thereport24.com
ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১,  ২২ জমাদিউল আউয়াল 1446

চালকল বদলে দিয়েছে খাজানগরের শ্রমিকদের জীবন

২০১৩ নভেম্বর ১৮ ০৮:৪৫:৪৬
চালকল বদলে দিয়েছে খাজানগরের শ্রমিকদের জীবন

কুষ্টিয়া সংবাদদাতা : খাজানগরের চালকলের চাকা কেবল ব্যবসায়ীদের ভাগ্য বদলায়নি, বদলে দিয়েছে এখানকার শ্রমিকদের জীবনচিত্র। এদের অধিকাংশই নদীভাঙন, মঙ্গাকবলিত এলাকা ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া এলাকার নিম্নআয়ের মানুষ। দিন যত গড়াচ্ছে এখানকার চাতালের পরিধি ততই সম্প্রসারিত হচ্ছে। অধিক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে চলেছে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা কর্মপ্রত্যাশীদের। স্বাচ্ছন্দ্যে জীবিকা নির্বাহ করছেন এখানকার শ্রমিকরা।

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগর। শুরুতে মোকাম খাজানগরে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরে তা সম্প্রসারিত হয়ে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়ক সংলগ্ন বটতৈল থেকে পোড়াদহ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। ৫ শতাধিক চালকল আর চাল প্রক্রিয়াকরণের জন্য এখানে গড়ে উঠেছে প্রায় ২৫০০ চাতাল। এ সব চাতালে দিন হাজিরায়, চুক্তিভিত্তিতে ও ভাড়াভিত্তিতে কাজ করে প্রায় ২০ হাজার নারী-পুরুষ শ্রমিক।

গত ১০ বছরে খাজানগর মোকামে শতাধিক অটো, বাছাই অটো এবং ড্রয়ার অটো রাইস মিলও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানকার শ্রমিকদের কেউ স্বামীর সংসার, নিজভূমি ছেড়ে সন্তান-সন্তুতি নিয়ে ধানের চাতালে এসে সংসার পেতেছেন। আবার কেউ এখানে কাজ করতে আসেন মৌসুমভিত্তিক। কুষ্টিয়ার খাজানগর দোস্তপাড়া এলাকায় কয়েকটি চাতাল ঘুরে এমন কথাই জানা গেল। দেখা গেল, চাতালে নারী শ্রমিকদের দৈনন্দিন জীবনচিত্র। দোস্তপাড়া বটতৈল-পোড়াদহ সড়ক ঘেঁষেই রয়েছে পাঁচভাই রাইস মিল। এ মিলের সঙ্গেই প্রায় দুই একর জায়গাজুড়ে রয়েছে ধানের চাতাল। হ্যাসিং পদ্ধতিতে এখানে ধান ভাঙানো হয়।

পাঁচ ভাই রাইস মিলের ধানের চাতালে পৌঁছাতেই দেখা গেল, বড় চওড়া একটি কাঠের দুপাশে দড়ি বেঁধে সামনে একজন নারী শ্রমিক রোদে শুকাতে দেওয়া ধান টানছেন আর তার পেছন থেকে হাতল ধরে আরেকজন নারী শ্রমিক সামনের দিকে ঠেলছেন। তাদের ভাষায় একে পাওট বলে। এক গ্যাস (১০০ মণ) ধান সিদ্ধ ও শুকনো করে মিলে তুলে দিলে একজন শ্রমিককে দেওয়া হয় ১৫০ টাকা, ৫ কেজি চাল, আড়াই কেজি খুদ এবং প্রয়োজনীয় জ্বালানি। তবে ১০০ মণ ধান সিদ্ধ-শুকনো করে ভাঙানোর উপযোগী করতে চারজনের একটি টিম একসঙ্গে কাজ করে থাকে। এক গ্যাস ধান সিদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে মিলে তুলে দিতে সময় লাগে প্রায় দুদিন। অর্থাৎ দুদিনে প্রত্যেকের আয় হয় প্রায় ৪০০ টাকা।

এ চাতালে দীর্ঘ চার বছর ধরে কাজ করছেন মাঝ বয়সী নারী শ্রমিক আয়শা বেগম। বয়স তার চল্লিশের কোঠায়। কথা হয় তার সঙ্গে। ১৫ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। স্বামীর সংসারে ভালোই চলছিল। বৈবাহিক জীবনে দুটি ছেলেমেয়ে হয়। কিন্তু মাত্র চার বছর আগে সুখের সংসার ভেঙে যায়, স্বামী মহসিন আলী দ্বিতীয় বিয়ে করায়। একদিকে স্বামীর সংসার বিচ্ছিন্ন, অপরদিকে দরিদ্র বাবা-মায়ের সংসার। কোনো দিকে যাওয়ার উপায় রইল না তার। বেঁচে থাকার তাগিদে আয়েশা বেগম দুটি ছেলেমেয়ে নিয়ে এক সময় বাঘা থেকে পাড়ি জমান কুষ্টিয়ার দোস্তপাড়া ধানের চাতালে। সেই থেকে আছেন এখানে।

তিনি আরও জানান, সারাদিন কাজ করে চাতালের মধ্যেই রাত কাটত। মাত্র দুবছর আগে দোস্তপাড়া গ্রামের ভেতর একখণ্ড জমি কিনেছেন। সেখানে করগেট টিন, চাটাই দিয়ে কোনোমতে ছাপড়া করে বসবাস করছেন। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন । স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে বেশ ভালোই আছে মেয়ে। ছেলেটি সবে স্কুলে যেতে শুরু করেছে। দিনে চারজনের টিমে এক গ্যাস (১০০ মণ) ধান সিদ্ধ-শুকনো করে মিলে তুলে দিতে পারলে পারিশ্রমিক বাবদ পাওয়া যায় ৬০০ টাকা, ২০ কেজি চাল এবং ১০ কেজি খুদ। নিজের উপার্জিত অর্থ দিয়ে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই চলছে তার সংসার। ব্যাংকে একটি ডিপিএসও আছে। প্রতি মাসে কিছু সঞ্চয় করেন ভবিষ্যতের জন্য।

ভানু জানান, তিনি কখনো শ্রমিক হতে চাননি। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের স্বপ্ন ছিল তার। স্বামীর কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে একমাত্র ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করবেন। মেয়েকে ভালো ঘর ও বর দেখে বিয়ে দিবেন। এটিই ছিল তার স্বপ্ন। কিন্তু স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে অন্যত্র চলে যাওয়ায় ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে আর সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে ধানের চাতালে কাজ নিয়েছিল। চাতালের কাজ করা বেশ কষ্টসাধ্য। রাত ৩টার দিকে উঠতে হয়, ধান ভাপানোর জন্য। আবার বেলা ওঠার আগেই শেষ করতে হয় ধান ভাপানোর কাজ। দেরি হলে আগ রোদে ধান শুকানো যায় না। আবার ধান শুকাতে দেরি হলে ব্যাপারির কাছে নাজেহাল হতে হয়। সূর্যোদয়ের আগে ধান ভাপানোর কাজ শেষ করে দুটো পান্তা মুখে দিয়েই শুরু করে ধান শুকানোর কাজ। বেলা গড়ানোর আগেই ধান শুকানোর কাজ শেষ করতে হয়।

তাদের প্রতিটি কাজ চলে যেন রুটিনমাফিক। সারাদিনে এতটুকু ফুরসত নেই। তবে দুপুরে ধান শুকানোর ফাঁকে ফাঁকে তারা মেতে ওঠে পুরনো দিনের স্মৃতি আওড়াতে। আবার অনেকে গল্পের মাঝে কাঁথা বা জামা-কাপড় সেলাই করে অলস সময় পার করে। ভোরে গ্যাসের আগুনের তপ্ত হাওয়া, দুপুরের প্রখর রৌদ্রতাপ আবার আকস্মিক বৃষ্টি সবই বয়ে যায় তাদের শরীরের ওপর দিয়ে। তবে এ কাজেও সান্ত্বনা আছে তাদের। আয়শা বেগম জানায়, নিজের উপার্জিত অর্থ দিয়ে সন্তানদের লালন করা, কিছু সঞ্চয় করা, এটাই বা কম কিসের।

শ্রমিক আমেনা খাতুন এবং আনজেরা খাতুন জানান, তাদের অতীতও আয়েশা বেগমের মতোই। নদীভাঙনের কবলে পড়ে একযুগ আগেই পাড়ি জমিয়েছের দোস্তপাড়ায়। এখানে এসে বেশ ভালোই আছেন তারা। দেশের বিভিন্ন কলকারখানায় কারণে-অকারণে শ্রমিক অসস্তোষের খবর পাওয়া যায়। কিন্তু খাজানগর একটি বৃহত্তম চাল উৎপাদনকারী এলাকা। যেখানে প্রতিদিন চলে প্রায় ২০ হাজার নারী-পুরুষ শ্রমিকের কর্মযজ্ঞ। অথচ কোনো শ্রমিককে টুঁ-শব্দটিও করতে শোনা যায় না।

এর কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে চাতালের এক পুরুষ শ্রমিক জানান, এখানে আন্দোলনের প্রয়োজন পড়ে না। কেননা কেবল বেতন বা হাজিরা নয় বাড়তি টাকার প্রায়োজন হলেও মালিক তা এক কথায় দিয়ে থাকেন। আবার অসুখ-বিসুখেও মিল মালিক সহায়তা দিয়ে থাকেন। যার কারণে মিল মালিক এবং শ্রমিক কারও মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কোনো আশঙ্কা নেই। মোকামের অপর এক শ্রমিক আলেক জানান, মিল মালিকরা শ্রমিকদের প্রতি বেশ স্নেহপরায়ণ। এখানকার অনেক চাতাল ব্যবসায়ী, পালিশ ব্যবসায়ী এমনকি অনেকে মিল মালিকও হয়েছেন চাতাল শ্রমিক থেকে। খাজানগরের চালকলের চাকা কেবল ব্যবসায়ীদের ভাগ্য বদলায়নি, বদলে দিয়েছে এখানকার শ্রমিকদের জীবনচিত্র।

(দিরিপোর্ট/এফএস/এএস/জেএম/নভেম্বর ১৮, ২০১৩)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর

জেলার খবর - এর সব খবর