thereport24.com
ঢাকা, বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১,  ২৩ জমাদিউস সানি 1446

‘সরকারই রাজনীতিকে সহিংস করছে’

২০১৩ ডিসেম্বর ০৫ ০০:১১:৪৮
‘সরকারই রাজনীতিকে সহিংস করছে’

তারেক সালমান ও মাহমুদুল হাসান, দ্য রিপোর্ট : সরকারই রাজনীতিকে সহিংস করে তুলেছে বলে অভিযোগ করেছেন রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে স্বীকৃত নাগরিকদের জনসভা ও শোভাযাত্রা বন্ধ করে দেওয়ায় এ সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

জনসভা ও শোভাযাত্রা বন্ধ করে দেওয়ায় বিএনপি-জামায়াতের চলমান আন্দোলন প্রতিদিন সহিংস হয়ে উঠছে। সরকারের দমন নীতির কারণে অনেকটা নিষিদ্ধ দলের মতো আচরণ করছে বিএনপি। দলটির যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ গ্রেফতার হওয়ার পর বিএনপির মুখপাত্রের দায়িত্ব পালনকারী আরেক যুগ্ম মহাসচিব প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্যও দিতে পারেননি। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তিনি গোপন স্থান থেকে তার বার্তা পাঠিয়ে দিচ্ছেন। বেসরকারি টেলিভিশনগুলোতে পাঠাচ্ছেন ভিডিও বার্তা। গোপন স্থান থেকে তার এই বার্তা পাঠানোকে অনেকে যুদ্ধাবস্থা বা গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করেছেন।

বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে নাগরিকদের জনসভা ও শোভাযাত্রা করার অধিকার স্বীকৃত। অথচ চলতি বছরের ১৯ মে থেকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) স্বীকৃত রাজনৈতিক দল বিএনপি প্রকাশ্যে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে পারছে না। সরকারের এ কর্মকাণ্ড সংবিধান লঙ্ঘন বলেও বিএনপি নেতারা বিভিন্ন সময় দাবি ও অভিযোগ করে আসছেন। বিএনপির দাবি, সরকারই দেশের রাজনীতিকে কূলষিত করতে বিএনপিকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ ব্যাপারে বলেন, ‘বর্তমান সরকার গণতন্ত্রের লেবাসে দেশে একদলীয় স্বৈরশাসন চালাচ্ছে। আসলে আওয়ামী লীগ কখনও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল ছিল না। তাদের মানসিকতা সব সময়ই একদলীয় ও স্বৈরতান্ত্রিক।’

মির্জা ফখরুল বলেন, বিএনপি দেশের সর্ববৃহৎ ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। বারবার দলটিকে জনগণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছে। অথচ বর্তমান সরকার দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ্যে আমাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে দিচ্ছে না। তিনি বলেন, সরকারের এ কর্মকাণ্ড দেশে সুস্থ গণতন্ত্রের জন্য অশনি সঙ্কেত।

ফখরুল অভিযোগ করেন, সরকার পরিকল্পিতভাবে দেশকে সাংঘর্ষিক অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

অভিজ্ঞ মহলের অভিমত, কোনো রাজনৈতিক দল যখন প্রকাশ্যে তাদের দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে অপারগ বা বাধাপ্রাপ্ত হয়, তখন বাধ্য হয়েই তারা ‘আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির’ মতো আচরণ ও কর্মকাণ্ড করে থাকে। ক্ষমতাসীনদের বাধায় তখন দলগুলোর নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ হন। আর এ কথাতো স্বীকৃত, ক্ষুব্ধতা ভাল কিছু আনতে পারে না। যে কারণে দেশের রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলো আগের মতো শান্তিপূর্ণ থাকছে না। দিন দিন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ভর করছে সহিংসতা, হিংসা। যা দেশের সুস্থ রাজনীতি ও গণতন্ত্রের জন্য কোনোভাবেই কল্যাণকর নয়।

বাংলাদেশের সংবিধানে ৩৭ অনুচ্ছেদে আছে-‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’

নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা হচ্ছে মোট ৪২টি। এর মধ্যে ১৮ দলীয় জোটের প্রধানতম দল হচ্ছে বিএনপি। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্রমিকানুসারে বিএনপির অবস্থান ০০৭। ০০১ নম্বরে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হচ্ছে কর্নেল অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ক্রমিক হচ্ছে ০০৬। সর্বশেষ নিবন্ধিত দলটি হচ্ছে বহুল আলোচিত বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ)।

মামলার জালে বন্দি দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সিনিয়র নেতারা গ্রেফতার এড়াতে রয়েছেন আত্মগোপনে। কিছুদিন আগে গ্রেফতার করা হয় দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, ব্রি. জে. (অব.) আ স ম হান্নান শাহসহ বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের অসংখ্য নেতাকর্মীদের।

রিজভী আহমেদ গ্রেফতার হওয়ার পর বিএনপির অবস্থা এমন নাজুক পরিস্থিতিতে পৌঁছায় যে, দলের কর্মসূচি ঘোষণা করারও নেতা পাওয়া যাচ্ছে না দলটিতে। বিএনপির হাইকমান্ড মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করার জন্য দলের আরেক যুগ্ম মহাসচিব সাবেক মন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদকে দায়িত্ব দেন। কিন্তু তিনি গেল কয়েক দিনেও দলীয় কার্যালয়তো দূরের কথা, প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্যও দিতে পারেননি।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মে.জে (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী দ্য রিপোর্টকে এ ব্যাপারে বলেন, সরকারের আচরণে মনে হচ্ছে দেশে যুদ্ধাবস্থা চলছে। যাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাকেই ধরে নেওয়া হচ্ছে। সরকার রাজনৈতিক পরিবেশ অস্থিতিশীল করে তুলছে। সুস্থ রাখছে না। এই মেয়াদ উত্তীর্ণ সরকারের স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ড সুস্থ গণতন্ত্রের জন্য হুমকি স্বরূপ। এ থেকে তাদের ফিরে আসা উচিত।

বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আরও বলেন, গোপনে থেকে কে দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে চায়? আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামসহ সকলেই হুলিয়া নিয়ে চলছেন। সিনিয়র নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার, রফিকুল ইসলাম মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আ স ম হান্নান শাহ দলের পক্ষে বক্তব্য রাখছিলেন, তাকেও এ সরকার ধরে নিয়ে গেছে।

জেনারেল আলম আরও বলেন, সরকার যদি সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি না করে, তাহলে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ সুস্থ থাকতে পারে না। বর্তমান সরকার দেশের বৈধ রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে, এখন তা বিএনপির মতো বৃহৎ ও জনপ্রিয় দলের সঙ্গেও করার চেষ্টা করছে। করতে চাচ্ছে। এটা ঠিক না। তাদের এ আচরণ ও মনোভাব গণতন্ত্রের জন্য চরম হুমকি।

বিএনপি চেয়ারপারসনের আরেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খান দ্য রিপোর্টকে বলেন, অনৈতিক ও সম্পূর্ণ বেআইনি এবং স্বৈরাচারী কায়দায় দলের যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এটা নজিরবিহীন বর্বরতা। কারণ রিজভী আহমেদ দলীয় কার্যালয়েই থাকতেন। তিনি কোথাও পালিয়ে যেতেন না। গ্রেফতার করতে হলে দিনে-দুপুরেও সরকার তাকে গ্রেফতার করতে পারতো। কিন্তু সম্পূর্ণ অসৎ উদ্দেশ্যে তাকে গভীর রাতে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সরকার সরাসরি বিরোধী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তিনি বলেন, দলীয় কর্মসূচি জনগণকে জানানোর জন্য দলের আরেক যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিনকে দেশনেত্রী দায়িত্ব দিয়েছেন। এ দায়িত্ব প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই তার গ্রামের ও ঢাকার বাসায় পুলিশ তল্লাশি ও ভাঙচুর করেছে। তাকে গ্রেফতারের জন্য হন্যে হয়ে খুঁজছে। তিনি দলীয় অফিসেও যেতে পারছেন না। তাই বাধ্য হয়েই তিনি নিরাপদ স্থানে থেকে মিডিয়ায় বার্তা দিচ্ছেন। দলীয় কর্মসূচি ও ম্যাডামের নির্দেশনা জনগণকে জানাচ্ছেন। এটা আন্দোলনেরই কৌশল।

