জিইডির প্রতিবেদন
সরকারি বিনিয়োগ ব্যবস্থার দুর্বলতায় প্রবৃদ্ধি অর্জন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে
জোসনা জামান, দ্য রিপোর্ট : সরকারি বিনিয়োগ ব্যবস্থার দুর্বলতায় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন। ভিশন ২০২১ অর্জন এবং ৭ শতাংশের বেশী জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বজায় রাখতে এই ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন আবশ্যক বলে মনে করছে সংস্থাটি। সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের অপ্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব বিষয় উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে বাংলাদেশে অবকাঠামো খাতে কম বিনিয়োগের ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও সম্ভাব্য ফলাফলকে বাধাগ্রস্ত করছে। বাণিজ্য ও পরিবহন সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোর গুণগতমান খুবই দুর্বল।
এ বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ড. শামসুল আলম দ্য রিপোর্টকে বলেন, সরকারি বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনার সমস্যা ও উন্নয়ন নামের এ প্রতিবেদনটি এখনও খসড়া পর্যায়ে রয়েছে। উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বেসরকারি খাতের সক্ষমতার মাধ্যমে সরকারি বিনিয়োগ একটি অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে। সরকারি বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য থেকে এটি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, সরকারি ব্যবস্থাপনার কর্মদক্ষতার যথেষ্ট সন্তোষজনক নয়। এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা আরো জোরালো হওয়া প্রয়োজন।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) শতাংশ হিসেবে সরকারি বিনিয়োগ ২০০৬ অর্থবছর হতে ২০০৯ অর্থবছর পর্যন্ত ক্রম হ্রাসমান। যদিও এ হার ২০১০ ও ১১ অর্থবছরে কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৬ থেকে ২০১০ অর্থবছর পর্যন্ত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বিপরীতে বরাদ্দ করা অর্থ প্রদানের হার ও অবমুক্তির হার ৭৬ শতাংশ, যার মধ্যে ব্যয় বৃদ্ধিও হার ৪২ শতাংশ এবং সময় বৃদ্ধির হার ২ দশমিক ৯ বছর।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্বল ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামোর কারণে অনেক উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে অর্জনের ফলাফল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অবকাঠামো উন্নয়নে বৃহৎ পরিমানের বিনিয়োগের সঙ্গে উচ্চ ঝুঁকি জড়িত এবং সেই জন্য সরকারি বিনিয়োগের এ সমস্যা অতিক্রম করার ব্যাপারে সুষ্ঠ বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
প্রকল্প নির্বাচনের ক্ষেত্রে অনেক সময় জাতীয় অগ্রাধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা সম্ভব হয় না। প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্বলতার কারণে অনেক সময় প্রকল্পসমূহ শ্বেতহস্তি হিসেবে প্রকাশ পায় যা নেতিবাচক একটি দিক। ধীরগতি ও পশ্চাৎপদ ব্যয় ও বাস্তবায়নের নিম্নমান একটি দেশের সরকারি বিনিয়োগের অদক্ষতার ইঙ্গিত করে।
অবকাঠামো খাতে কম বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ২০১২ সালে বাংলাদেশের স্থান ১৮৩টি দেশের মধ্যে ১২২তম ছিল। এর কারণ হচ্ছে অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ ও উৎপাদন উপকরণে কম সুযোগ। এডিপি প্রতিবছরই পূর্ণাঙ্গভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উন্নয়ন প্রকল্পে মুল বাজেটের বিপরীতে মাত্র ৮০ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে, যা সংশোধিত বাজেটের ৮৫ শতাংশ। তাছাড়া এডিপির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ শেষ প্রান্তিকে ব্যয় হচ্ছে। যা বছরের মোট ব্যয়ের ৪২ শতাংশ। এই চিত্রটি কাজের গুণগত মান নয় বরং ব্যয়ের বিস্তৃতিকেই প্রকাশ করে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, সরকারি মূল্যায়ন ইউনিটের (আইএমইডি) প্রতিবেদন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রকল্প সমাপ্তির জন্য অধিক প্রাক্কলিত ব্যয় এবং অধিক সময়ের প্রয়োজন হয়। ২০১০ সালের সমাপ্ত প্রকল্পের জন্য গড়ে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছিল ২৬ শতাংশ এবং গড় সময়সীমা বেড়েছিল ২ দশমিক ৭৯ বছর। আর্ন্তজাতিক তুলনায় এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান তানজানিয়া, মালাবি ও ইথিওপিয়াসহ কিছু আফ্রিকান দেশের উপরে হলেও ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইন থেকে অনেক পিছিয়ে।
সরকারি বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনার মূল বিষয় সম্পর্কে বলা হয়েছে, সরকারি বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনার মূল বিষয়াবলীর ৫টি বড় ভাগ হচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির প্রক্রিয়ায় নানা সমস্যা, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির দুর্বল সংযোগ, উন্নয়ন পরিকল্পনা ও প্রকল্পের তদারকি ও মূল্যায়নে দুর্বলতা, কৌশলগত সম্পদ বন্ঠন এবং আন্তসম্পর্কীয় বিষয়াবলী।
সরকারি বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে দশ বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছে সরকারের অর্থনৈতিক থিঙ্কট্যাংক হিসেবে খ্যাত সংস্থা সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। এগুলো হচ্ছে, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কৌশলগত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়ন, প্রকল্প বাছাই করে তারপর এডিপিতে অর্ন্তভুক্ত করা, কৌশলগত এডিপি প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ও মধ্যমেয়াদী বাজেট কাঠামোর মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিভুক্ত উন্নয়ন প্রকল্পের পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের জন্য ফলাফলভিত্তিক ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ, আইএমইডির মাধ্যমে এডিপি পরিবীক্ষণের জন্য প্রকল্প পর্যায়ে ফলাফলভিত্তিক পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন কাঠামো প্রণয়ন করা, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও এডিপির আরবিএমএন্ডই কার্যক্রমের সমন্বয় বিষয় জোরদার করা, আরবিএমএন্ডই কার্যক্রমে যুক্ত কর্মকর্তাদের সক্ষমতার উন্নয়ন, আইএমইডিকে আইন প্রয়োগের কর্তৃত্ব প্রদান করা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ও এমটিবিএফের পরিবীক্ষণ কার্যক্রমের মধ্যে অধিকতর সমন্বয় সাধান করা প্রয়োজন।
(দ্য রিপোর্ট/জেজে/জেএম/জানুয়ারি ০৪, ২০১৪)