যালরি, ১৪ দশমিক ৭ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ৮৬৭ আই.ইউ ভিটামিন ‘এ’, ৪২৯ মি. গ্রাম ক্যালসিয়াম, ৪৪ মি. গ্রাম ভিটামিন ‘সি’, ২ দশমিক ৩ গ্রাম প্রোটিন ও ৬ দশমিক ৩ গ্রাম আঁশ পাওয়া যায়।

পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি থেকে বদলি হয়ে যাওয়া চট্টগ্রামের হাটহাজারির আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ম. সেলিম বলেন, মিষ্টি তেঁতুল আমাদের দেশে তেমন পরিচিত নয়। তেঁতুল একটি অত্যধিক টক স্বাদের ফল হিসেবে আমাদের কাছে অত্যন্ত সুপরিচিত। ২০০৯ সালে মিষ্টি তেঁতুলের এই জাতটি বাংলাদেশে বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চলে চাষাবাদের জন্য অবমুক্ত করা হয়েছে। তবে মিষ্টি স্বাদ ও খাদ্যমান বিবেচনায় মিষ্টি তেঁতুল আকর্ষণীয় ফল হিসেবে আমাদের দেশের সর্বত্র সমাদৃত হবে। চাষাবাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনিও বলেন, ২০০৯ সালে খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে একটি মিষ্টি তেঁতুলের মাতৃগাছ ছিল। সেটিও সে বছরের ঝড়ে পড়ে যায়। পরে অনেক যত্নে সেটিকে সুস্থ করে তোলা হয়। বর্তমানে কেন্দ্রের অফিসের সামনে মিষ্টি তেঁতুলের একটি মাতৃগাছের বাগান করা হয়েছে। এই গাছ থেকে গুটি কলম তৈরি করে নির্দেশিত স্থানে দেয়া হবে। দেশে উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে গাছ পৌঁছে দিতে আরও অন্তত ৬/৭ বছর সময় লেগে যাবে।

ড. ম. আব্দুর রউফ বলেন, ‘বারি তেঁতুল-১’ একটি উচ্চ ফলনশীল জাত। গাছের উচ্চতা প্রায় ১৫ থেকে ২০ মিটার এবং বিস্তৃতি প্রায় ১০ থেকে ১৫ মিটার। ফলের আকার বড় এবং কার্ভ আকৃতির। ৮ থেকে ২০ সেন্টি মিটার লম্বা, বাদামি, অনিয়মিত ও কার্ভ আকৃতির ফলগুলো যখন পরিপক্ক হয় তখন পূর্ণ রসালো এবং পাল্প বাদামি থেকে লালচে বাদামি রঙের হয়। সম্পূর্ণ পরিপক্ক পডের খোসা হাত দিয়ে চাপ দিলে সহজেই ভেঙ্গে যায়। প্রতিটি ফলে প্রায় ৬ থেকে ১২টি বীজ থাকে। ‘বারি তেঁতুল-১’ এর পূর্ণ বয়স্ক গাছ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৭০ থেকে ৮০ কেজি তেঁতুল পাওয়া যায়। এই তেঁতুলে মিষ্টতার ব্রিক্স মাত্রা শতকরা ৭৫ ভাগ।

জলবায়ু ও মাটি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মিষ্টি তেঁতুল মৃদু উষ্ণ মণ্ডলীয় অঞ্চলে ভালো জন্মে। তবে সুনিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকলে ভারি বৃষ্টিপাতযুক্ত স্থানেও হয়। উঁচু, উর্বর, গভীর সুনিষ্কাশিত এবং মৃদু অম্লভাবাপন্ন বেলে দোআঁশ মাটিতে ভালো হয়। মিষ্টি তেঁতুলের জন্য সর্বোচ্চ ৪৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা এবং বার্ষিক ৫০০ থেকে ১৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন। মিষ্টি তেঁতুল সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ১ হাজার মিটার উঁচু স্থানে জন্মে। সাধারণত এ গাছ মৃদু অম্ল ও ক্ষারযুক্ত মাটি সহ্য করতে পারে। কিন্তু বেলে দোআঁশ মাটিতেও ভালো হয়।

তিনি বলেন, বীজ ও অঙ্গজ দুই ভাবেই মিষ্টি তেঁতুলের বংশবিস্তার করা সম্ভব। এছাড়া পরিপক্ক বীজ বীজতলায় চারা তৈরি করে বংশবিস্তার করা যায়। এ ক্ষেত্রে বীজ গজানোর জন্য এক সপ্তাহ সময় লাগে। মিষ্টি তেঁতুলের বীজ ভালভাবে শুকিয়ে রাখলে কয়েক মাস পর্যন্ত এর সজীবতা বজায় থাকে। কিন্তু বংশবিস্তারের জন্য সংগৃহীত বীজ একটি উৎকৃষ্ট মানসম্পন্ন গাছ থেকে নির্বাচিত হওয়া উচিত। বীজ থেকে পাওয়া গাছের গুণাগুণ মাতৃগাছের মতো না হওয়ায় এবং ফলন দেরিতে হওয়ায় এ পদ্ধতি অনেক ক্ষেত্রেই পরিহার করা হয়। বীজ থেকে প্রাপ্ত গাছ ৭ থেকে ৮ বছরে ফল দেয়।

অঙ্গজ বংশবিস্তার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মিষ্টি তেঁতুলের ক্ষেত্রে অঙ্গজ উপায়ে বংশবিস্তার করে ভালো ফল পাওয়া সম্ভব। অঙ্গজ উপায়ে উৎপাদিত গাছে মাতৃগাছের গুণাগুণ বজায় থাকে। এক্ষেত্রে গুটি কলম ও গ্রাফটিংয়ের মাধ্যমে ভালো ফল পাওয়া যায়। এ ধরনের গাছ থেকে ৩/ ৪ বছরের মধ্যেই ফল পাওয়া সম্ভব।

(দ্য রিপোর্ট/এম/এইচএসএম/এনআই/এপ্রিল ০৯, ২০১৪ )

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর