দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম থাকায় হতাশ হয়েছে আওয়ামী লীগ। এর মধ্যদিয়ে দলটির সাংগঠনিক দুর্বলতাও ফুটে উঠেছে। আবার ভোটার উপস্থিতি কম থাকলেও ভোট অনুষ্ঠান শেষ করতে পারায় সন্তুষ্ট হয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। ক্ষমতাসীন দল ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে ব্যর্থতার ঘটনাকে বিএনপি-জামায়াতের নাশকতা হিসেবে চিহ্নিত করে বৈতরণী পার হতে চাইছে।

ভোট শেষে একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে আমাদের চেষ্টা ছিল, এটি সত্যি। ভোটকে ঘিরে যে আতঙ্ক ছিল মূলত সেটাই ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার কারণ ছিল।’ তারা বলেন, ‘সবারই প্রাণের মায়া আছে।’ কেউ কেউ আবার বলেন, ‘এর মধ্যদিয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতাও ফুটে উঠেছে।’

একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে তৎপর হওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই দলীয় নেতাদের বার বার তাগাদা দিয়েছেন।

ভোটের দিন সকাল থেকেই আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে বসে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ কেন্দ্রীয় ডজন খানেক নেতা সারাদেশে ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে তৃণমূল নেতাদের নানামুখী নির্দেশনা দিয়েছেন। ভোটকেন্দ্রগুলোতে সংগঠিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতেও নির্দেশনা দেওয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাতক্ষীরা, পাবনা, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় দায়িত্বশীল অনেক নেতাই ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে কোনো তৎপরতায় যুক্ত হয়নি। তৃণমূল নেতাকর্মীদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, যারা ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হয়নি কেন্দ্র থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে শাসানো হয়। তবু দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে কেন্দ্রগুলোতে প্রত্যাশানুযায়ী ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত হয়নি। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য কেন্দ্রীয় তৎপরতার কথা স্বীকার করে বলেন, বিএনপি-জামায়াতের নাশকতার আতঙ্ক এক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করেছে।

ভোটার উপস্থিতি প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রভাবশালী এক নেতা এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ শক্তিশালী নেই। কোথাও ঐক্যবদ্ধ নেই আওয়ামী লীগ। প্রশাসনিক সহযোগিতায় নির্বাচনের বৈতরণী পারি দিতে সক্ষম হয়েছে আওয়ামী লীগ। সাংগঠনিকভাবে দুর্বলতা ফুটে উঠেছে।’

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারাদেশে ভোটার উপস্থিতির খবরে রবিবার ভোটের দিন দুপুরে হতাশ হয়ে পড়েন কেন্দ্রীয় নেতারা। তৃণমূলকে নির্দেশনা দিয়ে গেলেও তা কাজে না আসায় বিকেল ৩টার দিকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমন্ডির কার্যালয়ে বসে থাকা সব শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের হতাশ করে তোলে এ ঘটনা। এ সময় সেখানে উপস্থিত তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মোহাম্মদ নাসিম, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, ওবায়দুল কাদেরসহ শীর্ষ নেতাদের চেহারায় হতাশার ছাপ দেখা গেছে। একপর্যায়ে ওবায়দুল কাদের ও জাহাঙ্গীর কবির নানককে একের পর এক ফোনে তৎপর হতে দেখা গেছে। জেলার নেতাদের ফোন করে তারা ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে ‘নন স্টপ’ তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বলা হয় কেন্দ্র থেকে।

এ সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে শোনা যায়, কেন্দ্রীয় নেতারা ফোনে বলছেন, ‘মহিলা ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে যাও। নেতাকর্মী ও সমর্থক কেউই যাতে ভোট দেওয়া থেকে বিরত না থাকে তা নিশ্চিত কর।’ এ সময় তাদের সাতক্ষীরা, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, খুলনা, দিনাজপুর, যশোর, গাইবান্ধা, পটুয়াখালী, লালমনিরহাট, বগুড়া ও ঢাকার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে খবরদারি করতে দেখা গেছে।

সাতক্ষীরার ৪টি আসনের দুটিতে পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব ও সেনাবাহিনীর টহল অব্যাহত থাকলেও ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারেনি আওয়ামী লীগ। অবরোধ ও হরতালে জীবন বাজি রেখে ভোটপ্রদানের সংশয় প্রকাশ করছেন ভোটাররা।

প্রিসাইডিং অফিসার ফরিদ আহমেদ জানান, সিরাজগঞ্জ-৫ আসনের বেলকুচি থানার কল্যাণপুর রওশনিয়া দাখিল মাদ্রাসায় ৩৫১৮ ভোটের মধ্যে বেলা দেড়টা পর্যন্ত কোনো ভোট পড়েনি। প্রিসাইডিং অফিসার আবুল কালাম আজাদ জানান, কল্যাণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা ২৩৩৮ জন। ভোটের দিন দেড়টা পর্যন্ত ওই কেন্দ্রে কোনো ভোট পড়েনি। সকাল থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত কেন্দ্রের আশপাশে পাঁচটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। রাতেও সেখানে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। এ দুটি কেন্দ্রে কোনো প্রার্থীর এজেন্টও ছিলেন না। রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনের চারঘাটের শলুয়া ইউনিয়নের মাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে কোনো ভোট পড়েনি। ওই কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা ২৭৯৩ হওয়ার পরও রবিবার দুপুর ২টা পর্যন্ত একজন ভোটারও তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে আসেননি। এ সব খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় কেন্দ্র থেকে।

সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার একটি কেন্দ্রে দুপুর ১২টা পর্যন্ত একটি ভোটও পড়েনি। ব্যালট বাক্স পুরোটাই খালি। কেন্দ্রটির নাম রামধানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এটি নিখোঁজ বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীর গ্রামের বাড়ি। এদিকে লালমনিরহাটের পাটগ্রামে এক প্রিসাইডিং অফিসারকে পিটিয়ে আহত করেছে নির্বাচনবিরোধীরা।

তবে কোনো ষড়যন্ত্রই ভোট অনুষ্ঠানকে বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি এই ভেবে স্বস্তির ঢেকুর তুলছে ক্ষমতাসীনরা। তারা বলছেন, এতবড় একটি হত্যাযজ্ঞ পরিস্থিতির পরও আওয়ামী লীগ ভোট সম্পন্ন করতে পেরেছে এটিই বড়! শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কয়েক নেতা বলেন, ‘সারা পৃথিবী একদিকে আর বাংলাদেশ একদিকে থেকে এ নির্বাচন সম্পন্ন করতে পেরেছি আমরা।’ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ভোটের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আশাব্যঞ্জক কথা বললেও ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের অনুপস্থিতি ভীষণ হতাশ করেছে আওয়ামী লীগকে। আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি আশানুরূপ হয়নি এ বিষয়টি স্বীকার করেছেন।

ভোটার উপস্থিতি কম ছিল স্বীকার করে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ভয়ভীতিই ভোটার উপস্থিতি না হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ। এর মধ্যে একটি বড় দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এ অবস্থায় এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। তিনি বলেন, ভোটার উপস্থিতিতে নির্বাচনের কিছু আসে যায় না। আমাদের লক্ষ্য ছিল ভোট নিশ্চিত করা, আমরা সেটা পেরেছি। নাসিম বলেন, ঢাকায় কম-বেশি ভোটার উপস্থিতি ছিল। তবে ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ঢাকায় একটি মাছিও উড়তে দেখা যায়নি। সে তুলনায় এটা অনেক স্বতঃস্ফূর্ত ভোট হয়েছে।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ভোটার উপস্থিতি আশানুরূপ হয়নি স্বীকার করে এ প্রতিবেদককে বলেন, এক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াতের নাশকতা সৃষ্টির আতঙ্কই দায়ী। তিনি বলেন, সব প্রতিকূলতা ঠেলে তার পরও যে পরিমাণ ভোটার কেন্দ্রে উপস্থিত হয়েছে, আমরা তাতেই সন্তুষ্ট।

(দ্য রিপোর্ট/এমএন/এনআই/এসবি/শাহ/জানুয়ারি ৬, ২০১৪)