তাওফীক আল্-হাকীমের উপন্যাস
লায়লাতুয্ যিফাফ্
তরজমা : ড. এম এ মোত্তালিব
(এক)
মাঝরাতে বর-কনের নির্মল জুটিকে ঘিরে আনন্দ-উল্লাসরত বরযাত্রীর দল প্রস্থান করে। মায়া-কান্নার কিছু নোনা অশ্রু বিসর্জনের পর বর-কনেকে সুসজ্জিত নির্জন কক্ষে দেওয়া হয়। বিয়ে বাড়ির ঝুট-ঝামেলা থেকে তাঁদের জন্য ব্যবস্থা করা হয় একান্ত নির্জনতার। সদ্য বিবাহিত বর-কনের জন্য ওই মুহূর্তটি অতিক্রম করার কি-যে অনুভূতি তার কোনো দৃষ্টান্ত হয় না। সারাজীবনের দীর্ঘ সময়ের মাঝে ওই মুহূর্তটি যেন উজ্জ্বল মুক্তার ন্যায় আলো ছড়ায়। স্বাভাবিকভাবে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জীবনেই এ সময়টি অবধারিত।
রাজা-বাদশা থেকে শুরু করে হতদরিদ্র, ফকির, নিঃস্ব সকলের জীবনেই এ মুহূর্তটি স্মরণীয়। এ সময়েই মানুষ কৃপণতার লাগাম ছিন্ন করে তার ইচ্ছে মতো খরচ করে। বর-কনের বিয়ে অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী, পরিচিত-অপরিচিত ও সুধীজনদের এক মহামিলন মেলা বসে। সেই সাথে আয়োজন হয় এক বিশাল আপ্যায়ন অনুষ্ঠানের। বাদ্যযন্ত্রের তালে-তালে বিয়েবাড়ির সবাই মেতে উঠে অন্তরঙ্গ আলাপে। গ্রামীণ গীতের ছন্দে হেলে-দুলে নাচতে থাকে নর্তকির দল। উপস্থিত সকলেই আনন্দ-ফুর্তির মহাসমুদ্রে ভাসতে থাকে।
এ সবের মধ্য দিয়েই সমাগত হয় কাঙ্ক্ষিত সে মুহূর্তটি। মানবজীবনে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত যে মুহূর্তকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয় বিনিদ্র নৈশ সমাবেশ ও এত সব আয়োজন। তা হল বিনা সুতার বাঁধনে আবদ্ধ দুটি অপ্রস্ফুটিত গোলাপের মিলন। বর-কনের নির্মল জুটির নির্জন ঘরে অবস্থান। ....আহ ! সে-কি এক স্মৃতিময় ক্ষণ ! স্মরণীয় মুহূর্ত !
বিয়ের পিঁড়িতে বসা সব দম্পতিরই জানা আছে, এ সময় প্রতিটি বর-কনে সাময়িকভাবে কেমন হতভম্ভ হয়ে পড়ে। প্রত্যেকের মাথায় একই চিন্তা ঘুরপাক খায়। কী বলে একে অপরকে সম্বোধন করবে। তাই ক্ষণিকের তরে তারা উভয়েই কিঞ্চিৎ আলাদা থেকে লাজুকতা প্রকাশ করে। আর ভাবে বাসর-রাতের বাস্তব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন দাদি-নানির শেখানো কথার মাধ্যমে কী এ নীরবতা ভঙ্গ করবে? না-কি রসিকতার মাধ্যমে? না হৃদয় নিংড়ানো আবেগ-আপ্লুত কোনো কথা দিয়ে? তবে এ কথা সবার জানা- সব কনেই মনে মনে ভাবে ও অপেক্ষা করতে থাকে বাসর রাতের প্রথম কথাটা তার জীবন সঙ্গীর মুখ থেকেই বের হোক।
এমনি এক বাসর রাতে নব দম্পতির মাঝে নীরবতা ভঙ্গের অপেক্ষার পালা চলতে থাকে। বর বাসরঘরের দরজা বন্ধ করে। কনে সুসজ্জিত খাটে না গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে। লুকিয়ে রাখে তার চাঁদবরণ মুখখানা কোমল মসৃণ হাতের তালুর মাঝে। বসেছে তো বসেছে আর ওঠার কোনো লক্ষণ নেই। বর অপলক নেত্রে কনের এ দৃশ্য দেখতে থাকে। কাছে গিয়ে বলে :
প্রিয়তমা! তোমার কি খারাপ লাগছে? আমার মনে হয় বিয়ে অনুষ্ঠানের এ শোরগোল তোমাকে অস্থির করে তুলেছে। কনে কোনো উত্তর দেয় না। দু’হাতের মাঝে লুকানো মুখ তুলে একবার বরের দিকে তাকিয়েও দেখে না। কিন্তু কনের কোমল মসৃণ লকলকে ডগার ন্যায় আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে অশ্রুর ফোঁটা গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য বরের দৃষ্টি এড়ায় না। অশ্রুর ফোঁটা গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে বাসর রাতে পরিহিত বিয়ের ঝলমলে বসনে।
সমবেদনা ও ভালোবাসার আবেগে আপ্লুত হয়ে বর কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে :
সোনিয়া ! তোমার চোখে পানি ! তুমি কাঁদছ ?
কিন্তু এতেও কনের পক্ষ থেকে মৃদু ফোঁপানীর শব্দ ছাড়া কিছুই শুনতে পায় না। বর নিজেও তার জন্য ব্যথিত হয়। কেননা, এর কারণ তার জানা। সোনিয়া তার মায়ের একমাত্র আদরের দুলালী। বেশ কয়েক বছর আগে সে তার পিতাকে হারিয়েছে। একমাত্র স্নেহময়ী মাকে ছেড়ে আসাই তার এ কষ্টের কারণ। যে মায়ের আঁচল ছিল তার প্রশান্তির ঢাল। যার কাছে তার সকল আবদার ছিল অতি স্বাভাবিক। তাকে ছেড়ে আসা কষ্টেরই বটে। বিশেষ করে জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ে অনুষ্ঠানের বিশাল আয়োজন তার মনে আরও বেশি দাগ কাটে। এ জন্যই হয়ত বিয়ে অনুষ্ঠান চলাকালীন সারাক্ষণ সে ছিল একেবারে নীরব। মাঝে মধ্যে দু’একটা কথাবার্তা। কিঞ্চিৎ মুচকি হাসি ছাড়া তাকে তেমন উৎফুল্ল দেখা যায়নি। বর তার ক্লেশ কাটাতে সমবেদনা জানায়। ভালোবাসার আবেগে কনের কোমল কেশাবৃত মাথার সাথে নিজের গাল ছোঁয়ে আদর ও মায়া জড়িত কণ্ঠে বলে : সোনিয়া! লক্ষ্মীটি আমার কেঁদো না। এখন থেকে আমিই তোমার জন্য বাপ-মা-ভাই-বোন ও স্বামীর দায়িত্ব পালন করব। তোমার অনুভবই হবে না আপন কাউকে হারানোর বেদনা। কিংবা বুঝতেই পারবে না যে আপন কারও স্নেহ-ভালবাসা ও আদর-যত্ন থেকে বঞ্চিত হয়েছ।
কিন্তু কনে তার কোমল কেশাবৃত মাথাটা তার গালের ছোঁয়া থেকে সরিয়ে নেয়। মুখে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারে না। চাপা কান্নার অশ্রুধারা তার বাকশক্তিকে রুদ্ধ করে দেয়। বর তাড়াতাড়ি কনেকে সামলানোর জন্য মোলায়েম সূরে বলে :
-ঠিক আছে তোমাকে কিছুই বলতে হবে না...! আমি জানি তুমি কী বলতে চাচ্ছ...। শোকাহত বুকে জমানো বেদনা লাঘবের জন্য তুমি তোমার অশ্রু ঝরাও, চেপে রেখ না। এটা প্রকৃতিরই নিয়ম। মাত্রাতিরিক্ত অশ্রুপাতে তোমার টানা টানা ভ্রূ বিশিষ্ট হরিণীর ন্যায় চোখ দু’টিতে যদি কালো রেখা পড়ার আশংকা না করতাম তবে তোমাকে বাধা দিতাম না। বরং এ অবস্থায় প্রাণ খুলে কাঁদায় মন হালকা হয়। কিছুক্ষণ পর তুমি প্রশান্তি অনুভব করবে। তোমার চেহারার উজ্জ্বলতা ফুটে উঠবে। মনে হবে চৈত্রের দীর্ঘ খরতাপে এক পশলা বৃষ্টিপাত যেমন সূর্যের কিরণকে নির্মল করে তেমনি তোমার চেহারার সকল মলিনতা কেটে লাবণ্য ফুটে ওঠছে।
বরের কথাগুলো কনের শরীরে এক অজানা তরঙ্গের সৃষ্টি করে। তার চিন্তা জগতে তুমুল ঝড়ের সৃষ্টি হয়। কনে অন্তরে সাহস সঞ্চার করে অশ্রুঝরা চোখে বলে :
- আমি একটা বিষয় আপনার কাছে স্পষ্ট করতে চাই। অনুগ্রহ করে আপনি কি আমাকে সে সুযোগটুকু দিবেন?
