আন্তর্জাতিক মহলে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। একই সঙ্গে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতা নিয়ে মার্কিন ফরেন পলিসির সাময়িকীর উদ্বেগ ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক সম্পর্কের উপরও প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন তারা।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘পর্যবেক্ষক পাঠানো বা না পাঠানোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি হওয়ার বিষয়টি জড়িত নয়। যেকোনো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পর্যবেক্ষক না পাঠাতেই পারে। কিন্তু বিষয়টি হলো এই- নির্বাচন নিয়ে তাদের অনুধাবনটা কি? আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়গুলো বাংলাদেশের সংবিধানের প্রতি সম্মান রেখেই কথা বলছে। তারা বার বার বলেছে, দুই দলের সমঝোতার মাধ্যমে একটি নির্বাচন করা হোক। একই সঙ্গে তারা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংঘাত ও হতাহতের ব্যাপারেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা কখনোই নির্বাচন বাতিলের ব্যাপারে পরামর্শ দিচ্ছে না। তাদের উদ্বেগ দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে। আর এ ধরনের উদ্বেগ ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।’

নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে প্রথম ধাক্কাটি আসে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে। আন্তর্জাতিক এই সম্প্রদায়টি নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও কমনওয়েলথের মতো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এই নির্বাচনে কোনো পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন পলিসি সাময়িকীর এক প্রতিবেদনে বিশ্বের শীর্ষ দশ ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম চলে এসেছে। বাংলাদেশ বিষয়ে প্রতিবেদনে আলাদা করে বলা হয়, ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক সংঘাতের মধ্য দিয়ে নতুন বছর শুরু করেছে দেশটি। জানুয়ারিতে নির্বাচনের আগে দেশটিতে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিরোধীদের সংঘর্ষে শতাধিক মানুষ নিহত ও অনেকে আহত হয়েছেন। বিরোধীরা হরতাল-অবরোধ দিয়ে সহিংসতা চালিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কর্তৃত্ববাদী শাসন চালাচ্ছে ও নির্বাচনে কারচুপির পরিকল্পনা করছে অভিযোগ তুলে নির্বাচন বর্জন করছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি।

জাতীয় নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানো ও মার্কিন সাময়িকীর প্রতিবেদনের ফলে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে থাকা দেশের সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ওপর প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। একই সঙ্গে বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি কূটনীতিক ও নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়েও এ সব দেশের উদ্বেগ বাড়বে বলে মনে করেন তারা।

এ ব্যাপারে অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘দশম জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ এখন পুরোটাই স্পষ্ট। প্রথমে ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র ও কমনওয়েলথের মতো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এতে প্রমাণিত হয় তারা মনে করছে, বিরোধী দলবিহীন এই নির্বাচন পর্যবেক্ষণের কী কোনো প্রয়োজন আছে? যেখানে ১৫৩ জন একক প্রার্থী হওয়ার জন্য জয়ী হয়ে গেছেন সেখানে এই নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষতা যাচাইয়ের কোনো প্রয়োজন নেই। প্রতিযোগিতাহীন এই নির্বাচন নিয়ে তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কোনো আগ্রহ নেই।’

তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের পর যদি দেশের এই অস্থিতিশীলতা বজায় থাকে তাহলে বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি নাগরিক ও কূটনীতিকদের নিরাপত্তার ব্যাপারেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে যেকোনো সিদ্ধান্তও আসতে পারে। আর এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে সম্প্রতি মার্কিন ফরেন পলিসির সাময়িকীর প্রতিবেদনটি যথেষ্ট সাহায্য করবে।’

এ সব ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আমীন চৌধুরী দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে তখন তাদের অনুসারী সকল রাষ্ট্র ও সম্প্রদায়ও একই আশঙ্কা করবে। আর শীর্ষ দশ ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম থাকায় তা ইউএন শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের বিষয়টিকেও হুমকির মুখে ফেলবে। তালিকাটির বেশ কয়েকটি দেশে ইতোমধ্যে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন কাজ করছে। এ সব রাষ্ট্রের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্পর্কও শক্তিশালী নয়। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশ যেখানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের কাজ করে সেখানে এ দেশকে যদি ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হয় তাহলে আমাদের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে থাকবে বলে মনে হয় না।’

তিনি বলেন, ‘চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে দেশীয় আন্তর্জাতিক বেশ কিছু সংস্থা আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। তারা মনে করছেন, শুধু এই জাতীয় নির্বাচনকে নিয়ে সৃষ্ট সংঘাত দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে। আর তা স্থায়ীভাবে চরমপন্থীতারও রূপ নিতে পারে।’

বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের পাশাপাশি আর্থিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘মার্কিন ফরেন পলিসির সাময়িকীতে প্রকাশিত প্রতিবেদন অবশ্যই দেশের কূটনৈতিক ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে আর্থিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে পারে। বিশেষ করে বৈদেশিক বিনিয়োগকারী, দাতা সংস্থার প্রতিনিধি ও বায়াররা নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বাংলাদেশে আসা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করতে পারেন। চলমান সংঘাত ও সংঘর্ষকে বিবেচনা করে এ দেশে বিনিয়োগ করতেও ঝুঁকিপূর্ণ মনে করবে তারা।’

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত ও মার্কিন সাময়িকীর প্রতিবেদন অবশ্যই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে উপর প্রভাব ফেলবে।’

(দ্য রিপোর্ট/ এইচআর/ এসবি/এনআই/জানুয়ারি ০৪, ২০১৪)