thereport24.com
ঢাকা, মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারি 25, ২৪ পৌষ ১৪৩১,  ৭ রজব 1446

 

বাঙালীর নতুন বছর সঞ্জয় সরকার

২০১৪ এপ্রিল ১৫ ১৫:২৩:০৭
বাঙালীর নতুন বছর
সঞ্জয় সরকার

বাংলা সনের প্রেক্ষাপট : বাংলা সনের প্রবর্তন কবে কখন কে করেন, তা পণ্ডিতী আলোচনার বিষয়। এ নিয়ে প্রতি বছর কাগজে বিস্তর লেখা হয়; এ বছরও তার ব্যতিক্রম হবার সম্ভাবনা নেই। নবীশ কিংবা জ্ঞানপিপাসু যারা সেখান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তারা তাদের জ্ঞান ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে পারবেন।

কিন্তু, আমি এখানে আমার একটি বিশ্বাসের কথা সবাইকে জানাতে চাই। বিশ্বাসটি অবশ্যই ব্যক্তিগত ধারণাজাত— ব্যক্তিগত অনেক ধারণাই অবশ্য কালে কালে বিশ্বজনীনতা লাভ করেছে। আমার তেমন অভিপ্রায় নাই। আমার বিশ্বাস এই যে, আমাদের এই বাংলা সন পরিপূর্ণরূপে আমাদের লোকসংস্কৃতির গর্ভজাত সন্তান। আমাদের লোক-সাংস্কৃতিক কাঠামোই আমাদের এমন একটি সন প্রবর্তনে এমন বাধ্য করেছে। বাঙালী আজ যে নববর্ষ উদযাপন করে তা বস্তুতঃ তার যাপিত জীবন ও লোক জীবনের সাংবৎসরিক শিল্পিত উপস্থাপনা। কোনো রাজা-বাদশার কিংবা জমিদারের ফরমান জারির মাধ্যমে রাতারাতি তা কার্যকর হয়ে যায়নি। প্রাগ-ঐতিহাসিক কাল থেকেই মানব সম্প্রদায়ের অন্যান্য গোষ্ঠীর মতো বাঙালীকেও অস্তিত্বের লড়াই করতে হয়েছে। টিকে থাকার সেই সংগ্রামের ভেতরেই নানা সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে। যেমন মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার সংগ্রামের একটি আদিমতম পেশা মৎস্য শিকার। প্রথমে তারা মাছ মেরেছে। পরে মাছ ধরেছে। মাছ মারতে তার ব্যবহার করে তাদের উদ্ভাবিত কিছু অস্ত্র। কিন্তু ধরতে ব্যবহার করেছে আরও উন্নত কৌশল। মাছেরা অনায়াসে ধরা পড়েছে মানুষের কৌশলের কাছে। মাছ ধরার এ সব উপকরণ, তখনকার জীবনধারা (লাইফ স্টাইল) মাছ ধারার মরশুম সবই হয়ে গেছে আমাদের লোক-সংস্কৃতির উপকরণ। কৃষির উদ্ভাবন মানব সভ্যতাকে এক বিশেষ লোক-সংস্কৃতির সন্ধান দেয়। আজকের বাংলাদেশ ও বাঙালী সেই সংস্কৃতির গৌরবমালা পরে আজও পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

কৃষিকাজই মূলতঃ মানবসম্প্রদায়কে একটি সময়ের ফ্রেমে বেঁধে ফেলে। ফসল বুনন, মাটি কর্ষণ, বীজবপন, সেচ, ফসল কর্তন সব কিছুতেই সময় মহানিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়। একটি ফসল পরিক্রমা অতিক্রম করতে ঘণ্টা-দিন-মাসের হিসেব এসে সামনে দাঁড়ায়। পরবর্তীকালে ব্যবসা-বাণিজ্য, মহাজনের লগ্নি টাকার সুদ আদায় সময়; বিশেষতঃ বছরের হিসাব অনিবার্য নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। মানুষের নৈমিত্তিক জীবনযাত্রায় এই প্রক্রিয়ার চর্চা আত্মস্থ হয়ে গিয়েছিল। বহুকালের লোক-চর্চার এই ধারাটিই হয়তো অধিষ্ঠান হয় সম্রাট আকবরের হাতে।