- অবশ্যই, কেন দিব না প্রিয়া! লক্ষ্মীটি আমার। বেশ- বল। তোমার মনে যা কিছু আছে নিঃসংকোচে আমার কাছে খুলে বল। আরও আমরা এখন স্বামী-স্ত্রী না ...? এখন আমাদের কারোরই উচিৎ হবে না জীবন সঙ্গীর কাছে কোনো কিছু গোপন করা।
- কনে সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে বলে- হ্যাঁ, অবশ্যই। আপনার কাছে সব কিছু খুলে বলাই আমার উচিত। আমি আশা করি, আমার এ খুলে বলায় আপনি মনে কষ্ট নিবেন না বা রাগ করবেন না : ‘আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি’ ।
কনে তার এ কথাটি অতিদ্রুত ও জোড়ালো কণ্ঠে ব্যক্ত করে আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। কনের উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ যেন বরের কানে ক্ষেপনাস্ত্রের ন্যায় আঘাত করতে থাকে। ক্ষণিকের তরে তাকে বিমর্ষ ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে ফেলে। ফলে বর ব্যথা-বেদনা কিংবা রাগ-ক্রোধ কিছুই অনুভব করতে পারল না। ঠাহর করতে পারল না তার নিজের ও চারপাশের কোনো কিছুই। এমনকি ক্রমে ক্রমে যৌবনে পদার্পণ করার স্মৃতিময় দিনগুলোর কথাও এই মুহূর্তে তার মনে পড়ছে না। কানে ভেসে আসা শব্দগুলো বার বার তাকে বিচলিত করে তোলে। বর ভাবতে থাকে এ মুহূর্তে তার কী করা উচিত। সে তো ছত্রিশ বছর বয়স্ক একজন সুস্থ-সবল ও জ্ঞানসম্পন্ন সুঠাম যুবক।
মর্যাদা ও অবস্থান অনুযায়ী যে কোনো বিষয়ের সাথে খাপ খাওয়ানোর অভিজ্ঞতা তার আছে। কাজেই অতিদ্রুত নিজেকে সামলে নেয়। তিক্ততা মিশ্রিত মৃদু ভর্ৎসনার সূরে কনেকে বলে :
- বিয়ের ক্ষণকাল পরেই যে এ বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়বে, সেটা কি তোমার আগে জানা ছিল না? বিয়ের প্রস্তাবের দিন থেকে শুরু করে, কথা পাকাপাকি, এমনকি আকদ অনুষ্ঠানের অল্প কিছুক্ষণ আগেও বিষয়টি প্রকাশ করতে কি তোমার কোনো বাঁধা ছিল ?
- আমার অসহায় মায়ের সন্তুষ্টির জন্য বিবাহ বন্ধনের এ চূড়ান্ত পর্ব পর্যন্ত উপনীত হওয়া আবশ্যক ছিল। আমি যখনই আমাদের এ বিয়ের প্রস্তাব বাতিল করার জন্য তার সম্মতি নিতে চেষ্টা করেছি, তখনই তাকে পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টি জীবের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অসহায় ও হতভাগী বলে মনে হয়েছে। কেননা আমাকে আপনার মতো ভদ্র-সভ্য ও সুঠামদেহী পুরুষের বউ হিসেবে দেখাই তার একমাত্র আশা ও দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন। বলতে পারেন এ ক্ষেত্রে আমার দুর্বল সাহসিকতাই আমার সাথে প্রতারণা করেছে। আমি তার মুখের দিকে চেয়ে তার লালিত স্বপ্ন ও দীর্ঘ দিনের আশাকে অবজ্ঞা করতে পারিনি। সাহস হয়নি সব কিছু উপেক্ষা করে বাস্তব কোনো পদক্ষেপ নিতে। আমি জানি আমার মা একজন বয়বৃদ্ধা-দুর্বল-রোগাক্রান্তা মৃত্যুপথযাত্রী। তাই আমি আমার ভালোবাসাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেওয়ার বহু চেষ্টা করেছি। ভালোবাসার আবেগকে চেপে রাখতে কত যে চেষ্টা করেছি- তা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। আমি আমার মনকে বুঝাতে চেষ্টা করেছি- বিয়ের পর অতীতের সব কিছুই শেষ হয়ে যায়। মনে হতো অন্তর আমার এ বাস্তবসম্মত আহ্বানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিচ্ছে। নানা জল্পনা-কল্পনার মধ্যদিয়ে দিনের শেষে রাত আসে। রাতের আগমনে দিনের সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তখন আর আমার পাগল মনকে কোনো মতেই বুঝাতে পারি না। এভাবেই বিষয়টি এতদূর পর্যন্ত গড়িয়েছে।
শেষ পর্যন্ত আপনার সাথে আমার সত্যিই বিয়েও হয়ে গেল। কিন্তু হলে কি হবে। বিয়ের পর আমার অন্তরের আর্তনাদ আরও তীব্র হয়ে ওঠেছে। অন্তরের করুণ আহাজারীর স্পষ্ট সুর আমি শুনতে পাচ্ছি। অজানা এক যন্ত্রণা প্রতিক্ষণে আমাকে বিচলিত করে তুলছে। আমাকে জ্বলে-পুড়ে ছারখার করে দিচ্ছে ভালোবাসার এ জলন্ত অঙ্গার। আমি এখন নিশ্চিত। মনের সাথে প্রতারণা করে অতীতকে ভুলে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আর আপনার মতো একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে এ প্রতারণার সাথে জড়ানোও উচিত হবে না।
কনে কান্না বিজড়িত কণ্ঠে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কথাগুলো বলতে থাকে। হিক্কা ওঠায় বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। ক্ষণিকের তরে বরও নীরব-নিথর হয়ে পড়ে। ভাবতে থাকে, ছাইচাপা এ কোনো তুষের আগুন তাকে পেয়ে বসল। নিজেকে সামলে নিয়ে শান্তভাবে বলে :
- তুমি নিশ্চিন্তে এগিয়ে চলো। কোনো প্রকার পঙ্কিলতা যেন তোমার এ অভিযানকে ভেস্তে না দেয়। আমার বিশ্বাস তোমার এ মনস্কামনা সফল হবেই। বিষয়টির চূড়ান্ত সমাধানে প্রয়োজনে আমিও তোমার পাশে থেকে সহযোগিতা করে যাব। সত্য তোমার সঙ্গী। নিজের সাথে প্রতারণা করার কোনো প্রয়োজন নেই। তোমার অন্তরে অব্যক্ত যে সুর অনুরণিত হচ্ছে তাতে সাড়া দাও। তোমার এ ভালোবাসা চিরন্তন-অবিচল ও নির্মল। এতে হস্তক্ষেপ করার অধিকার কারও নেই। এখনি- এই মুহূর্ত থেকে আমিও তোমার পূর্ণ স্বাধীনতাকে তোমার হাতেই অর্পণ করলাম। আমি নিজেকেও তোমার সার্বিক সহযোগিতায় নিয়োজিত করছি। সুতরাং দু’জনে মিলেই বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করব। কীভাবে আমরা এ সংকটময় অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারি, সেটাই কি এখন প্রধান বিষয় নয় ? হতে পারে আজকে রাতেই আমি তোমাকে তালাক দিয়ে বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিলাম; কিন্ত এতেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? বরং তা হবে তোমার জন্য এক মহাকলঙ্ক। যা কখনই তোমার জন্য সুখকর হবে না। শুধু তাই নয় বিষয়টি চারিদিকে নানা কথা, নানা গুঞ্জন ও রটনার উৎসে পরিণত হবে- যা আর শেষ হবার নয়। উপরন্তু তোমার বৃদ্ধা মায়ের জন্য এটা হবে এক চরম আঘাত। যে মায়ের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে, তার কষ্ট লাঘব করতে এত কিছু করছ। এখন বল দেখি, এ মুহূর্তে আমরা কি করতে পারি? তুমিও আমার সাথে একটু ভেবে দেখ।
- ঠিকই বলেছেন। আমিও বুঝতে পারছি- আজ রাতেই আমাকে তালাক দেওয়াটা কত বড় কলঙ্ক।
- কাজেই আমাদের উচিত অন্য কোনো বিকল্প পথ বের করা। তুমিও উত্তম কোনো উপায় সন্ধান কর।
- হ্যাঁ । অবশ্যই- আমিও তাই ভাবছি।
তারা দু’জনেই বসে বসে ভাবতে থাকে। বর তার দু’হাতের মাঝে মাথা গুঁজে গভীর ভাবনায় বিভোর।
অবশেষে বর লাফিয়ে ওঠে। উচ্চ কণ্ঠে মৃদু চিৎকার দিয়ে বলে:
- পেয়েছি! পেয়ে গেছি! আমি একটা উপায় পেয়ে গেছি। এতেই ভালো একটা সমাধান বেরিয়ে আসতে পারে। থাকতে পারে কল্যাণ। তবে এতে কিন্তু তোমাকে এক চরম ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। আর আমাকে পালন করতে হবে এক অবিশ্বাস্য অভিনয়ের ভূমিকা।
তা হল- আমি তোমাকে এক মাস কিংবা দু’মাস পর তালাক দিব। মাঝখানের এ সময়টুকুতে আমি মানুষের সামনে এবং বিশেষ করে তোমার বৃদ্ধা মায়ের সামনে সব সময় অসৌজন্যমূলক আচরণ প্রকাশ করতে থাকব। আমার আচরণে এমনটাই প্রকাশ পাবে যে, স্বভাবগতভাবেই আমি একজন অসদাচারী-কলহপ্রিয়-ঝগড়াটে-রূঢ় প্রকৃতির মানুষ। তোমার সাথেও কিন্তু সেভাবে খারাপ ব্যবহার ও রূঢ় আচরণ করতে থাকব। তালাকের বিষয়টি চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরা সূক্ষ্মভাবে এ অভিযান চালিয়ে যাব। এক পর্যায়ে তোমার মায়ের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাবে। তোমার পক্ষ থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের আবদার আসার আগেই তোমার মা- ই তোমাকে এ কলহময় দাম্পত্য জীবন থেকে উদ্ধারে তৎপর হবেন। এভাবে বিচ্ছেদের বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। তখন তুমি দেখবে- তোমার অন্তরের মণিকোঠায় যে মানুষটিকে এতদিন তুমি ঠাঁই দিয়ে এসেছ, তাকে ঘিরেই তোমার মায়েরও আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে। এ ধরনের কৌশল অবলম্বনে তোমার কি মত?
- আপনি যা ভালো মনে করেন।
কথা বলতে বলতে কনে তার চোখের পানি মুছার জন্যে একটা কিছু খুঁজতে থাকে। কিন্তু হাতের কাছে বাসর রাতে পরিহিত বিয়ের শাড়ির আঁচল ছাড়া কিছুই পায় না। চোখের পানিতে নির্মল শাড়ির আঁচল নোংরা করার আগেই বর তড়িঘড়ি বলে ওঠে :
- আরে থাম-থাম। এই নাও আমার রুমাল। বিয়ের শাড়িটাকে নোংরা করো না। তোমার মনের মানুষের সাথে মহামিলনের জন্য ওটি সংরক্ষণ কর।
কনে রুমাল নিতে নিতে বলে :
- আপনি এত অমায়িক! সত্যিই আমি দুঃখিত-অনুতপ্ত। আমিই আপনার আনন্দময় কাঙ্ক্ষিত বাসর রাতটাকে একেবারে পণ্ড করে দিলাম। এতে আপনার কী দোষ? আপনার ফুলশয্যাকে কেন্দ্র করে বিয়ের এ জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানটি এমন বেদনা-বিধূর হওয়ার পেছনে আপনি কী অপরাধ করেছেন? বরং আপনি হয়ত এ বিয়েকে ঘিরে অন্তরের মণিকোঠায় অনেক অনেক আশা ও বাসনা লালন করতেন।
বর কিছুক্ষণ নীরব-নিথর হয়ে থাকে। চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বলে :
- যাক ওসব নিয়ে আর ভেব না । তুমি তোমার পথে আগাও। এ বিষয়টিকে তোমার এত সিরিয়াস হিসেবে নিতে হবে না।
- সত্যিই আমি অনুতপ্ত-ব্যথিত-লজ্জিত।
- আরে রাখ ! আমার জন্য তোমার এত ব্যথিত ও লজ্জিত হওয়ার কী আছে। আমি বেশ আছি। সাময়িক যে সমস্যা দেখা দিয়েছে সে জন্য তো কোনো অবস্থাতেই তুমি দায়ী নও। আমার ভাগ্যটাই এমন। তবে তুমি ঠিকই বলেছ- এ বিয়েকে ঘিরে আমার অন্তরের মণিকোঠায় অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা লালন করতাম। জীবনের পরিণত বয়সে বিয়ে হবে, প্রাণ উজাড় করে সে বিয়ে উপভোগ করব- আমি তো সর্বদা এমনটিই ভাবতাম। কর্মজীবনের ব্যস্ততা আমাকে গ্রাস করে রাখে। কাজেই আমোদ-আহলাদ-বিনোদন ও বিলাসী জীবন সম্পর্কে খুব কমই জানি। ইচ্ছে করেই জীবনে কোনো দিন কোনো নারীকে আমার মনের ভালোবাসার অভিব্যক্তি জানাইনি। অদৃষ্টের লিখনীতে যে জীবন সঙ্গী হবে, তার জন্যই আমি আমার সকল ভালোবাসা অন্তরের মণিকোঠায় জমে রেখেছি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সামান্য অবসরে কল্পনায় আমি তাকে পাশে অনুভব করতাম। মনে হতো সে আমার পাশে বসে আছে। আর আমি তার সাথে মায়া-মমতা-ভালোবাসা-অনুরাগ ও সহানুভূতির গভীর আলাপে মত্ত হয়ে পড়েছি। মানব জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ও কাঙ্ক্ষিত এ পর্বটির জন্যই বছরের পর বছর আমি আমার কাল্পনিক অভিলাষ ও অন্তরের ভালোবাসাকে কৃপণের সম্পদের ন্যায় আগলে রেখেছি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ! ভাগ্য আমাকে আমার পুঞ্জিভূত আকাঙ্ক্ষার বিনিময়ে এমনই প্রতিদান দিয়েছে অনেক কৃপণ তার পুঞ্জিভূত সম্পদের বিনিময়ে যেমনটি পেয়ে থাকে। কেননা যে কৃপণ একটি মাত্র লক্ষ্যকে সামনে রেখে তার চিন্তা-চেতনাকে পুঞ্জিভূত করে এক পর্যায়ে তার কাছে পরিহাসটাই সুমিষ্ট মনে হয়। অনেক সময় অপেক্ষার পালা শেষে কল্পনার সেই কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি হাতের নাগালেও আসে। কিন্তু আনন্দের আতিশয্যে বস্তটি নিয়ে ক্রীড়া-কৌতুক করতে গিয়ে আঙুলের খোঁচায় তা পণ্ড হয়। তখন তার সকল কল্পনা ও প্রচেষ্টা ধুলোয় মিলিয়ে যায়।
- এ সবই আমার কারণে ! আমিই অপরাধী !
- আরে না। এ তো একটা সাধারণ ব্যাপার। এ বিষয়ে তোমার কী করার আছে? আমার উপমা তো সেই কঞ্জুস-বখীলের ন্যায় যে আজীবন তিল তিল করে সম্পদ জমা করতে থাকে। যা দিয়ে সে একখণ্ড জমি কিনবে। জীবনের ক্রান্তিলগ্নে তার সম্পদ জমানো শেষ হয়। জমানো অর্থে খরিদ করে এক খণ্ড জমি। তারপর দেখে জমিটি অন্যের কাছে বন্ধক রয়েছে। কিংবা পাকাপোক্ত দলিলের মাধ্যমে জমিটি অন্যের দখলে। যা উদ্ধারের কোনো পথ নেই। এক্ষেত্রে জমির কী দোষ? দোষ তো হল অপিরিকল্পিত সম্পদ সঞ্চয় ও কৃপণতার। হয়তবা আমিও আমার চিন্তাকে সেভাবেই লালন করেছি। ভেবেছি- “অজানা ও অনাগত ভবিষ্যৎ আমাকে যা দিবে শুধু তার জন্যই আমি আমার পকেটের অর্থ ব্যয় করব।”
- থাক! ওভাবে আর বলবেন না! আপনার কথাগুলো আমার বুকে ধারালো ছুরির ন্যায় আঘাত করছে। আমি সত্যিই ভেবে পাচ্ছি না, এ মুহূর্তে আপনার জন্য আমার কী করা উচিত? আর আমাকে পরামর্শই দিবে-ই বা কে ? ভাগ্য হয়ত আপনাকে আমার চেয়ে অনেক ভালো স্ত্রী-ই দিবে। অনাগত ভবিষ্যত অচিরেই হয়ত আপনার কল্পনার জগতে বেছে রাখা স্বপ্নীল নারীটিকেই জীবন সঙ্গী হিসেবে নিয়ে আসবে। তখন আমি হয়ত আপনার নিকট কিছুই মনে হব না।
- সোনিয়া ! এ তো তোমার আবেগ তাড়িত অনুভূতি মাত্র। বাস্তবতা খুব কঠিন ম্যাডাম। বলি মেম সাহেব! …আরে কী সব বলি-আমাকে ভুল বুঝো না। তোমাকে যে কী বলে ডাকব- ভেবে পাচ্ছি না।
- কী আশ্চর্য ! সাক্ষাতের পর থেকে আমাকে যেভাবে ডাকছেন সেভাবেই ডাকবেন।
- সেটা না হয় তোমার মায়ের সামনে ! কিন্ত আমরা যখন একাকি থাকব- তখন ! সেখানে তো আমার কোনো অধিকার নেই।
- কেন? অধিকার থাকবে না কেন?
- তোমার কোনো যুক্তিতর্কই আমার জন্য সে অধিকার আর ফিরিয়ে দিতে পারবে না ম্যাডাম! যাক এখন থেকে তুমি আমার নিকট ঠিক তেমনি-যেমনটি আমি বলেছি। তুমি আমার একেবারেই অপরিচিতা। এ মুহূর্তে আমাদের কী করা উচিৎ তা আমিও ভেবে পাচ্ছি না। ওদিকে তোমার মা ঘরে বুকভরা আশা নিয়ে আমাদের সুখী দাম্পত্য জীবনের স্বপ্ন দেখছেন। এ দিকে এক ঘরে অবস্থান করা ছাড়া আমাদেরও কোনো উপায় নেই।
যাক ! শোন! তোমার জন্য এই খাট। আর আমার জন্য মাটিই পাটি। ওই তো দরজার একটু দূরে ওই কোণায়। এবার ওঠ। বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়। ক্লান্তিময় এ রাতে বিশ্রাম তোমার খুবই দরকার। বিয়ে অনুষ্ঠানের শুরু থেকে মানসিক ও স্নায়ুবিক যে ধকল গেছে, বিশ্রাম নেওয়া তোমার একান্তই প্রয়োজন।
- আপনি মাটিতেই ঘুমাবেন ?
- এখানে তো আর অন্য কোনো ব্যবস্থা নেই।
- তা ঠিক আছে ! কিন্তু - আমি চাই অনুগ্রহ করে বরং আপনিই...।
এভাবে যে আমি আপনার দীর্ঘ প্রত্যাশিত বাসর-রাতটাকে একেবারে নিরানন্দ-বেদনাবিধুর করে তুলব, তা ভাবতেও নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে।
- আরে রাখ ! আমার আবার বাসর রাত। আমি এতেই সন্তুষ্ট। সব বরের ভাগ্যেই কী আর আনন্দময় ফুলশয্যা থাকে। যাক তোমার এ সহানুভূতি আজীবন আমার মনে কল্পিত প্রিয়ার স্মৃতি অম্লান করে রাখবে।
- আপনি আমার সকল জবাবদিহিতাকে অস্বীকার করতে চাচ্ছেন। এখন এমন এক পরিস্থিতি যখন আপনার সাথে তর্ক-বিতর্ক করা একেবারেই অনুচিত। রাতটা কাটাতে আপনার জন্য অন্তত পক্ষে একটা শোবার জায়গা করে দেই। আপনিও তো ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। এ ধরনের অপ্রত্যাশিত ও নিরানন্দময় পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে আপনাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। খাটের ওপর দু'টো চাঁদর দেখতে পাচ্ছি- আপনার জন্য ওর একটা মাটিতেই বিছিয়ে দেই। তবে একটা শর্ত। আমাদের মাঝে খাট ও মাটি এ দু’টো স্থান লটারির মাধ্যমে বণ্টন করতে হবে। আপনি কি বলেন?
