thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১,  ২১ জমাদিউল আউয়াল 1446

আলোচিত ১০ ঘটনা

২০১৩ ডিসেম্বর ২৭ ২০:২০:১৪
আলোচিত ১০ ঘটনা

ঘটনাই কালের বাহন। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার গাঁথুনিতে গড়ে ওঠে মহাকাল। ঘটনার কোনো কোনোটি হয়তো হৃদয় বিদীর্ণ করা মর্মান্তিকতায় পূর্ণ, কোনোটি জীবনের জয়গানে অনিঃশেষ আনন্দে উদ্বেল, কোনোটি বা চূড়ান্ত বিতর্কের বৈশিষ্ট্যে স্থান করে নেয় ইতিহাসে।

২০১৩ সালের এমনই ১০ ঘটনায় সাজানো এই প্রতিবেদন :

রানা প্লাজা ধস ও রেশমাকে উদ্ধার

বছরের শুরুতে ঘটে যাওয়া রানা প্লাজা ধস বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের ইতিহাসে একটি বড় দুর্ঘটনা। চলতি বছরের ২৪ এপ্রিল সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে রানা প্লাজা নামের নয়তলা ভবন ধসের মর্মান্তিক এ ঘটনা ঘটে। আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত হয় এ দুর্ঘটনা।

ধসের ঘটনায় এক হাজার ১৩৪ জনের লাশ উদ্ধার হয়। ৩২২ মৃতদেহের কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। তাদের বেওয়ারিশ হিসেবে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। পরবর্তীতে ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক এসিড) পরীক্ষার মাধ্যমে ১৫৭ জনের পরিচয় মেলে।

এটা বিশ্বের ইতিহাসে তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এই ঘটনায় দুই হাজারেও বেশি মানুষ আহত হয়। ঘটনার পরদিন একদিনের জাতীয় শোক পালন করা হয়। ভবনটির মালিক সোহেল রানা সাভার পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন।

২৫ এপ্রিল ঢাকা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ভবন ও ওই ভবনের গার্মেন্টস মালিকদেরকে অভিযুক্ত করে একটি মামলা করেন। এই দুর্ঘটনার কারণ তদন্ত করতে সরকারিভাবে আলাদা কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী এই ঘটনায় দায়ীদের দ্রুত গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। ২৭ এপ্রিল এই ভবনের দুটি গার্মেন্টসের মালিককে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া সাভার পৌরসভার দুজন প্রকৌশলীকেও গ্রেফতার করা হয়। ২৮ এপ্রিল এই ঘটনায় দায়ী ভবন মালিক সোহেল রানাকে বেনাপোল সীমান্ত থেকে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় র‌্যাব গ্রেফতার করে।

সাভারের রানা প্লাজা ধসের সঙ্গে আলোচিত হয়ে আছে রেশমা নামের এক নারীকে উদ্ধারের ঘটনা। দুর্ঘটনার ১৭তম দিন ১০ মে ধ্বংসস্তূপ থেকে রেশমাকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। সিএমএইচে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হন তিনি। চাকরি পান একটি পাঁচতারা হোটেলে। দেশের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও ফলাও করে প্রচারিত হয় রেশমা উদ্ধারের ঘটনা।

তবে গার্মেন্টস কর্মী রেশমা বেগমকে জীবিত উদ্ধারের ঘটনাকে সাজানো নাটক বলে বর্ণনা করে বিরোধী দল বিএনপি। জাতীয় সংসদে এ নিয়ে এক বিতর্কে বিএনপির এক সংসদ সদস্য ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেন। দেশের একটি পত্রিকার পর লন্ডনের ‘ডেইলি মিরর’-এ প্রকাশিত খবরে দাবি করা হয়, এটি ছিল সাজানো নাটক। তবে উদ্ধার কাজে সরাসরি জড়িত থাকা সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এ অভিযোগ নাকচ করে দেওয়া হয়।

মহাজোট সরকারের পদত্যাগ নাটক

পদত্যাগ নিয়ে মহাজোট সরকার এ বছর আলোচিত ঘটনার জন্ম দিয়েছে। এ পদত্যাগ নিয়ে জন্ম হয়েছে বিতর্কের, সমালোচিতও হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার।

গত ১১ নভেম্বর মহাজোট মন্ত্রিসভার সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তারিখবিহীন পদত্যাগপত্র জমা দেন। এর আগেও কোনো কোনো সদস্য পদত্যাগপত্র জমা দেন। পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে পদত্যাগের আদেশ জারি করার পূর্ব পর্যন্ত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা কাজ চালিয়ে যাবেন।

৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার সকল সদস্যকে এক সপ্তাহের মধ্যে পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন থেকেই বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। একপক্ষ বলেন, বিষয়টি সংবিধানের পরিপন্থি, সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যদি কোনো মন্ত্রী রাষ্ট্রপতির কাছে পেশের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগপত্র দেন সেক্ষেত্রে তার পদ শূন্য হবে। এক্ষেত্রেও পদ শূন্য হয়ে গেছে। তাই মহাজোট মন্ত্রিসভার সদস্যদের আর কাজ করার অধিকার নেই। আরেক পক্ষ বলেছেন, সংবিধান মেনেই এটি করা হয়েছে।

সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী এর আগে তাদের বক্তব্যে জানিয়েছেন, পদত্যাগপত্র জমা দেওয়া সদস্যদের মধ্যে যারা সর্বদলীয় সরকারে থাকবেন তাদের আর নতুন করে শপথ নিতে হবে না। যারা থাকবেন না তাদের পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির কাছে চলে যাবে। সর্বদলীয় সরকারের মন্ত্রিসভায় যারা নতুনভাবে আসবেন তারা শপথ নেবেন। মন্ত্রিসভার সকল সদস্যের পদত্যাগের পর পদত্যাগ নিয়ে বিতর্ক আরো জোরালো হয়।

তখনকার আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী শফিক আহমেদ জানিয়েছিলেন, সংবিধান অনুযায়ী ওইগুলো পদত্যাগপত্র নয়, একটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এতে আরো ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়। এরপর ২১ ডিসেম্বর ১৬ মন্ত্রী ও ১৪জন প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র গ্রহণের প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। একই সঙ্গে ২৯ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। এ মন্ত্রিসভার সদস্যদের দফতরও বণ্টন করা হয় ওইদিন।

বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার রায়

বিশ্বজিৎ দাসকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে এ বছর। গত ১৮ ডিসেম্বরের বহুল আলোচিত মামলার রায় দেওয়া হয়।

দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎকে নৃশংসভাবে হত্যার দায়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আট কর্মীকে মৃত্যুদণ্ড ও অপর ১৩ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪। ফাঁসির আদেশ হওয়া আটজনের মধ্যে দুইজন পলাতক ও যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ১১ জন পলাতক আছেন।

বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় চলতি বছরের ২ জুন অভিযোগ গঠন করা হয়। গত বছরের ৯ ডিসেম্বর বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচির দিন বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে বিএনপির সমর্থক আইনজীবীরা অবরোধের সমর্থনে ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ অবরোধবিরোধী মিছিল করছিল। এসময় একটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটলে ছাত্রলীগের মিছিল থেকে কয়েকজন পথচারী বিশ্বজিৎকে (২৪) ধাওয়া করে। তিনি তখন লক্ষ্মীবাজারের বাসা থেকে শাঁখারীবাজারের দোকানে যাচ্ছিলেন। ধাওয়ার মুখে তিনি পার্কের কাছে দোতলায় একটি ক্লিনিকে আশ্রয় নিলে ছাত্রলীগের কর্মীরা সেখানে তাকে নৃশংসভাবে কোপান ও পেটান। পরে তাকে নিচে নামিয়ে এনে বর্বর নির্যাতন করা হয়। একপর্যায়ে তিনি দৌড়ে শাঁখারীবাজারের রাস্তার মুখে গিয়ে পড়ে যান। রিকশাচালক রিপন তাকে রিকশায় তুলে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে তার মৃত্যু হয়। অমানবিক এ ঘটনাটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। ছাত্রলীগের ভূমিকার কারণে সমালোচনার মুখে পড়ে সরকারি দল।

