দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে রবিবার। প্রধান বিরোধী দলহীন ম্রিয়মাণ উৎসব ও ভোটারদের অনাগ্রহের মধ্যে এ নির্বাচকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন না কোনো স্তরের মানুষই। ‘কি হয়, কি হয়’ আতঙ্কের কারণে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার অনাগ্রহের কথা জানিয়েছেন ভোটাররা।

তাদের কেউ কেউ বলছেন, ভোটগ্রহণের প্রাথমিক পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেবেন ভোট দিতে যাবেন কিনা।

তবে বিশিষ্টজনেরা বলছেন, এ নির্বাচন আমাদের আরও বড় সংকটের মধ্যে ফেলবে। দেশে ও দেশের বাইরে তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। একই সাথে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের নৈতিক ভিত্তি থাকবে না।

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি আদায়ে বহুদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট।

কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারে আর ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই বলে বিরোধী দলের এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে আসছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার।

এ দিকে রবিবারের নির্বাচনে ভোট না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিরোধী দল নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা দিয়েছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার দ্য রিপোর্টকে বলেন, রবিবার নির্বাচন হবে ভোটারবিহীন, স্বল্পসংখ্যক প্রার্থী ও স্বল্পসংখ্যক দল নিয়ে একটি অগ্রহযোগ্য নির্বাচন। শুধু তাই নয়, অনেকে প্রার্থী আছেন যারা নির্বাচন করারই যোগ্য নন। এদের সঙ্গে সরকারের ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে। আবার সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত অনেকে সংবিধান লঙ্ঘন করে বিভিন্ন ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছেন। তাদের অনেকেই বিতর্কিত।

বদিউল আলম আরও বলেন, যারা প্রার্থী হয়েছেন তাদের নিয়ে যে সংসদ গঠিত হবে তা দেশে ও দেশের বাইরে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। যে সরকার গ্রহণযোগ্যতা পাবে না, সেই সরকারকে টিকে থাকতে হলে বল প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাস বার বার শিক্ষা দেয়, নৈতিক অবস্থান দুর্বল থাকা কোনো সরকারই টিকে থাকতে পারে না। এ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার হবে একটি অস্থিতিশীল সরকার। যা আমাদের আরও সংকটের দিকে ঠেলে দেবে। আমরা একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হব।

বিশিষ্ট রাষ্ট্র বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দিন আহমেদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, রবিবারের নির্বাচনের মাধ্যমে ১৯৯০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে যে গণতন্ত্রের দ্বিতীয় যাত্রা শুরু হয়েছিল সেটা বন্ধ হবে অর্থাৎ একদলীয় সরকারের দিকে অনেক দূর এগিয়ে যাবে। এ সরকারের উদ্দেশ্যও তাই। একদলীয় সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত নয়, কারণ একতরফা নির্বাচন কখনো সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। কোনো দেশে তা হয় না।

এমাজউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, সংবিধানে রয়েছে জাতীয় সংসদের মেম্বার হতে হলে ভোটারদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হতে হবে। কিন্তু ইতোমধ্যে ১৫৪ জনের মতো ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হয়েছেন। ১৪৬ জনের জন্য নির্বাচন হবে। এদের নিয়ে গঠিত সংসদ কি ধরনের সংসদ হবে! এটা সংবিধান অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য নয়।

তিনি আরও বলেন, দেশের ভেতরে কেউ এ নির্বাচনকে গ্রহণ করবে না, আমাদের আশঙ্কা দেশের বাইরেও কেউ এটাকে স্বীকৃতি দেবে না। ভোটারদের মধ্যে যেমন আগ্রহ নেই, যেখানে ভোট হচ্ছে সেখানকার প্রার্থীরা এলাকায় ঠিক মতো যাচ্ছেন না। এটাকে প্রহসনের নির্বাচন বলা ভালো, এটাকে আমরা সেভাবেই দেখছি।

বুয়েটের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এএমএম শফিউল্লাহ দ্য রিপোর্টকে বলেন, রবিবারের নির্বাচন নিয়ে আমি খুবই উদ্বিগ্ন। আসলে আমরা কোথায় যাচ্ছি? এমন ঘটনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি যেখানে জনগণের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

তিনি বলেন, ভোটারদের নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ নেই, কারণ কোথাও প্রার্থী না থাকায় ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হয়ে গেছেন অনেকে। এখন তো আমাদের মতামত দেওয়া সুযোগ নেই। সব মিলিয়ে বিষয়টি ভালো নয়, এটা বলা যায়।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ও ঢাকার বাইরে নানা স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বললে তারা রবিবারের নির্বাচন নিয়ে মতামত জানিয়েছেন। রাজধানীর মাতুয়াইল কবরস্থান রোডের বাসিন্দা ইসমাইল মৃধা (৫৫) বলেন, ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার ইচ্ছা নেই। আমার স্ত্রীও ভোটার, সেও ভোট দিতে যাবে না বলে জানিয়েছে।

যাত্রাবাড়ী মালঞ্চ কমিউনিটি সেন্টারের সামনে চটপটি বিক্রি করেন মো. ওলি (৪০)। ভোট দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এইবার তো মামা অন্যরকম। ভাও বুইজা ঠিক করমু, ভোট দিতে যামু কী যামু না।

যাত্রাবাড়ী থানার শনিরআখড়া গোবিন্দপুর বাজারের সুবর্ণা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মালিক অমূল্য চন্দ্র দত্ত সুজিত (৩০) ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে জানান, সিদ্ধান্ত নিয়েছি জীবনে আর ভোটই দেব না। কারণ ভোট দিয়ে যাদের নির্বাচিত করি, তারা আমাদের শোষণ করে। ভোট দিয়ে এদের অপকর্মের দায় আমি কেন নেব।

ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টারের হাজীনগর এলাকার গৃহিনী শামীমা বেগম (৩৮) বলেন, নানা কথা শুনছি। ভয় পাচ্ছি, আশপাশের লোকজন গেলে আমিও ভোট দিতে যাব।

পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার মাছুয়াখালী গ্রামের স্কুল শিক্ষক মো. আবদুল গাফফার (৪০) বলেন, সবার মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। নারীরা ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার কথা চিন্তাই করছে না। আমারও ভোট দেওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই।

ঝিনাইদহ সদরের ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান রুপম (৩৫) বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, কি বলেন ভাই এ অবস্থায় ভোট দিতে যাব। বর্তমান পরিস্থিতিতে এবার ভোট দেওয়ার কথা চিন্তা করছি না।

(দ্য রিপোর্ট/আরএমএম/এসবি/সা/জানুয়ারি ০৪, ২০১৪)