এ্যাডভোকেট আজম আরও বলেন, সারা বাংলাদেশ এখন বিরোধী দলের দখলে। শুধু ঢাকা শহরে সেই আন্দোলনের তাপটা আমরা দিতে পারিনি। তবে ঢাকার শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ উন্মুখ হয়ে আছে। কিন্তু স্বৈরাচারী সরকারের নির্মম নির্যাতনের কারণে নেতাকর্মীরা রাস্তায় নামতে পারছেন না। তাদের দেখামাত্র গুলি করা হচ্ছে। মানুষকে মেরে ফেলা হচ্ছে। যেকোনো সময় জনগণ রাস্তায় নেমে এসে স্বৈরাচারী সরকারকে টেনে নামাবে।

বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা দ্য রিপোর্টকে বলেন, হরতাল-অবরোধের নামে আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারা ও বাসে আগুন দেওয়াকে বিএনপি সমর্থন করে না। এমনও হতে পারে আন্দোলনকামী শক্তির ভাবমূর্তি নষ্ট করতে একটা চক্র এগুলো করছে। এটাই স্বাভাবিক। যাদের কাছে ক্ষমতা তারাই পারে এগুলো করতে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, বিএনপি কেন নিজেকে জনবিচ্ছিন্ন করতে এগুলো করবে? এটা বলা হয়, বিএনপির কাঁধে ভর করে অন্য কেউ সন্ত্রাস করছে। বিএনপির ওপর সহিংস রাজনীতির যে অভিযোগ চাপানো হচ্ছে সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যাচার। এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে আমরা প্রশ্রয় দেই না। আমাদের আন্দোলন একটা ইস্যুকে কেন্দ্র করে। তা হলো- বাংলাদেশের জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা।

ব্যারিস্টার হুদা আরও বলেন, স্বাধীনভাবে বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে না দিয়ে সরকার দেশকে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতিতে ঠেলে দিচ্ছে।

১৮ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টিও (জাগপা) সভাপতি শফিউল আলম প্রধান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ইতিহাসে এটাই প্রথম কোনো সরকার নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। নিজের জনগণকে দেখামাত্রই গুলি চালিয়ে মেরে ফেলছে। প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে না পারলে এ অবস্থা থেকে রেহাই পেতে রাজনৈতিক দলগুলোকে কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়। কর্মসূচিতে যে সহিংসতা আমরা দেখছি, তার পেছনে সরকারের সন্ত্রাসী ও এজেন্সিরা জড়িত। কারণ ১৮ দলের নেতাকর্মীরা কোনো ধরনের সহিংসতা করছে না। করার প্রশ্নই আসে না। কারণ তারা খালি হাতেই রাস্তায় বের হতে পারে না। গুলি করে মারা হয়। তারা সহিংস হবে কেমন করে?

শফিউল আলম প্রধান বলেন, বিরোধী দলের সঙ্গে এই ভারতীয় তাবেদার সরকার যে আচরণ করছে, কোনো সভ্য দেশে তা নিষিদ্ধ সংগঠনের সঙ্গেও করা হয় না। ভারতের ইঙ্গিত ও সাহায্য সহযোগিতায় শেখ হাসিনা যা করছেন, তা দেশের গণতন্ত্র, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য অশুভ ও হুমকি।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. পিয়াস করিম দ্য রিপোর্টকে বলেন, যেহেতু বাইরে এলে বিরোধী দলের নেতাদের গ্রেফতার হতে হচ্ছে, সেহেতু তারা আত্মগোপনে চলে যাচ্ছেন। সেখান থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তবে শঙ্কার কারণ হচ্ছে, রাজনীতি ভয়াবহ এক নৈরাজ্যের দিকে যাচ্ছে। ড. করিম অভিযোগ করে বলেন, সরকার বিষয়টি আরও ভয়াবহতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এটা গণতন্ত্রের জন্য আরও বেশি আতঙ্কজনক।

(দ্য রিপোর্ট/টিএস/এস/এইচএসএম/ডিসেম্বর ০৫, ২০১৩)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

রাজনীতি এর সর্বশেষ খবর

রাজনীতি - এর সব খবর