প্রথমতঃ কৃষক আমাদের লোক-সংস্কৃতির অন্যতম কারিগর। তারপর হিন্দুর কিছু উপেক্ষিত শ্রমজীবী সম্প্রদায়, কুমোর, কামার, তাঁতী, ছুঁতার এবং ততোধিক উপেক্ষিত ঋষি সম্প্রদায় এই নান্দনিক সংস্কৃতির যোগ্য উত্তরাধিকারীর একাংশ। আর পহেলা বৈশাখ বাঙালীর সেই হাজার বছরের লালিত সংস্কৃতির মহাসম্মিলনের দিন। যে দিনটিকে আমরা নানা কার্যকরণ থেকে বেছে নিয়েছি আমাদের বাংলা সালের প্রথম দিন হিসেবে। সভ্যতার চণ্ডালবৃত্তি আজ আমাদের ঐতিহ্য হন্তারক হয়ে আবির্ভূত হয়েছে।

একটি অভিজ্ঞতার গল্প : আমি ভাগ্যবান। জ্ঞান হবার পর থেকে বার বার বাঙালীর এই বার্ষিক লোক-সাংস্কৃতিক যজ্ঞ ভেতর থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আর যতটুকু দেখতে পায়নি তার গল্প শুনেছি ঠাকুরদাদাদের কাছে। সে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড। ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা থানাস্থ তীতুরকান্দি গ্রাম। পঁশ্চিমে মধুমতী আর পুবে গ্রামের গা ঘেঁষে পদ্মার শাখা-নদী বারাসিয়া। এ নদীর পাড়েই আজও বসে তিন শ’ বছরের পুরোনো বৈশাখী মেলা। বস্তুতঃ মেলাটির মূল ইতিহাস শিব পূজো কেন্দ্রিক। কিন্তু সব ছডিয়ে এটি হয়ে ওঠে বাঙালীর লোক-সংস্কৃতির বার্ষিক মহামিলনকেন্দ্র। কী নেই এখানে? কুমোরের শিল্পকর্ম, মন ভোলানো নানান খেলনা, কামারের দা, বটি, কুড়াল, কুড়ানী, ঋষিদের তৈরী ধামা, কুলা. চাঙারী, পোয়ে, ডুলা, বাঁশের বাঁশী, ঢোল, তালপাতার পাখা, তালপাতার খেলনা, ছুঁতারের কাঠের তৈরী গরুর গাড়ির চাকা, লাঙ্গল থেকে শুরু করে রুটি বেলার বেলুনী পর্যন্ত সব। সব রকমের মশলার পসরা সাজিয়ে বসত দোকানীরা। ময়রার মিষ্টির নানান পদ— বিশেষতঃ গরম জিলাপীর গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠত। কে ছিল না এখানে? শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে অতি সাধারণ দিন মজুর চাষী সবাই ছিল। লোক-সাংস্কৃতিক প্লাবন ভাসিয়ে দিত ধর্ম-বর্ণের সব বিভেদকে। সেই দিকে দিয়ে দেখলে এই মেলার ছিল এক অনন্য অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্য। এখানে পুতুল নাচ ছিল, যাত্রাগান ছিল, সার্কাস ছিল। আমরা শিশু-কিশোরেরা কেবল নয়— আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম এই পহেলা বৈশাখের জন্য। দু’দিনব্যাপী মেলা হতো। প্রথম ছিল পুরুষদের। শেষের দিন মেয়েদের। স্বভাবতঃ বাঙালী অসাম্প্রদায়িক। সে অসাম্প্রদায়িক চেতনার পুষ্ট ছবিটি আমি প্রত্যক্ষ করেছি এই বৈশাখী মেলায়। এমন এক সমৃদ্ধ লোক-সাংস্কৃতিক আর অসাম্প্রদায়িক পরিমণ্ডল আমার মতো অনেকের মানস গঠনে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। এখন সেই মেলার মুমূর্ষু অবস্থা। হয়তো বাংলাদেশের আরও অনেক মেলারও সেই অবস্থা।

এখন আমি দুর্ভাগা। নাগরিক সভ্যতার নিষ্ঠুর শিকলে আবদ্ধ। প্রায় দশ বছর এই লোক-সাংস্কৃতিক মিলন মেলা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয় নি। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে এখনও আমার মন চঞ্চল হয়ে ওঠে, ভেতরটা হয়ে ওঠে অস্থির। কখনও কখনও চোখের কোণে জলও জমে।

শুনেছি, মেলার অবস্থা এখন চৈত্রমাসের প্রায় শুকিয়ে যাওয়া গরম জলের হাঁপিয়ে ওঠা পুঁটি মাছের মতো। যে কেবল অবশিষ্ট জলটুকু শুকিয়ে যাবার প্রতীক্ষায় মৃত্যু প্রহর গুণছে !

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর