thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১,  ২১ জমাদিউল আউয়াল 1446

বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না

২০১৩ ডিসেম্বর ১৭ ২২:৫৭:১১
বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না

দ্য রিপোর্ট কূটনৈতিক প্রতিবেদক : চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিরোধী দলের প্রতি দমন নীতি, মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের সঙ্গে বিদেশি কূটনীতিকদের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। প্রতিদিনই দূরত্ব বাড়ছে।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট অচলাবস্থা নিরসনে এবং রাজনৈতিক সমাঝোতা করতে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের বিশেষ দূত সংস্থাটির রাজনৈতিক বিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে ঢাকায় পাঠানো হয়। কিন্তু সরকারের সদিচ্ছার অভাবে তারানাকো ‘ব্যর্থ’ হয়ে ফিরে যান। সমাঝোতার উদ্যোগে তারানকো যেন সফল হন এজন্য তার সফরকালেই প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিও ফোন করেন। কিন্তু তাতেও বরফ গলেনি।

সূত্রগুলো জানায়, সরকারের পক্ষ থেকে তারানকোকে জানানো হয়, সংবিধানের বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। এতে সরকারের সঙ্গে বিদেশিদের দূরত্ব বাড়তে থাকে। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূতরা নানা কারণেই সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ। রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে সংলাপ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বারবার তাগাদা দিলেও তারা মনে করছেন, মূলত সরকারের কারণেই সংলাপ সামনের দিকে এগোয়নি। সরকার বারবার সংলাপের কথা বললেও বিরোধী দলকে দমনপীড়নের বিষয়টিও অব্যাহতভাবে চালিয়ে গেছে। এই বিষয়গুলো ইইউ রাষ্ট্রদূতরা পছন্দ করেননি।

বিরোধী দলের দমনপীড়নের বিষয়টি পছন্দ না করা প্রসঙ্গে জার্মান রাষ্ট্রদূত আলব্রেখট কনজে সাংবাদিকদের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করেন। সম্প্রতি তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের কাছে বলেন, বিএনপির সিনিয়র নেতাদের অবিলম্বে মুক্তির জন্য আমি মন্ত্রীকে সব ধরনের উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করেছি। তাদের মধ্যে অনেকেই আমার বন্ধু। অ্যাটর্নি জেনারেল তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনেছেন, সেরকম কিছু করা যে তাদের পক্ষে সম্ভব না, তা আমি খুব ভাল করে জানি। তারা সহিংসতা সৃষ্টির পেছনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন না। তাদেরকে যেকোনো উপায়ে সরকারের মুক্তি দেওয়া উচিত।

এছাড়া যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ইস্যু নিয়েও ইইউয়ের সঙ্গে সরকারের টানাপড়েন শুরু হয়। কাদের মোল্লার ফাঁসির উদ্যোগ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাজ্য ও ইইউ উদ্বেগ প্রকাশ করে। যুক্তরাজ্য রীতিমতো তাদের প্রতিক্রিয়ায় যথাযথ আইন না মেনে ফাঁসি কার্যকর করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ তোলে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, যুদ্ধাপরাধ বিচার প্রসঙ্গে অনেক দেশ ও সংস্থাই বিবৃতি দিয়েছে। তাদের সবাইকেই প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। সরকার কারো ভয়ে ভীত নয়।

সবমিলিয়ে কূটনৈতিক অঙ্গনের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের সঙ্গে আসলে বিদেশি কূটনীতিকদের এক ধরনের টানাপড়েন চলছে। যার বার্তা তারা দিয়েছে গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনের অনুষ্ঠান বয়কটের মাধ্যমে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ ডিসেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিকদের জাতীয় স্মৃতিসৌধ এবং বঙ্গভবনে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু বিজয় দিবসের আগের দিন গত রবিবার বিকেলে ইইউর রাষ্ট্রদূতের ঢাকা অফিস থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে বলা হয়, সমন্বয় বৈঠক এবং বাংলাদেশ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করার কাজে ইইউর রাষ্ট্রদূতরা সোমবার ব্যস্ত সময় কাটাবেন। এই ব্যস্ততার কারণে রাষ্ট্রদূতরা সোমবার বিজয় দিবসে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারছেন না।