গণজাগরণ মঞ্চের সৃষ্টি

গণজাগরণ মঞ্চ বছরের আরেক আলোচিত নাম। গত ৫ ফেব্রুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ রায় প্রত্যাখ্যান করে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে জমায়েত হতে থাকে তরুণরা। ব্লগার এন্ড অনলাইন এক্টিভিস্ট নেটওয়ার্কের ব্যানারে এ আন্দোলনের সূচনা হলেও এতে দেশের সমাজকর্মী, সংস্কৃতি কর্মী, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, রাজনীতিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ একাত্মতা ঘোষণা করে শামিল হন। সড়ক অবরোধ, অবস্থান কর্মসূচি, গণসঙ্গীত, প্রতিবাদী গান-বাজনা, সমাবেশ করে ফাঁসির দাবি জানাতে থাকেন তারা।

৮ ফেব্রুয়ারি মহাসমাবেশের ডাক দেওয়া হয় শাহবাগ থেকে। বিপুল সাড়া মেলে এ মহাসমাবেশে। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে অন্য এক ইতিহাসের সৃষ্টি হয় শাহবাগে। ব্লগার এন্ড অনলাইন এক্টিভিস্ট নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক ডা. ইমরান এইচ সরকার ওই মহাসমাবেশে সভাপতিত্ব করেন। শাহবাগে জন্ম হয় গণজাগরণ মঞ্চের। এ আন্দোলনের অগ্রভাগে স্লোগান দিয়ে ‘স্লোগান কন্যা’উপাধি পান লাকী আক্তার।

অনেকে বলে থাকেন গণজাগরণ মঞ্চের দিনের পর দিন আন্দোলনের কারণে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন দণ্ড আপিলের পর মৃত্যুদণ্ডে পৌঁছায় ও শেষ পর্যন্ত তার ফাঁসি কার্যকর হয়।

গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন্যান্য স্থানেও। কিন্তু পরে গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে। শাহবাগ আন্দোলনের নেতাদের ব্লগে নাস্তিক্যবাদী লেখালেখির অভিযোগ তুলেও বিতর্কের সৃষ্টি হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে গণজাগরণের অন্যতম ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভনকে (৩৫) নৃশংসভাবে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

হেফাজতে ইসলামের উত্থান

হেফাজতে ইসলাম ২০১৩ সালের অন্যতম আলোচিত নাম। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে হেফাজতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা হলেও মূলত এ বছরই কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক এ সংগঠনের উত্থান। এ উত্থান বিপুল আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

হাটহাজারী মাদ্রাসার পরিচালক শাহ আহমদ শফী এ সংগঠনের প্রধান। ইসলাম ও রাসুলকে কটূক্তিকারী নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসি দাবি করে ব্যাপক আন্দোলন ও সমাবেশ শুরু করে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের কাছে তারা ১৩ দফা দাবি উত্থাপন করে। হেফাজতে ইসলামের এই দাবির কয়েকটি দফা সমালোচিত হয়।

এ বছরের ৬ এপ্রিল হেফাজতে ইসলাম সারা দেশ থেকে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ করে এবং ঢাকার মতিঝিল শাপলা চত্বরে তাদের প্রথম সমাবেশ করে। এই সমাবেশে প্রচুর লোক সমাগম হয়। এরপর ৫ মে হেফাজতে ইসলাম ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি এবং ঢাকার মতিঝিলে তাদের দ্বিতীয় সমাবেশের আয়োজন করে। ৫ মে ঢাকার মতিঝিলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে এই সংগঠনের কর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষে বহু হেফাজতকর্মী, পুলিশ, বিজিবি সদস্যসহ মোট ৪৭ জন নিহত হয় এবং সাংবাদিকসহ আরও অনেকে আহত হয়। ঢাকা অবরোধের দিন হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা মতিঝিল, পল্টন, জিরো পয়েন্ট, গুলিস্তান, দৈনিক বাংলার মোড় ও আশপাশের এলাকায় বহু প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। বায়তুল মোকাররম এলাকায় ফুটপাতের দোকান ও অন্যান্য বইয়ের সঙ্গে কোরান শরিফ পোড়ানোরও অভিযোগ আনা হয় হেফাজতের বিরুদ্ধে।