বর মুচকি হাসে। বলে :
বেশ তাই হোক ! তবে আমি আমার পোড়া কপাল সম্পর্কে একেবারেই নিশ্চিত।
কনে তৎক্ষণাৎ ওঠে দাঁড়ায়। ওঠে দাঁড়ায় বরও। দু’জনে মিলে খাটটাকে ঘরের এক কোণায় সরিয়ে নেয়। পরিপাটি করে মাটিতে বিছাতে শুরু করে একটা চাদরের বিছানা। যথাস্থানে বালিশও রাখে। বিছানা পাতার কাজ শেষ। কনে এবার বরের কাছ থেকে ছবিওয়ালা একটা মুদ্রা চেয়ে নেয়। টচ করবে। উভয়ে সম্মত হয়- মুদ্রার ছবিওয়ালা পাশ যার নামে ওঠবে সেই বিজয়ী হিসেবে খাটে শোবে। টচ করতে কনে মুদ্রাটিকে ওপরের দিকে ছুঁড়ে দেয়। দেখা গেল সে-ই বিজয়ী হয়েছে।
বর কনেকে বলে :
- আমি তোমাকে আগেই বললাম না- আমার পোড়াকপাল সম্পর্কে আমি ভালোই জানি ?
না- না- আমি টচ করতে ভুল করে ফেলেছি। নতুন করে আবার আমাদের লটারি করা দরকার।
না- না, তা হয় না। এ তোমার বেশি বাড়াবাড়ি। প্রথমবারের টচই ঠিক রাখ। এটা তো একেবারে পরিষ্কার-ন্যায়নিষ্ঠ ও সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত। এখানে ভুলের কী আছে। তুমিই বিজয়ী হয়েছ। আর আমি পরাজিত। এটাই স্পষ্ট কথা। এখানে আর কোনো চাতুর্য ও কূটকৌশলের আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ নেই।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও কনে প্রথম বারের টচের ফলাফলই মেনে নেয়। কাপড় পাল্টানোর সুযোগ দিয়ে বর কিছুক্ষণের জন্য বাইরে যায়। কনে কাপড় পাল্টিয়ে চুপি-চুপি গিয়ে খাটে শুয়ে পড়ে। এবার বর তার প্রাকৃতিক কর্মাদি সেরে ঘরে ফিরে। সেও বিয়ের পোশাক পাল্টে মাটির বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দেয়। কনে তার মর্মর পাথরের ন্যায় মসৃণ বাহুটি বাড়িয়ে দেয় কাছেই রাখা প্রদীপের দিকে। অনুমতি প্রার্থনার সুরে বলে :
- বাতিটা কি নিভিয়ে দিব ?
- তুমি যা ভালো মনে কর। আমি চাই তোমার একটা আরামদায়ক ঘুম হোক। অন্তরের মণিকোঠায় যাকে ধারণ করে রেখেছ তাকে নিয়ে তোমার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হোক এ কামনাই করছি। আমি নিশ্চিত- তুমি অবশ্যই একজন ভালো মানুষকেই পছন্দ করেছ। যদিও এখন পর্যন্ত তাঁর সম্পর্কে আমার কাছে কিছুই বলনি।
- ও উনি একজন সামরিক অফিসার। লেফটেনেন্ট।
- বেশ ! নিশ্চয়ই একজন সুদর্শন যুবক বটে! বয়সে আমার চেয়ে কমপক্ষে দশ বছরের ছোট হবে। কাজেই তাঁর সাথে প্রতিযোগিতায় নামা কিংবা তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
কথাগুলো সে বিড়বিড় করে অস্পষ্টভাবে নিজেকে সম্বোধন করে বলতে থাকে। কনে তাকে জিজ্ঞেস করে :
- আপনি কি কিছু বলছেন ?
- না- কিছু না। বাতি নিভিয়ে দাও। শুভরাত্রি। ভালো-ভালোই সকাল হোক।
(চলবে)
*[লায়লাতুয্ যিফাফ্ = ফুলসজ্জার রাত]