এই চিঠি পাওয়ার পর পরই অসন্তুষ্টি এবং ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ইইউকে চিঠি দেওয়া হয়। ইইউকে দেওয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ চিন্তাই করতে পারছে না যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে যোগদান থেকে বিরত থাকতে পারে। বিজয় দিবস বাংলাদেশের মানুষের আবেগ এবং গর্বের বিষয়। বাংলাদেশের বিজয় দিবসের মতো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে বিদেশি কূটনীতিকদের যোগ না দেওয়ার ঘটনা অতীতে কখনোই ঘটেনি।’

এ ব্যাপারে সাবেক এক কূটনীতিক বলেন, রীতি ভেঙ্গে স্মৃতিসৌধে না যাওয়াটা আসলে অস্বাভাবিক। তবে এর মাধ্যমে হয়তো ইউরোপীয় দেশগুলো সরকারকে কোনো বার্তা দিতে চাইছে।

তিনি বলেন, সম্ভবত বাংলাদেশের বর্তমান সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আসন্ন নির্বাচন নিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে অসন্তুষ্টি রয়েছে। তাছাড়া কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের বিষয়টিকেও সহজভাবে নিচ্ছে না দেশগুলো।

তবে স্মৃতিসৌধে না যাওয়ার বিষয়টি ভালভাবে নিচ্ছেন না অনেক বিশ্লেষকই। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, বিজয় দিবস সরকারের নিজস্ব কোনো বিষয় নয়। এটা বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণের বিষয়। কাজেই সরকারের সঙ্গে যদি ইইউয়ের কোনো টানাপড়েন থেকেই থাকে তার প্রকাশ অন্যভাবে হতে পারত। স্মৃতিসৌধে না যাওয়াটা কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না।

জানা যায়, রাজনৈতিক অচলাবস্থা যখন চরমে তখন দুই দফা দুই নেত্রীকে জাতিসংঘ মহাসচিব ফোন করার পাশাপাশি তার দূত রাজনীতিবিষয়ক সহকারি মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে ঢাকায় পাঠান। তারানকো পাঁচ দিন বাংলাদেশে অবস্থান করে কোনো সফলতা পাননি। এমন গুঞ্জনও রয়েছে যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শেষ দুই দিন তারানকো চাইলেও দেখা দেননি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্য তারানকো তার সফর নির্ধারিত সময়ের চেয়ে একদিন বাড়ান। তারপরও দেখা পাননি।

তারানকোর সফরের শেষ দিনে হোটেল সোনারগাঁওতে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিক তার কাছে জানতে চান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নির্ধারিত সাক্ষাৎ কে বাতিল করেছে? আপনি না প্রধানমন্ত্রী? এসময় তারানকো সরাসরি কোনো মন্তব্য না করে বিষয়টি এড়িয়ে যান। তবে তিনি এও বলেন যে তার সফরের বিষয়টি তিনি নিউইয়র্কে ফিরে গিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনকে রিপোর্ট করবেন। জানা যায়, কয়েকদিনের মধ্যেই বান কি মুনকে সব জানাবেন তারানকো।

তারানকো ঢাকায় থাকতেই প্রধানমন্ত্রীকে আরেক দফা ফোন করেন বান কি মুন। তারানকোর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ যখন হচ্ছিল না, যখন প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের জন্য তারানকো তার সফর একদিন বাড়ালেন তখনই বান কি মুন প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেছিলেন। তখন বান কি মুন শুধু প্রধানমন্ত্রীকেই ফোন করেছিলেন। খালেদা জিয়াকে করেননি।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সূত্র উল্লেখ করে সংবাদ মাধ্যমে তখন খবর বের হয় যে সংলাপের ব্যাপারে তারানকোকে ‘সহযোগিতা’ করায় বান কি মুন ফোন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। বান কি মুন যেদিন ফোন করেন সেদিন এক দফা প্রধানমন্ত্রীকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিও ফোন করেন।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, প্রায় দেড় বছর মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। এসময় বারবার বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে মজীনার বৈঠক হলেও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হয়নি। দেড় বছর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন মজীনা। মজীনা এমন একটা সময়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন যখন বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের টানাপড়েন প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে।

(দ্য রিপোর্ট/জেআইএল/এইচএসএম/ডিসেম্বর ১৭, ২০১৩)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

বিশেষ সংবাদ এর সর্বশেষ খবর

বিশেষ সংবাদ - এর সব খবর