৫ মে কর্মসূচি শেষে শাপলা চত্বরে অবস্থানের ঘোষণা দেয় হেফাজত। গভীর রাতে হেফাজতের কর্মীদের মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা থেকে সরানোর উদ্দেশ্যে সরকারি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আক্রমণ পরিচালনা করে। পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির সদস্যরা এতে অংশগ্রহণ করে। এছাড়া এই অভিযান পরিচালনার আগেই স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিরোধী দল বিএনপি ও হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, ৫ মে শাপলা চত্বরে গভীর রাতে সরকারি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী হেফাজতে ইসলামের হাজার হাজার কর্মীকে হত্যা করে লাশ গুম করেছে। তবে পুলিশ ও সরকারের পক্ষ থেকে হাজার লোক গুমের এই দাবিকে সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বিশেষ উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে উল্লেখ করা হয়।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের সম্পৃক্ততারও অভিযোগ ওঠে। এক বক্তৃতায় নারীদের তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করে ব্যাপক সমালোচিত হন শাহ আহমদ শফী।

কাদের মোল্লার ফাঁসি

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি ছিলো বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা। বিভিন্ন নাটকীয় ঘটনার পর গত ১২ ডিসেম্বর রাত ১০টা ১ মিনিটে কেন্দ্রীয় কারাগারে তার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়।

চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লাকে মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধের জন্য আনীত ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটিতে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। এই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম হয় শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ রেখে ১৭ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস (সংশোধন) বিল, ২০১৩ জাতীয় সংসদে পাস হয়। ৩ মার্চ রাষ্ট্রপক্ষ তার সর্বোচ্চ শাস্তির আবেদন করে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করে এবং ৪ মার্চ কাদের মোল্লার পক্ষ থেকে রায়ের বিরুদ্ধে তাকে খালাস দেওয়ার জন্য আপিল করা হয়। শুনানি শেষে ১৭ সেপ্টেম্বর সর্বোচ্চ আদালত মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পরিবর্তে মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দেন।

গত ১০ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু সাংবাদিকদের ওইদিনই মধ্যরাত বারোটার পর কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার কথা জানান। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সব প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে বলে জানায় কারা কর্তৃপক্ষ। ওই রাতেই কাদের মোল্লার আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের সঙ্গে দেখা করেন। রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন জমা দেওয়ার পর বিচারপতি মাহমুদ হোসেন ১১ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে দশটা পর্যন্ত দণ্ড কার্যকর করা স্থগিত করেন। ১১ ডিসেম্বর দুই দফায় শুনানির পর ১২ ডিসেম্বর সকালে শুনানির জন্য সময় নির্ধারণ করেন প্রধান বিচারপতিসহ পাঁচ সদস্যের একটি বেঞ্চ। এই বেঞ্চ রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ করে দেয়। এরপর ওই দিনই রাতে ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিতদের ভরাডুবি

এ বছর পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আলোচিত এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়। ৫ সিটিতেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছে।

পাঁচ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে বিএনপি-সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা জয়ী হন। তাদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বিরা সবাই ছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী এবং নিজ নিজ সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ মেয়র। এ নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ ছিল। সরকারের শেষ বছরে এ নির্বাচনের ফলাফলকে জাতীয় নির্বাচনের ফলের গতিবিধির ইঙ্গিত হিসেবে মন্তব্য করেছিল অনেকে।

বছরের ১৫ জুন রাজশাহী, সিলেট, খুলনা ও বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সিলেটে বিএনপি প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী বিপুল ব্যবধানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরানকে পরাজিত করেন। বরিশালে বিএনপির প্রার্থী আহসান হাবিব আওয়ামী লীগের শওকত হোসেন হিরনকে পরাজিত করেন। রাজশাহীতে বিএনপি প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন জয়ী হন। এখানে তার কাছে হেরে যান আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান। খুলনায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেককে পরাজিত করে বিএনপির মনিরুজ্জামান জয়ী হন।

এরপর ৬ জুলাই নবগঠিত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগের দুর্গখ্যাত গাজীপুরেও পরাজয়ের একই পরিণতি বরণ করতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। গাজীপুরে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী এম এ মান্নান জয়ী হন। এখানে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী আজমত উল্লা খান পরাজিত হন।

পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংককেনা

নানা নাটকীয়তা ও টানাপোড়েনের পর এ বছরই বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নে বিশ্বব্যাংককে না করে দেয় সরকার। পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের অনুরোধ আনুষ্ঠানিকভাবে ফিরিয়ে নেয় বাংলাদেশ।

১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাংকের এক বিবৃতিতে এ প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার কথা জানানো হয়। তবে পদ্মা প্রকল্পে দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠেছে, সে বিষয়ে তদন্ত চালিয়ে যাবে বলে বিশ্বব্যাংককে জানায় সরকার।

২৯০ কোটি ডলারের পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলার দেওয়ার কথা ছিল। এছাড়া এডিবি ৬১ কোটি, জাইকা ৪০ কোটি ও আইডিবি ১৪ কোটি ডলার দেওয়ার জন্য চুক্তি করে সরকারের সঙ্গে। কিন্তু কানাডীয় কোম্পানি এসএনসি লাভালিনের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ ওঠার পর ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে চুক্তি স্থগিত করে বিশ্বব্যাংক।

দুদক এরপর তদন্ত শুরু করলেও সরকারের সঙ্গে মতভেদ না কাটায় গত জুন মাসে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করে। এরপর সরকারের নানামুখী তৎপরতায় তারা সিদ্ধান্ত বদলায়। তাদের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সাবেক প্রসিকিউটর লুইস গাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্যানেল দুদকের তদন্ত পর্যবেক্ষণে দুই দফা ঢাকা সফর করে।

দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়ার পর অনুসন্ধান পর্যায়ে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান, সাবেক সেতু সচিব মোঃ মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াসহ ২৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুর্নীতি দমন কমিশন। তবে গত বছর ১৭ ডিসেম্বর ‘ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগে দুদক সাত জনের বিরুদ্ধে যে মামলা করে তাতে আবুল হোসেন ও আবুল হাসানের নাম বাদ দেওয়া হয়।

দুই নেত্রীর ফোনালাপ

দুই নেত্রীর ফোনালাপ ছিলো এ বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা। ২৬ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফোন করেন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে। তারা ৩৭মিনিট কথা বলেন। রাজনৈতিক অস্থিরতায় দু’দলের সমঝোতার বিষয়টি যখন আলোচিত হচ্ছিলো তখনই হলো বহু আকাঙ্ক্ষিত ফোনালাপ। দু’একদিন পরই পুরো ফোনালাপ ছড়িয়ে পরে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম, ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক প্রচারমাধ্যমে।

চার বছর পর দুই নেত্রীর কথা হলেও কথোপকথনে ছিলো সাধারণ সৌজন্যবোধের অভাব।

কথোপকথনের পুরোটা সময় খালেদা জিয়া মেজাজ নিয়ে উচ্চকণ্ঠে কথা বলেছেন। তবে খালেদা জিয়ার কণ্ঠে দৃঢ়তা ছিল। শেখ হাসিনার কথা ঠাণ্ডা এবং নিচুস্বরে হলেও নানা অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা করায় সমালোচিত হয়েছেন তিনিও। দুই নেত্রীর ফোনালাপ দেশজুড়ে বিপুল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।

বিডিআর বিদ্রোহের রায়

বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) বিদ্রোহের রায় ঘোষণা করা হয় ২০১৩ সালে। ইতিহাসের নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের রায় ঘোষণা করা হয় গত ৫ নভেম্বর। বিদ্রোহে সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার ঘটনায় আদালত ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। একই মামলায় আরও ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পুরোনো ঢাকার আলীয়া মাদ্রাসা মাঠ সংলগ্ন এক স্কুল ভবনের বিশাল একটি কক্ষে স্থাপিত বিশেষ আদালতে এ রায় ঘোষণা করা হয়। কোনো মামলার রায়ে একসঙ্গে এত মানুষের মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিষয়টি পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) সদর দফতরের ভেতরে ওই বিদ্রোহে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ অন্তত ৭৪ জন নিহত হন। বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার মাত্র দেড় মাসের মাথায় এই বিদ্রোহের ঘটনা সরকারকে এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছিল। এই বিদ্রোহের পর বিডিআর ভেঙে দিয়ে এই বাহিনী পুনর্গঠন করা হয়। বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর নতুন নাম রাখা হয় বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশ (বিজিবি)।

(দ্য রিপোর্ট/আরএমএম/এইচএসএম/নূরুল/ডিসেম্বর ২৭, ২০১৩)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

বিশেষ আয়োজন এর সর্বশেষ খবর

বিশেষ আয়োজন - এর সব খবর